গত ২৬ জুন বলিভিয়ায় সামরিক ক্ষমতা দখলের জন্য সংগঠিত ক্যু ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল এবং অন্যান্য বিশ্বজুড়ে আলোচিত বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের চক্করে বলিভিয়ার ঘটনাটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হয়তো সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু বামপন্থি আন্দোলনের সাথে যুক্ত নেতাকর্মীদের জন্য বলিভিয়ার ঘটনাটির গুরুত্ব অনেক বেশি।
সেনাবাহিনীর একটি অংশ গত ২৬ জুন বিকেল ৪টার দিকে প্রেসিডেন্ট লুইস আর্সের প্রাসাদে ঢোকে। প্রেসিডেন্টের বাসভবন ঘিরে ফেলে তারা। প্রেসিডেন্টের প্যালেস ঘিরে ফেলেও এক পর্যায়ে সরে যায় সেনারা। শেষ পর্যন্ত চার ঘণ্টা পরে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং গ্রেপ্তার হয়েছেন সেনাপ্রধান হুয়ান হোসে জুনিগা।
যখন এই অভ্যুত্থান চলছে, তখনই প্রেসিডেন্ট লুইস আর্সে নতুন সেনা কমান্ডারদের নাম ঘোষণা করেন। তারা তখন প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ও শহর লা পাজের কেন্দ্রে থাকা অন্য জায়গা থেকে সেনাদের ফিরে আসার নির্দেশ দেন। সেনারা যখন ফিরে যাচ্ছেন, তখন আর্সের হাজার হাজার সমর্থক বলিভিয়ার পতাকা নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট বলিভিয়ার নাগরিকদের বলেন, “তারা যেন গণতন্ত্র রক্ষা করতে সক্রিয় হন।”
আরর্সে পাশে দাঁড়িয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালস। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে জানান, “তিনি তার সমর্থকদের গণতন্ত্রের পক্ষে থাকতে বলছেন। সেনাকে কিছুতেই গণতন্ত্র ধ্বংস করতে দেওয়া হবে না এবং মানুষকে ভয় দেখাতে দেওয়া হবে না।”
উল্লেখ্য যে, বামপন্থিদের মধ্যে বিভাজন এবং পারস্পরিক সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর একাংশ বলিভিয়ার নির্বাচিত সোস্যালিস্ট সরকারকে উচ্ছেদ করার ডাক দিয়েছিল।
বলিভিয়ার ক্ষমতাসীন বামপন্থি দল ‘মুভমেন্ট ফর সোস্যালিজম’ এখন দুই টুকরো। একাংশের নেতৃত্বে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস, অন্য অংশের নেতৃত্বে বর্তমান প্রেসিডেন্ট লুইস। আগামী বছর নির্বাচন। তার আগে তিক্ত সংঘাত চলছে দুপক্ষের মধ্যে। সেই সুযোগে নির্বাচিত বামপন্থি সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চাইছিল সেনাবাহিনীর একাংশ।
জেনারেল জুনিগার ক্যু প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিলেন মোরালেসও। সেনাবাহিনীকে রুখতে দেশের সর্বত্র ব্যারিকেড তৈরি করতে বলেছিলেন তিনি। মোরালেস অভিযোগ করেছেন, এই চক্রান্তের পিছনে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক হল, ক্যু প্রতিরোধে দুই বাম নেতাই গণজমায়েতের ডাক দিয়েছিলেন। বন্দুকের চেয়েও বেশি ভরসা করেছিলেন জনতার ওপরেই।
বিশ্ব একটা পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিপরীতে প্রাচ্যের দেশগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে, আফ্রিকাও পশ্চিমা নয়া উপনিবেশ বা সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চাচ্ছে। ফলে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ তার আধিপত্য, কর্তৃত্ব ও শোষণ আর আগের মতো টিকিয়ে রাখতে পারছে না, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের একক আধিপত্য এতখানি বিপদে এর মধ্যে পড়েনি। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাই মরিয়া হয়ে আছে সম্পদে পরিপূর্ণ বা ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে নিজেদের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। ফলে ইভো মোরালেসের অভিযোগ উড়িয়ে দেয়া যায় না। ২০১৯ সালে সামরিক ক্যু ঘটিয়ে নির্বাচিত মোরালেসকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্পষ্ট মদত ছিল। এছাড়াও তেলসম্পদে সমৃদ্ধ বলিভিয়ায় ১৯৫০ সালের স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় দুইশতাধিক সেনা অভ্যুত্থান ও বিদ্রোহ সংগঠিত হয় যার বেশিরভাগের পেছনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল অথবা মার্কিন পাপেট সরকারের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক বিদ্রোহ ছিল।
