পরিবেশ রক্ষার নাম করেও শোষণ চালাচ্ছে প্রথম বিশ্ব
অনন্য চক্রবর্তী
মিশরের শার্ম আল-শেখে গত বছর নভেম্বর মাসে শেষ হলো জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বর্ণাঢ্য সম্মেলন কপ-২৭। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর চাপে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল তৈরি করে গরিব দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছে প্রথম বিশ্বের দেশগুলো। এই তহবিলের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও পরিবেশ ধ্বংস করার প্রত্যক্ষ দায় প্রথম বিশ্বের দেশগুলো একরকম মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে, এ তৃতীয় বিশ্বের জন্য নিঃসন্দেহে খুশির খবর। সঙ্গে সঙ্গে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ‘জাস্ট ট্রানজিশন’, যা নিয়ে ২০২১ সালের কপ-২৬ সম্মেলনে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হয়।
‘জাস্ট ট্রানজিশন’ বা ন্যায়সঙ্গত পরিবর্তন তৃতীয় বিশ্বের বহুদিনের দাবি। প্রথম বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শোষণের কারণে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিল্পের বিকাশ ঘটেনি। ফলে কয়লার মত সস্তা কার্বনজাত জ্বালানির ওপর তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশ নির্ভর করে। আমরা সবাই জানি, কয়লা জ্বালানো পরিবেশের বিপুল ক্ষতি ডেকে আনে। তাই রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রত্যেকটা দেশকে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে এনে সৌরবিদ্যুতের মত পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদন করতে অনুরোধ করেছে। সবচেয়ে বেশি পরিবেশ ধ্বংসকারী প্রথম বিশ্বের দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে- যাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর সিকি ভাগও নয়- ফসিলজাত জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করতে জোর করছে। কিন্তু, পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদনের রসদ ও গবেষণার পরিকাঠামো প্রধানত প্রথম বিশ্বের বেসরকারি সংস্থাদের হাতে, যারা ব্যবসার স্বার্থে খুব স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো উঁচু দরে বাজারে বিক্রি করে। ফলে বেশিরভাগ সময়ে এই সমস্ত সম্পদ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার গরিব দেশগুলোর নাগালের বাইরেই থেকে যায়। নাগালে এলেও সেগুলো আসে বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের নানা শোষণমূলক শর্তসমেত, যা দেশগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ওয়াশিংটন কনসেন্সাসের দেখানো পথে চলতে বাধ্য করে। তাই ফসিলজাত জ্বালানি থেকে পরিবেশবান্ধব শক্তি ব্যবহারে উত্তরণের জন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো প্রথম বিশ্বের থেকে আর্থিক সাহায্য দাবি করছে, যাতে তাদের অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্বের ওপর অনৈতিক চাপ না পড়ে। সব শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষিত রেখে নতুন ‘গ্রিন জবস’-এর জন্য তাঁদের উপযুক্ত করে তোলা এর অন্যতম লক্ষ্য। ‘জাস্ট ট্রানজিশন’ শুধু অর্থনৈতিক দাবি নয়, পরিবেশ সংকটের আবহে মার্কিন দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তৃতীয় বিশ্বের উঠে দাঁড়ানোর লড়াইও। এতে প্রথম বিশ্বের গাত্রদাহ হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মাস দুয়েক আগে যৌথভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ‘জয়েন্ট এনার্জি ট্রানজিশন পার্টনারশিপ’ শুরু করেছে, যার মূল লক্ষ্য দক্ষিণ আফ্রিকায় কার্বনের ব্যবহার কমিয়ে পরিবেশবান্ধব পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির- বিদ্যুৎ, গ্রিন হাইড্রোজেন ও নতুন শক্তিচালিত যানবাহন ইত্যাদি- পরিকাঠামো তৈরি করা। ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের এই গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে প্রথম বিশ্বের এই দেশগুলোর আর্থিক সহযোগিতায়। পাঠক এতদূর পড়ে ভাবতেই পারেন, পরিবেশ দূষণ আর প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাওয়া রুখতে এ তো ভালো পদক্ষেপ। প্রথম বিশ্ব অবশেষে তার ঐতিহাসিক ভুলগুলো স্বীকার করে ভুল শোধরানোর চেষ্টা করছে। এ নিয়ে আবার সমালোচনা করার কী আছে?
