কোটা পদ্ধতির সংস্কারই সময়ের দাবি
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও লেখক জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পটার প্রাসঙ্গিকতা সারা জীবনভর নানাভাবে মানুষের কাছে থেকে যাবে। যদিও গল্পটা মুক্তিযুদ্ধের। একজন যুবকের কাছে জানতে চওয়া হয়েছিল, কেন সে যুদ্ধে এসেছে। উত্তর ছিল- সময়ের প্রয়োজনে।
সময়ের প্রয়োজনেই মানুষ তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিত হয়; ভবিষ্যৎ নির্মাণের তাগিদে রাস্তায় নামে। যেমন এখন সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে। যা সামনের দিনগুলোতে হয়ত আরো শক্তিশালী হয়ে উঠার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আবার সরকারি চাকরিতে কোটার পক্ষের শিক্ষার্থীরা বলছেন, এ নিয়ে যা বলার আদালতই বলবে। কিন্তু দুপক্ষই কী আসলে সঠিক অবস্থান নিচ্ছে?
কোটা পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষের আন্দোলন এবারই প্রথম হচ্ছে এমন না। এর আগেও এ নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কোনো কোটা রাখা যাবে না- আন্দোলনকারীদের এমন দাবি মেনে নিয়েছে। কিন্তু তাতে কি সমস্যার সমাধান হয়েছে? হয়নি যে, তার প্রমাণ তো এই যে, এখন আবার একই দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামতে হচ্ছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এর সমাধান কোথায়? সমাধান হচ্ছে, ‘সময়ের প্রয়োজনেই’ এখন কোটা পদ্ধতিকে সংস্কার করতে হবে। স্বাধীনতার পর সরকারি চাকরিতে যে কোটা ছিল, আজকে তা নেই। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক বেশি কোটা ছিল। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে তাদের চেতনায় নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেটির সংস্কার হয়েছে। তাহলে এখন সংস্কার হতে দোষ কোথায়? কার স্বার্থে সেটি সংস্কার করে যুগপোযোগী করা হচ্ছে না?
মুক্তিযোদ্ধার জন্য কোটা রাখাটা অযৌক্তিক কিছু না। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানজনক ভাতা দিচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাকে এই বিশেষ সম্মান দেওয়া হয় তিনি যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করবে এমন কোনো কথা নেই। ফলে তার জন্য কোটার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? তবু সেটা রাখা যেতে পারে। তবে অবশ্যই সেটা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যার অনুপাতে হওয়াই উচিত। এটা করা উচিত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান রক্ষার স্বার্থেই। নাহলে এমন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পক্ষ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আরও বেশি করে বিদ্বেষ তৈরির সুযোগকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এদেশে যারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি বলে পরিচিত তারা অবধারিতভাবে পিছিয়ে পড়া নারী বা প্রান্তিক অবস্থানে থাকা আদিবাসীদের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা রাখতে চাইবে না- এটাও সত্যি। যদিও এরা এটা বলতে চাইছে। কিন্তু পিছিয়ে পড়া নারী আর জাতিসত্ত্বার জন্য কোটা সুবিধা না রাখলে তারা পিছিয়েই থাকবে। সমাজকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। ফলে কোটা পদ্ধতির সংস্কার না হওয়াটা মুক্তিযোদ্ধা, নারী, আদিবাসী সবাইকেই পিছিয়ে দেবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ইতিহাস বলছে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল বাংলাদেশে। তার মাঝে ৩০ শতাংশই ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা। কিন্তু দেশের দুই থেকে আড়াই লাখ মুক্তিযোদ্ধার জন্য আসলে কত শতাংশ কোটা প্রয়োজন? এই হিসাব করা দুরূহ কোনো ব্যাপার নয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেটা সংস্কার করলে চার থেকে পাঁচ শতাংশের বেশি হবে না।
কিন্তু সরকার কোটাবিরোধী আন্দোলনের দাবি মানতে গিয়ে গোটা কোটা পদ্ধতিই তুলে দিল। এতে করে কি ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ৫ শতাংশ কোটা ছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য এবং এক শতাংশ কোটা ছিল প্রতিবন্ধীদের জন্য তারা বঞ্চিত হল না? এটা ছিল সরকারের অপরিমাণদর্শী সিদ্ধান্ত।
২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরে পাবার জন্য উচ্চ আদালতে রিট করেন এবং চলতি বছরের ৫ জুন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট।
তারপর হাইকোর্টের ওই রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এর শুনানি শেষ হয়নি। ফলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাই কোর্টের এই রায় স্থগিত না করায় পূর্বের নিয়মানুযায়ী সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আপাতত বহাল রয়েছে ।
আন্দোলনের এই অবস্থায় সরকারের উচিত সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে, একটি টাস্কফোর্স গঠন করে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের মাধ্যমে চলমান সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু সমাধান নিশ্চিত করবে।
কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। এখন এই মুক্তিযুদ্ধের নামে এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয় যাতে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা যুগের পর যুগ ধরে বৈষম্যের শিকার হন। কোটার দরকার আছে, কিন্তু সেটি যেন প্রকৃত মেধাকে ছাপিয়ে না যায়। মেধাকেও যেন আরও বেশি সুযোগ দেওয়া হয়। নাহলে সেটিও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার থেকে দূরে সরে যাওয়া।
আর এর সুযোগ নিয়ে ঘাপটি মেরে থাকা মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা যেন আবার তাদের দাঁত-নখ খিঁচানোর সুযোগ না পায়- সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
Login to comment..