বলিভিয়ায় সাম্প্রতিক সেনা অভ্যুত্থান বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টভাবেই বুঝা যায় যে বামপন্থিদের মধ্যে বিভেদ ও বিবাদের সুযোগ নিতে চেয়েছিলো বিদেশী শক্তির মদদপুষ্ট সেনা কর্মকর্তারা এবং সেই পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছেও বামপন্থিদের ঐক্য। ঐতিহাসিকভাবে এটাই শিক্ষণীয় যে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার divide and rule কূটকৌশল আজকের নয়, বরং উপনিবেশিক সময় থেকেই তারা এই কৌশল ব্যবহার করে দেশ দখল করেছিলো এবং নিজেদের শোষণ ও লুটপাট টিকিয়ে রেখেছিলো। ঐতিহাসিকভাবে আরো শিক্ষণীয় যে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দেশে দেশে প্রাথমিক প্রতিরোধ বামপন্থি ও কমিউনিস্টরাই গড়েছিলো তাই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ দেশে দেশে নিজস্ব এবং স্থানীয় এজেন্টদের ব্যবহার করেছে কমিউনিস্ট বামপন্থিদের ঐক্য বিনষ্ট করতে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ যার আঁচ পাওয়া যায় খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মার্কিন হাই প্রোফাইল কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ সফর এবং আওয়ামী একতরফা নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ দেখে। এছাড়াও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে মায়ানমারে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বাংলাদেশকে ব্যবহার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইবে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মূল নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকতে যেন বিরোধী দলগুলো আজ্ঞাবহ রেখে বর্তমান স্বৈরাচারী সরকারকে প্রেশার পয়েন্টে রাখা যায়। আর সেটা করতে গেলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজন তার নিজের স্বপক্ষে একটি পজিটিভ ন্যারেটিভ বা বয়ান প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য এসব কিছু করতে সবচেয়ে বড় বাধা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা, কারণ ইতিহাস বলে যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট বামপন্থিরা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সবগুলো আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। তাছাড়া অদূর ভবিষ্যতে স্বৈরাচারী শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশের জনগণ যখন গণআন্দোলনের পথ বেছে নিবে তখন ভরসা করার জন্য বামপন্থিদেরই বেছে নিবে কারন জনগণের সামনে স্পষ্ট হচ্ছে যে বিএনপি আওয়ামী লীগের থেকে ভিন্ন কিছু না। জনগণ দেখতে পেয়েছে যে ইজরাইল একের পর এক যুদ্ধাপরাধ সংগঠিত করার পরেও বিএনপি আওয়ামী লীগ সমানভাবেই ইজরাইলের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করেনি, ইজরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একই কাঠগড়ায় তুলে প্রতিবাদ করেছে একমাত্র বামপন্থিরাই। ফলে জনগণ একটা পর্যায়ে গিয়ে নৈতিক অবস্থান থেকে বামপন্থিদের উপর ভরসা করবে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এই পরিণতি আঁচ করতে পেরেই তার স্থানীয় এজেন্টদের মাঠে নামিয়েছে দেশের বামপন্থি এবং প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোকে বিভ্রান্ত করতে, নিজেদের মাঝে বিবাদে লিপ্ত করতে। এমনই একটা সময়ে বলিভিয়ার এই ঘটনাটি সকলের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকলো যে বামপন্থিদের বিভক্তি প্রতিক্রিয়াশীল ও লুটেরাদের মাথাচাড়া দিতে যেমন সুযোগ করে দেয়, তেমনি বামপন্থিদের ঐক্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রগুলোকেও নস্যাৎ করে দেয়।
লেনিনবাদ সম্পর্কে বুঝাতে শ্রমিকশ্রেণির মহান নেতা কমরেড স্তালিন বলেছিলেন- “সাম্রাজ্যবাদী যুগের মার্ক্সবাদই হচ্ছে লেনিনবাদ”, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ প্রতিরোধের বিকল্পহীন দুর্গই হচ্ছে লেনিনবাদী সংগঠন। আর মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী মানেই আদর্শিকভাবে তার অবস্থান পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, ফলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্যবস্তুই থাকে মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী সংগঠনগুলোতে বিভ্রান্তি, বিচ্যুতি, বিরোধ ঢুকিয়ে তাদের ধ্বংস করা। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবি বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে মার্কিন এইসকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে করতেই এগিয়ে গিয়েছে, তাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার ধ্বংসের আগে যেমন হাল ছাড়বে না; তেমনই সিপিবিও এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার বিষয়ে অবহেলা করতে পারবে না।
কমরেড মাও সে তুংয়ের গুরুত্বপূর্ণ উক্তি ছিল- “বিপ্লব সফল করার প্রাথমিক শর্ত হলো শত্রু এবং মিত্র সঠিকভাবে নির্ধারণ করা”। বর্তমান এই সময়ে এসে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের বাইরে তাকিয়ে কমিউনিস্ট বামপন্থিদের জন্য শত্রু মিত্র নির্ধারণ করতে চাইলে তিন ‘স’ এর পক্ষে-বিপক্ষে দেখেই তা নির্ধারণ করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং স্বৈরাচার- এই তিন ‘স’ এর মানদণ্ডে আপসহীনভাবে বন্ধুত্ব, জোট, মিত্র, শত্রু নির্ধারণ করতে হবে। বলিভিয়ার বামপন্থিদের ঐক্য দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট বামপন্থিরাও সঠিকভাবে শত্রু মিত্র নির্ধারণ করে একতাবদ্ধ হয়ে মেহনতি মানুষের মুক্তি আনবে।
লেখক : সদস্য, ঢাকা মহানগর উত্তর, সিপিবি