লুটপাটের এ সমাজ ভাঙতেই হবে#
আহমেদ মিঠু
দেশে দীর্ঘকাল ধরেই দুর্নীতি নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। ব্রিটিশ, পাকিস্তান কিংবা তারও আগের ইতিহাস বাদ দিলেও স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু থেকেই ঘুস, কালোবাজারি, মজুদদারি, দখল বাণিজ্যসহ অনৈতিক নানা পন্থায় একশ্রেণির মানুষের ফুলেফেঁপে উঠার প্রবণতা প্রায় প্রকাশ্য রূপ লাভ করে। সেই পথ ধরেই পরবর্তীতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া, সরকারের সম্পত্তি আত্মসাৎ, তহবিল তছরুপ ও জোরপূর্বক দখল, চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, মানবপাচার, বিদেশি মুদ্রার অবৈধ ব্যবসা, আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং, বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পে কমিশন বাণিজ্য দ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও সিন্ডিকেট গঠনসহ নানা কায়দায় গণ-লুটপাট রাষ্ট্র ও সমাজে ব্যাপক মাত্রা লাভ করেছে।
লাগামছাড়া এই দুর্নীতির মূল উৎস আসলে বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পদ গড়াই মূল লক্ষ্য হওয়ায় এমনিতেই দুর্নীতি একটি মৌলিক সমস্যা। তার ওপর কোনো দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি দুর্বৃত্তায়িত হয়ে পড়লে নীতি-নৈতিকতা বলে আর কিছু থাকে না। বাংলাদেশেও এখন চলছে সেই অবস্থা। একদিকে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রূদ্ধ হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে চলছে বহুমাত্রিক লুটপাটের চর্চা। ফলে দেশের সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও সম্পদ কিছু লোকের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আর বেশিরভাগ মানুষের জীবনযাপনের ব্যয় বাড়ছে, আয় কমছে। তারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ন্যায়বিচারসহ সবকিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে নানাভাবে উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ হারকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে বড় রকমের অগ্রগতি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে ব্যয় করা হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বলা হয়েছে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছে। এর বিনিময়ে জনগণের সব রকম অধিকার খর্ব করা হয়েছে। ভোটাধিকার হরণ করে গণতন্ত্রকে করা হয়েছে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। একের পর এক একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করা হয়েছে।
দেশের বাম প্রগতিশীল শক্তি শুরু থেকেই উন্নয়নের নামে গণতন্ত্র হরণের এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্ব ও ও জবাবদিহি ছাড়া উন্নয়ন যে লুটপাটের হাতিয়ারে পরিণত হবে, সে বিষয়েও বারবার সতর্ক করেছিল। লুটেরা ব্যবস্থা বজায় রেখে উন্নয়ন যে কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত হতে পারে, গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রিত অবস্থার মধ্যেও বিভিন্ন সময়ে তা সামনে এসেছে। উন্নয়ন প্রকল্প, সরকারি কেনাকাটা থেকে দুর্নীতি, ঘুস, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, দখল লুটপাটের এমন কোনো ধরন নেই যা বেরিয়ে আসছে না। একই সময়ে দুর্নীতির এত রূপ আগে কখনো দেখা গেছে বলে মনে হয় না।
সর্বশেষ সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ, প্রতাপশালী আইজিপি বেনজীর আহমেদ এবং কাস্টমস কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সীমাহীন দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। আরও অনেক কর্মকর্তার কথাও শোনা যাচ্ছে। গণমাধ্যমে কিছু কিছু রিপোর্টও আসছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে- এসব কর্মকর্তা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে নগদ অর্থ, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অস্বাভাবিক সম্পদ করেছেন। সরকারি চাকরিজীবীদের অবৈধ সম্পদ ও অর্থ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনেই তার বিধান আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এরকম কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপিত না হওয়ায় বেনজীর বা মতিউরও সাজা পাবেন কি না, তা নিয়ে জনপরিসরে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। বেনজীর আহমেদ যে দুর্নীতি করেছেন তার প্রমাণ তিনি নিজেই দিয়েছেন। গণমাধ্যমে অভিযোগ আসার পরপরই তিনি সপরিবারে বিদেশে পালিয়েছেন, সাহস নিয়ে দুদকের ডাকে সাড়া দেননি।
আসলে অতীতে দুর্নীতিবাজ কিংবা কালো টাকার মালিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় তারা আইন ও বিচার ব্যবস্থার তোয়াক্কা করেন না। তারা জানেন, মাঝেমধ্যে ছোটখাটো ধাওয়া দিলেও বর্তমান শাসনব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেবে না। এ কারণেই দেশে ধারাবাহিকভাবে কালো টাকার দাপট বেড়েই চলেছে। সরকারি কেনাকেটা, জনবল নিয়োগ, প্রকল্প গ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থাই নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি বিভিন্ন সময়ে সহজ শর্তে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হলেও তা গ্রহণে আগ্রহী হননি অবৈধ অর্থের মালিকরা। বরং সমাজ, রাজনীতি ও ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় তাদের কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন বৈধ উপার্জনকারী ও নিয়মিত করদাতারা।