কিন্তু বিষয়টা অত সরল নয়। সাংবাদিক তনুপ্রিয়া সিংহের লেখায় এই চুক্তির এক অন্য দিক দেখতে পাওয়া যায়। দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড় শ্রমিক ইউনিয়ন, ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মেটালওয়ার্কার্স অফ সাউথ আফ্রিকা (NUMSA)-র নেতাদের বক্তব্য, এ প্রকল্প দক্ষিণ আফ্রিকার তামাম শ্রমজীবী মানুষের প্রতি এক চরম বিশ্বাসঘাতকতা। কারণ রাষ্ট্রপতি সিরিল রামাফোসার সাধের জাস্ট ট্রানজিশন তাঁদের দেশকে বেশি করে নয়া উদারবাদের রাস্তায় এগিয়ে নিয়ে যাবে। NUMSA বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে সরকারি সম্পদের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে দেশের শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করে চলেছে। তাঁরা বলছেন, বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার ৫৫ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যের অন্ধকারে ডুবে রয়েছেন, ৪৬ শতাংশ বেকার। এই অবস্থায় জয়েন্ট এনার্জি ট্রানজিশন পার্টনারশিপের ফলে কয়লা শিল্পের উপর নির্ভরশীল অসংখ্য শ্রমিকের ভবিষ্যৎ গভীরভাবে অনিশ্চিত হয়ে যাবে বলে তাঁরা মনে করছেন। তাছাড়া এই প্রকল্পের আর্থিক বরাদ্দের মাত্র চার শতাংশ ‘গ্রান্ট’ বা আর্থিক সাহায্য হিসেবে প্রথম বিশ্ব থেকে আসবে; ৮১ শতাংশই হবে ঋণ, যা চড়া সুদে শোধ দিতে হবে। এত দেনা শোধ করতে গিয়ে সরকার সামাজিক কল্যাণমুখী প্রকল্পগুলোতে অর্থ বরাদ্দ কমাবে, আর গরিব মানুষের কষ্ট কয়েকগুণ বাড়বে। সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, প্রকল্পের ৯০ শতাংশ টাকা খরচ হবে পরিকাঠামো উন্নয়নের খাতে। কিন্তু কারিগরি প্রশিক্ষণ- যা কয়লানির্ভর শ্রমিকদের নতুন পরিবেশবান্ধব শিল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়, তার জন্য বরাদ্দের পরিমাণ এক শতাংশও নয়। ফলে এই প্রকল্পে রূপান্তর হলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক রাতারাতি কাজ হারাবেন। পেট চালাতে অসংগঠিত ক্ষেত্রে আরও শোষণমূলক কাজ করতে বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা অনিশ্চয়তার অন্ধকূপে ডুবে যাবেন। জাস্ট ট্রানজিশন সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রকে সম্পূর্ণ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার সেই ওয়াশিংটন কনসেন্সাস-এর পথেই অগ্রসর হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ কোনোমতেই শেষ হয়নি, শুধু মুখোশ পাল্টেছে। রামাফোসা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এক নিষ্ঠাবান যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিদ্যুৎ ঘাটতি আকাশছোঁয়া। এরই মধ্যে রামাফোসা সরকার সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারি সংস্থা ESKOM-কে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত করছেন। NUMSA-র নেতারা বলছেন, ESKOM সরকারি সংস্থা হওয়ায় তাঁরা কিছুটা হলেও আশাবাদী হতে পারতেন এই ভেবে যে সমস্ত শক্তি উৎপাদন প্রকল্পে সাধারণ শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি ঢেলে জাস্ট ট্রানজিশন প্রকল্প প্রথম বিশ্ব থেকে বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য জমি শিথিল করবে। ESKOM শুধুমাত্র বিদেশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকে দেশের সমস্ত পাওয়ার গ্রিড ব্যবহার করার কাজে সাহায্য করবে, কিন্তু সাধারণ মানুষকে কম খরচায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থার কথা এই প্রকল্পে কোথাও বলা নেই। বলাই বাহুল্য, বেসরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলো নিজেদের মুনাফা বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো স্বার্থে কাজ করবে না। স্বাভাবিকভাবেই এই সমস্ত সংস্থায় যেসব শ্রমিক কাজ করবেন, তাঁরা না পাবেন চাকরি আর মজুরির সুরক্ষা, না পাবেন ইউনিয়ন করার অধিকার। অসীম রায়, বেনি কুরুভিল্লা ও অঙ্কিত ভরদ্বাজ তাঁদের ২০১৯ সালের গবেষণাপত্রে ভারতবর্ষের শ্রমিকদের সুস্থ জাস্ট ট্রানজিশন-এর ক্ষেত্রে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থা আর শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ভূমিকাকে প্রধান গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার মত ভারতেও বেসরকারিকরণ যজ্ঞ চলছে। নয়া উদারবাদের কাছে ঘাড় নোয়ানো পরিবেশ সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এক মহাবিলুপ্তির মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা। এই যেনতেন প্রকারেণ মুনাফাকেন্দ্রিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থাই যে এই বিপদের জন্য দায়ী- এ নিয়ে খুব একটা দ্বিধা নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জাস্ট ট্রানজিশন-এর পথে এগোতে চাইছে। সেই লক্ষ্যে তারা সবাই সফল হোক, এই কামনা করি। কিন্তু সব শ্রমিককে একসঙ্গে নিয়ে এগোনোর প্রতিশ্রুতি সরকারগুলো পূরণ করতে না পারলে সমস্যা আরও বাড়বে বলেই মনে হয়।
অভিমত
মব, মোবাইল-আগামীর প্রশ্ন
Login to comment..