কবি সাহিত্যিকরা কখনো সমাজকে বাদ দিয়ে প্রগতিশীল চিন্তার বিকাশ ঘটাতে পারেনা। তাকে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হলে কখনো সমাজ বিচ্ছিন্ন হলে চলবে না। তাঁর কবিতার শরীরে ও মর্মে উৎকীর্ণ হবে জনগণের মধ্যে জীবনের প্রতি ভালবাসা জাগ্রত করা, বিপ্লবে বিশ্বাসী করে তোলা এবং বিপ্লবের পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলা। “বাঙলা কবিতায় যে সংগ্রামী ধারার সূচনা করেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সে ধারা পরিশীলিত রূপ লাভ করেছিল সুভাষ মুখোপধ্যায়, সে ধারার পরিণতি লক্ষ করি সুকান্ত ভট্টাচার্যে”। এ ধারা গণমানুষের মুক্তির ধারা। কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে আর দশটা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভাব অনটন সুঃখ-দুঃখকে সাথী করে নিয়ে বড় হয়েছেন কবি সুকান্ত। শৈশবেই তাই তার কবিতায় খেটে খাওয়া মানুষের কথায়বাঙ্গময় হয়ে উঠেছে। ধনিক শ্রেণীরদ্বারা শ্রমিক, মজুর খেটে খাওয়া মানুষের রক্তশোষণ দেখে শুনে সুকান্ত প্রতিবাদ মুখরিত হয়েছেন। তাই তার কবিতা কালের গন্ডি অতিক্রম করে সর্বকালের সর্বহারা মানুষের আশার আলোক-বর্তিকা হয়ে যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে পড়া মানুষকে পথ দেখাবে। দুনিয়ার ধনী শ্রেণি গরীবদের প্রতি অন্যায়- অবিচারে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি লিখেছিলেন-
“বলতে পারো বড় মানুষ মোটর কেন চড়বে?
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাঁপা পড়বে?
বড় মানুষ ভোজের পাতে ফেলে লুচি মিষ্টি
গরীবরা পায় খোলামকুচি এক অনাসৃষ্টি?” (পুরানো ধাঁধাঁ)
দেশের অত্যাচারিত শোষিত মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম দরদ। তাঁেদর ব্যথায় ব্যথিত হয়েছেন তিনি শীতের রাত্রিতে গরম কাপরের অভাবে। গুটিসুটি হয়ে কত দুঃখে, কত কষ্টে রাত কাটায় আমাদের দেশের গণমানুষেরা। সারারাত প্রতিক্ষায় থাকে সকালের এক টুকরো রোদ্দুরের। তাই তো রাস্তার ধারে উলঙ্গ ছেলেটাকে প্রচন্ড শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে দেখে তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না, এই সব মানুষের জন্য এই সব মানুষের সারিতে দাড়িয়েই কবি সূর্যের কাছে আকুল প্রার্থনা জানালেন এক টুকরো আলো রোদ্দুরের, একটু খানি উত্তাপের।
আকুল হয়ে বলে ওঠেন-
“হে সূর্য!
তুমি আমাদের স্যাঁতস্যাতে ভিজে ঘরে
উত্তাপ আর আলো দিও
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।” (প্রার্থী)
সুকান্তের কবিমন বিশ্বের এই হাহাকার দেখে ব্যক্তিগত জীবনানুভুতির মধ্য দিয়ে এবং ছন্দোবদ্ধসুরে প্রতিবাদের ভাষায় তিনি উপস্থাপিত করেছেন বিশ্বের মানুষের কাছে যা যুগ থেকে যুগাতীতের আবেদন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। সহানুভুতির মন নিয়ে কবি সুকান্ত পৃথিবীকে দেখেছেন এবং মূল্যায়ন করেছেন। সংসারে অভাবের কোন শেষ নেই, ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা। পৃথিবীর বুকে নিত্য ঘটে চলছে হাজারো ব্যাভিচার। এই ব্যাভিচার তিনি নীরবে সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ করেন। “একটি মোরগের কাহিনী” কবিতায় আমরা সুকান্তের সহানুভুতির গভীরতা সম্যক উপলদ্ধি করতে পারি-
“প্রাসাদের ভিতর রাশি রাশি খাবার।
তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল,
একেবারে সোজা চলে এল
ধপধপে সাদা দামী কাপড়ে ঢাকা খাবার টেবিলে।
অবশ্য খাবার খেতে নয়
খাবার হিসেবে।”
গণমানুষের একান্ত কাছের মানুষ সুকান্ত। গণমানুষের জন্য ছিল তার অপরিসীম দরদ। এ জন্যই তিনি সামিল হন গণমানুষের মুক্তির পতাকা তলে। তিনি প্রশ্ন করেন “আমি কবি বলে নির্জনতা প্রিয় কবি হবো, আমি কি সেই ধরনের কবি?
