তৈলংছড়ার ২৭টি ত্রিপুরী ও উবাহাটা-চৈতন্যগঞ্জের ২২টি রবিদাস পরিবার

আহমদ সিরাজ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের উপদ্বীপ বা তার নৈকট্যকে বহন করে গঠিত হয়েছে, যার ফলে ছোট এই দেশের মাটি সাগরের সারাৎসারকে গ্রহণ করেছে। তেমনই বিরাটত্বের মহিমার ফলে এদেশের জন ও সম্পদ বৈচিত্র্যে বিপুল সম্ভার ও সম্ভাবনার অফুরন্ত ভাণ্ডার। তথাপি এদেশের মানুষ মাটির শত বছর ধরে নানাভাবে দিক পরিবর্তন হয়েছে, তেমনই শোষণ শাসনে পরাধীন থেকেছে, তথাপি দেশটির বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত উপাদানে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত হয়েছে। যার সর্বশেষ অবস্থান স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হওয়া–যার জন্মের ৫৩ বছর অতিবাহিত হতে চলা এবং তাতে নানা চড়াই উৎড়াইয়ের মধ্যে অনেক অর্জন। যার অনেক কিছুই আরো হতে পারতো, কিন্তু তার অনেক কিছুই হয়ে উঠতে পারেনি। তা হয়ে উঠতে পারলে, দক্ষিণ এশিয়ার সেরা বা শীর্ষ উন্নয়নশীল বা উন্নত দেশ হিসেবে গণ্য হয়ে উঠতে পারতো। এখানে এমন সম্ভাবনাময় দেশে অনেক জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তন্মধ্যে মণিপুরী, খাসিয়া, সাওতাল, মুন্ডা, গারো, তেলেগু উরাং, ত্রিপুরী, ভুজপুরী প্রভৃতি- বাংলাদেশ সরকারের নৃ-গোষ্ঠী হিসাবে ৫০টির তালিকা রয়েছে, যার সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। বাংলাদেশের চার শতাধিক উপজেলার মধ্যে কমলগঞ্জ বিশেষ বৈশিষ্ট্য রাখে। এখানে মণিপুরী যেমন মীতৈ, বিষ্ণুপ্রিয়া, পাঙানসহ সাওতাল, মুন্ডা, গারো ও চা বাগানের বিচিত্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তেমনই নান্দনিক জনগোষ্ঠীর মাঝে একটি ত্রিপুরী জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর একটা অংশ কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের তৈলংছড়ায় বসবাস করে, যার পরিবার সংখ্যা ২৭টি। এছাড়া এদের একটা অংশ মাঝেরছড়া, কালাছড়ায় বসবাস করে। তৈলংছড়ায় ১৪০ জনের মতো লোকসংখ্যা। এরা দুর্গম ভারত সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলের বাংলাদেশ অংশের টিলাভূমিতে বসবাস করে। শান্ত ও বিনীত স্বভাবের এই জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে পাহাড়ের জীবন ও জীবিকাকে বহন করে জীবন অতিবাহিত করে আসছে। তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি প্রথা, রীতি, নীতিতে তারা নিজেরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে, তেমনই রাষ্ট্রও তাতে বর্ণিল সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য বহন করেছে। মূলধারার সমাজ ও সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্যের মাঝে যে ঐক্য তা-ও কিন্তু চিহ্নিত হয়েছে। ঠিক এ উপজেলার অপরাপর জাতিসত্তার অবস্থানের ক্ষেত্রেও তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এভাবে সংযোজন ঘটিয়েছে-যার ফলে ক্ষুদ্র-বৃহৎ এ মেলবন্ধন ঘটেছে। উপজেলা হিসেবে কমলগঞ্জে এমন গৌরববোধ করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে এসে, এই প্রান্তিক দূরত্বে অবস্থিত তৈলংছড়ার ত্রিপুরী জনগোষ্ঠীর লোকজন সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও আয়-রোজগারে চলার ক্ষেত্রে দারুণ উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করছে বলে মনে হয়। একটা সময় সীমান্তের এত দূরত্বে পাহাড়ের ঘোর জঙ্গলে