২০১১ সালে ‘বাংলাদেশের অপ্রকাশ্য অর্থনীতির আকার: একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ’ শিরোনামে সমীক্ষা করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। সেই সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালে দেশে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৭ শতাংশের সমান। সেখান থেকে ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১০ সালে জিডিপির ৬২ দশমিক ৭৫ শতাংশে দাঁড়ায়।
কালো টাকার বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ধারাবাহিক গবেষণা করছেন অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদ ফ্রেডারিক স্নাইডার। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ‘শেডিং লাইট অন দ্য শ্যাডো ইকোনমি: আ গ্লোবাল ডেটাবেইস অ্যান্ড দ্য ইন্টারঅ্যাকশন উইথ দ্য অফিশিয়াল ওয়ান’ শিরোনামে একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন তিনি। এতে ১৫৭টি দেশের তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ২৭ বছরে বাংলাদেশে কালো টাকার গড় হার ছিল জিডিপির ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ। সর্বশেষ গত ৩ জুন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ‘বিকল্প বাজেট প্রস্তাব ২০২৪-২৫’-এ বলা হয়েছে, ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত ৫০ বছরে পুঞ্জীভূত কালো টাকার পরিমাণ ১ কোটি ৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তাদের হিসাবে প্রতি বছর গড়ে জিডিপির ৩৩ শতাংশ টাকা অপ্রদর্শিত থেকে যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরে জিডিপির আকার হবে ৫০ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। গবেষকদের অভিমত অনুযায়ী এক-তৃতীয়াংশ (৩৩ শতাংশ) কালো বা অপ্রদর্শিত থাকলে তার মোট পরিমাণ ১৬ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
দুর্নীতি ও সামাজিক রীতির মধ্যে একটি দুষ্টচক্র কাজ করে। দুর্নীতিকে যদি প্রাথমিক স্তরেই আটকে না ফেলা যায়, যদি তা ব্যাপক হয়ে ওঠে, তখন তা সামাজিক রীতি বা নীতিতে রূপান্তরিত হয়। আমাদের দেশে সেটাই ঘটেছে। দুর্নীতিই হয়ে উঠেছে কর্মসংস্কৃতি। দেশের সুশৃঙ্খল সামাজিক নিয়ম বা রীতি, যা হয়তোবা দেশের কড়া আইন ও তার যথোপযুক্ত প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শাস্তি পাওয়ার ভয় না থাকলেও মানুষকে দুর্নীতিমূলক কাজ থেকে বিরত রাখে। কিন্তু বাংলাদেশ যেভাবে চলছে তাতে বেনজীরের মতো কর্মকর্তারা নিজেদের রাষ্ট্রের মালিক মনে করেন, তারা নিজেদের মতো করে আইনের তোয়াক্কা না করে চলেন এবং সেভাবেই ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে চাঁদা তোলেন, ঘুস খান, দখলবাজি করেন। দুর্নীতিবাজরা নিজেরাই যখন ক্ষমতার কেন্দ্র দখল করে থাকে তখন অনিয়ম, দুর্নীতি আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রতি সামাজিক অনুমোদনের পথ তৈরি হয়। বাংলাদেশে ব্যক্তিগত সম্পদ ও ভোগের প্রতিযোগিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দুর্নীতিবাজরাই এখন সমাজে বেশি সমাদৃত।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও রাষ্ট্রের প্রশ্রয়েই সমাজের সর্বত্র দুর্নীতিবাজদের প্রবল দাপট তৈরি হয়েছে। নানা কারণে মাঝেমধ্যে ধরপাকড়, অভিযান কিংবা দু-চারজনের শাস্তি হলেও বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা বহাল রেখে সার্বিকভাবে পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারসহ রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত সমাজে দুর্নীতিবাজদের এই দাপট চলতেই থাকবে।
প্রকৃতপক্ষেই দুর্নীতি ও লুটপাটের শিকড় উপড়ে ফেলতে হলে জনগণের ব্যাপক জাগরণের মধ্য দিয়ে শাসনব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের বিকল্প নেই। মূল কথা হলো, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রগতিশীল রূপান্তর ছাড়া দুর্নীতি, লুটপাট ও বৈষম্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব হবে না। #
প্রথম পাতা
আশা-নিরাশার বর্ষবরণ
‘রঙ্গ’
চাল-আটাসহ বাড়তি দাম সবজির
রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের একযুগ, শ্রমিকের জীবন...
শ্রমিকনেতা আবু তাহেরের মুক্তি দাবি সিপিবির
তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার ব্যবসায়ীদের তোষণ করছে
নির্বাচন নিয়ে বিলম্ব দেশকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে
লেনিনের একটি দিন
সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই এখনও শেষ হয়নি
সরকারের বোরো ধান সংগ্রহ ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করবে
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করে বিনিয়োগকারীদের লাগাম টানার চেষ্টা করছে সরকার
Login to comment..