যুদ্ধ, মহামারী সম্রাজ্যবাদী শাসন- শোষণ কবির মনকে করেছিল বিক্ষুব্দ- আর এই বিক্ষুব্দ মনের বহিঃ প্রকাশই হয়েছে কবির অসংখ্য কবিতায়। অত্যন্ত প্রত্যয়ী কন্ঠে পৃথিবীর সব অবাঞ্চিত জঞ্জাল মুক্ত করার দীপ্ত সংকল্প ব্যক্ত করছেন এবং এ বিশ্বকে গণমানুষের বাসের উপযোগী করে তোলার জন্য দৃপ্ত শপথ নিয়েছেন-
“চলে যাবো- তবু আজ যতক্ষন দেহে আছে প্রাণ
প্রানপণে পৃথিবীর সবার জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।” (ছাড়পত্র)
জনতার মুক্তির জন্য কবি সুকান্ত পুজিঁবাদী আর সম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামী আগুন জে¦লে এক বৈপ্লবীক পরিবর্তনের দ্বারা সাম্য ও সমাজতন্ত্রের লাল ঝান্ডা ওড়াতে মার্কসবাদকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন এবং নিজেকে একজন সাচ্চা কমিউনিষ্ট হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শ্রমিক, কৃষক মেহনতি মানুষের সংগ্রাম সফল হবেই। কারণ এ সংগ্রাম শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের। শোষকের বিরুদ্ধে সাইরেণ তুল্য হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন-
“শোনরে মালিক, শোনরে মজুতদার।
তোদের প্রাসাদে জমা হলো কত মৃত
মানুষের হাড়-।
হিসাব দিবি কি তার?”
শুধু কৈফিয়ত নয়-প্রতিশোধের অনির্বাণ শপথ নিয়েছেন-
“আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই,
স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের
চিতা আমি তুলবই।”
“বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?
এস তরে আজ বিদ্রোহ করি,
আমরা সবাই যে যার প্রহরী
উঠুক ডাক।”
কবির সমস্ত কাব্য সাধনার সাথেই মিশে আছে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
“দেখাব উপরে আজো আছে কারা
খসাবো আঘাতে আকাশের তারা,
সাড়া দুনিয়াকে দেবো শেষ নাড়া
ছড়াবো ধান।
জানি রক্তের পিছনে ডাকবে সুখের বান॥” (বিদ্রোহের গান)
সুকান্ত শ্রেণি-সংগ্রামের কথাই বলেছেন। জীবনের প্রথম শুভ যাত্রারম্ভের লগ্নেই কবি প্রতি পদক্ষেপে অনুভব করেছেন লক্ষ লক্ষ সর্বহারা মানুষের দুঃখ বেদনা এবং গণমানুষের দুঃখ বেদনাকে সাথে নিয়েই তাদের মুক্তির লক্ষ্যে অবিচলিতভাবে কাজ করে গেছেন। মাটির মানুষের কাছাকাছি থেকে চলমান বিশ্বের শ্রেণি সংগ্রামকে তরান্বিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। সুকান্তকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে মার্কসবাদ-লেলিনবাদ ও ভারতবর্ষের সাম্যবাদী আন্দোলনকে সঠিকভাবে বুঝতে হবে।
কবি সুকান্ত ছিলেন গণমানুষের মুক্তির মন্ত্র সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত সাধারণ মানুষের কবি, মেহনতি মানুষের কবি। তাই সমাজের অস্পৃশ্য, অবহেলিত চাষী-কুলি-মজুর-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের জীবন গাথা সুকান্ত কাব্য। সেই সব মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে কবিতাকে ব্যবহার করেছেন হাতিয়ার রূপে। লেনিন ছিল আদর্শ, তাই তিনি নিজেই বলেছেন-
“লেনিন ভুমিষ্ট রক্তে ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ,
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।”
সুকান্ত চেয়েছিলেন আমাদের সমাজ ব্যবস্থার নবরূপায়ন। গণমানুষের এ বিশ্বকে সকল মানুষের বাসযোগ্য করে তোলার জন্য তিনি ছিলেন নিরন্তর প্রয়াসী।
তাই জগদীশ ভট্টাচার্য তার মৃত্যুর পরেও যথেষ্ঠই লিখেছেন- “যে কবির বাণীর শোনার জন্য কবিগুরু কান পেতে ছিলো সুকান্ত সেই কবি। সৌখিন মজদুরি নয়, কৃষাণের জীবনের সে ছিল সত্যিকার শরীক, কর্মে ও কথায় তাদেরই সঙ্গে ঘনিষ্ট আত্মীয়তা ছিল তার, মাটির রসে গন্ধে পুষ্টে তার দেহমন। মাটির বুক থেকে সে উঠে এসেছিল। ব্যক্তি জীবনে সুকান্ত একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। কবি সুকান্ত যে আদর্শের কথা বলে গেছেন তা পৃথিবীর সমস্ত মতবাদের চেয়েও প্রাচীন, সমস্ত আর্দশের চেয়েও বড়।”
বিজ্ঞানে যার বিশ্বাস আছে তিনি এই পরিবর্তনের ধারাকে অস্বীকার করতে পারেন না। ইতিহাস থেকে আমাদের শিখতে হবে এ আদর্শ দুনিয়ার দেশে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশেও প্রতিষ্ঠিত হবে। গরীব মানুষের মুক্তি আসবেই।