তারা বসবাস করেছে, তা স্থানীয় প্রশাসন তথা এলিট বিদ্বানদের জানার মধ্যে ছিলো না। লোকালয়ের বাইরে তারা নিজেদের মতো আদিবাসী, রীতিনীতিতেই জুম চাষ, লেবু চাষসহ নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী কাজের মধ্যে দিনযাপন করে যাচ্ছিল। একটা সময় হিতৈষীদের যোগাযোগে ও প্রশাসনের নজরে এলে, যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু এই অঞ্চলে এত দুর্গম ব্যবস্থা রয়েছে যে, তার একটি বড় কারণ এই এলাকা বন বিভাগের আওতায়। এখানে যোগাযোগে পুল, কালভার্টসহ যা কিছু সরকারি ব্যবস্থায় করতে হলে, বন বিভাগের অনুমতি দরকার হয়ে পড়ে, যার ফলে দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ লাইন স্থাপিত হলেও এই তৈলংছড়ায় ২৭টি পরিবার, সরকারি বিদ্যুত ব্যবস্থার বাইরে ঘোর অন্ধকারে জীবন যাপন করে থাকে। তাদের বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই। সকল ত্রিপুরী লোকজন, কুয়ার পানি পান করে থাকে, তা সংগ্রহ করতে কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয়, তা বলাই বাহুল্য। এ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার থাকলেও তাদের এসব ভোগ করার সুযোগ নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে এমন অবস্থা যে, তাদের সন্তানদের দূরত্বের কারণে ও শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা ঠিকমতো না থাকার কারণে তা থেকেও বঞ্চিত থাকে। দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে কলেজের মতো উচ্চ শিক্ষাতেও পড়ালেখা করা দুস্কর হয়ে পড়ে। তাদের অনেকেই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা আত্মীয় গোষ্ঠীর বাড়িতে গিয়ে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণের চেষ্টা করে থাকে। সহজ সরল অনাড়ম্বর এই লোকেরা লোকালয়ের এলিট বিদ্বানদের সম্মান করে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তাদের ভেতরের দুঃখের কথা জানাতে চায় না। তা বুঝে নেওয়া সহজ হয় না। তারা অলিখিত, অঘোষিত নানা চাপেও থাকে। এখানে ত্রিপুরী বলে নয়, অতি দুর্বল মানুষ যখন বুঝে নেয়, তা সমস্যাটি উম্মেচিত হলে, তার কোন স্থায়ী সমাধান তো হবে না বরং তা উম্মেচিত হয়ে উঠলে তা নিরাপত্তাহীনতা যদি আরো দশ গুণ বেড়ে যায়। তা হলে নিজের ক্ষতি স্বীকার করে হলেও যতদূর পারা যায়, নিরাপদ থাকাই শ্রেয়ভাবে। একটু শান্তি, একটু স্বস্তিতে যদি থাকা যায় তখন কাছের প্রিয় মানুষটিও তার গভীরতর বেদনার কথা জানার পরও মুখ ফুটে বলতে চান না। জীবনের এমন অদ্ভুত সত্য পড়ে আছে, দুর্বল মানুষের মাঝে। দেখাগেছে ভোটের সময় গরীব মানুষ টাকা খায় বলে অভিযোগ আছে। এমন অভিযোগ উড়িয়ে না দিলেও অদ্ভদ বাস্তব সত্য হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে গরীব মানুষ যখন বুঝে নেয়, সকল প্রার্থীই মন্দ ও ঝামেলার। তখন সকল প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা না নিলে নিরাপদ থাকা যায় না এমন বিদ্যমান বাস্তবতার কারণেও ভোটের সময় গরিব মানুষ এভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করে। এমন অদ্ভুদ অবস্থানে তৈলংছড়ার খাচুক দেববর্মা, জেকব দেববর্মা, সুইটি দেববর্মা, মনিং দেববর্মা, সোহেল দেববর্মা, রাহুল দেববর্মা, প্রমি দেববর্মা, ষষ্ট, সপ্তম, অষ্টম, নবম শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। নয়ন দেববর্মা কলেজে অনার্স ক্লাসে পড়ে। তাদের পড়ালেখার সরজমিন তথ্য জেনে নিলে চমকে যেতে হয়। অথচ এই জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা, বাংলাদেশে লক্ষাধিক। তাদের সমৃদ্ধ নিজস্বভাষা ‘ককবরক’ তাদের নিজস্ব বর্ণমালাও আছে। আছে বিশাল সাহিত্য, সংস্কৃতির ভান্ডার, যাতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আকৃষ্ট হয়েছেন। ত্রিপুরার মহারাজার দান অনুদানের বিশিষ্ট বাঙালি এলিটরা উপকৃত হয়েছেন একদা অবিভক্ত ভারতবর্ষে। তেমনি বাংলা ভাষারও ঋণ আছে। ত্রিপুরা রাজ্য এক সময় দীর্ঘদিন বাম শাসিত রাজ্য হিসাবে ছিল। এসব ঠিকমতো মাথায় রাখলে আমাদের তৈলং ছড়া পড়ে থাকা ২৭টি ত্রিপুরী পরিবারের জীবন ও জীবিকা এভাবে বৃত্তাবদ্ধ হয়ে থাকা সমীচিন নয়। এর পাশাপাশি উল্লেখিত অবস্থানের মতো না হলেও কমলগঞ্জ উপজেলার চৈতন্যগঞ্জ-উবাহাটা এলাকায় ২২টি রবিদাস পরিবার বাস্তবতই এক দুর্দশাময় জীবন অতিবাহিত করছে। একটা সময়ে এই জনগোষ্ঠীর লোকজনের একটা ভূমি কিছু কিছু চাষের জমি জমাও ছিল। কমলগঞ্জের ধলাই নদীর পাশে তাদের বসবাস থাকাতে নদী ভাঙনের শিকার হয়ে পড়ে। একটা সময়ে ২২টি রবিদাস পরিবারই ভিটাভূমি সব নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ২০১৭ সাল থেকে তারা এই নদীর অপর পারে আশ্রয় নিলে তাদের নিজস্ব ভিটাভূমি না থাকায় এক অনিশ্চিত অবস্থায় পড়ে আছে। এখানেও অনেকটা নদী, বাড়িঘর নদীগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়ছে। এখানে তারা এমন একটা আবদ্ধ অবস্থায় আছে যে, হারানো জায়গার বদলে যেমন জায়গা পাচ্ছে না, তেমনি প্রশাসনের নজরে এলেও সুরাহা হয়ে উঠছে না। আজও আগামী দিনের প্রত্যাশার মধ্যে থাকার একটা আশ্বাস প্রবণতা আছে। এখানে একটা অকথিত বেদনাও আছে। রবিদাস নিম্নবর্গের এতগুলো পরিবার সকল ক্ষেত্রে গৃহীত হওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের ন্যূনতম প্রাপ্য অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে ভয়াবহভাবে বঞ্চিত। তাদের জরুরি দাবি হচ্ছে– (১) নিজস্ব জায়গায় পুনর্বাসিত করা। (২) বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করা। (৩) স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার ব্যবস্থা করা। (৪) অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তাদের স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখায় সহায়তা করা, উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা। তরুণ যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এখানকার সুনীল রবিদাস, কানাই রবিদাস, রাজকুমার রবিদাস প্রমুখ জানান তাদের এখানে ১০০ জনের মতো লোকসংখ্যা আছে। তারা সকলেই ভূমিহীন গতরখাটা লোক। পেশা হিসেবে জুতা সেলাই হলেও তা সকলের এ কাজের মাঝে যুক্ত থাকতে পারছে না। এ পেশায় এখন আর সংসার চলার মতো আয় রোজগার থাকে না। এখানে তারা অনেক পরিত্যাক্ত অবস্থায় জীবনযাপন করছে। নদীভাঙনের শিকার হয়ে পড়ার মতো এই ২২টি রবিদাস পরিবার নির্দিষ্ট জায়গায় পুনর্বাসিত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে, এমন জরুরি তাগিদ বহন করছে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হিসেবে রবিদাস জনগোষ্ঠী সংখ্যা বাংলাদেশে কম নয়। ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রয়েছে তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। লেখক : সদস্য, সিপিবি, মৌলভীবাজার জেলা

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..