শহীদ কমরেড হীরালাল দাসগুপ্ত

মুস্তাফিজুর রহমান মিলন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

কেউ যদি কখনো প্রশ্ন করে পটুয়াখালী জেলায় বাম প্রগতিশীল আন্দোলন এবং সংগঠন গড়ে তোলার প্রথমাবস্থায় কারা ছিলেন? নির্দ্বিধায় নিঃসংকোচে অনেকের নামের সঙ্গে যে নামটি সর্বাগ্রে উঠে আসবে তিনি হলেন শহীদ কমরেড হীরালাল দাসগুপ্ত। ১৯৭১ সালের ৭ জুন পাক হানাদার বাহিনী তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বরিশাল ইউনিটের পক্ষ থেকে পটুয়াখালীতে পার্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল স্মরণীয়। ১৯০৫ সালে বরিশাল ভারুকাঠী গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। হীরালাল দাসগুপ্তের কিশোর বয়সে তাঁর পিতা উমেশ চন্দ্র দাসগুপ্ত ওকালতি করতে পটুয়াখালী চলে আসেন এবং এখানে স্থায়ীভাবে থেকে যান। তাঁর শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয় বরিশাল ও জামালপুরে। ১৯২৬ সনের দিকে জামালপুর হাইস্কুলে থকে তিনি এন্ট্রান্স পাস করেন। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি জড়িত হন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং অনুশীলন চক্রের সদস্য হন। বরিশালে থাকাকালীন মাত্র ১৪ বছর বয়সে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার দায়ে ১৯১৯ সনে প্রথম গ্রেফতার হন। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় তিনি সাজা থেকে রেহাই পান। ১৯৩০ সনে বরিশালে জ্যোতি দারোগা হত্যা মামলায় আবার গ্রেফতার হন। লাহোর, পাঞ্জাব, দেউলি ও বকসা কারাগারে ৭ বছর জেলজীবন অতিবাহিত করেন। জেলে অবস্থানকালীন তিনি বি.এ, বি.এল, পাস করেন। ১৯৩৭ সনে অন্যান্য রাজবন্দীর সাথে তিনি মুক্তি পান। জেলে থাকাকালীন তিনি সন্ত্রাসবাদী চিন্তা পরিত্যাগ করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদে দীক্ষিত হন। ১৯৩৮ সনে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন এবং কংগ্রেসে কাজ করতে থাকেন। ১৯৩৯ সনে কংগ্রেসের ত্রিপুরা অধিবেশনে সতীন্দ্র নাথ সেন যখন সুভাষ চন্দ্রের বিরুদ্ধে গান্ধী শিবিরে চলে যান তখন হীরালাল দাসগুপ্ত প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিগৃহীত কৃষক সমাজকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, এ ঘটনার পরপর হীরালাল দাসগুপ্তকে জেলা কংগ্রেসের সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ১৯৩৯ সনে বরিশাল জেলার কৃষক আন্দোলনের সত্যিই এক গৌরবোজ্জল বছর। এ বছরের শেষের দিকে বরিশাল শহরে একটি ভুখা মিছিল সংঠিত হয়। উত্তর বাখরগঞ্জের পাশাপাশি ০৩টি থানা, গৌরনদী উজিরপুর ও বাবুগঞ্জে খাবার কারণে চরম অনাহার দেখা দিয়েছিল। কৃষক সমিতি শহর অভিযানের ডাক দেয়। কমিউনিস্ট মিছিল সফল করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এ আন্দোলনে হীরালাল দাসগুপ্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ১৯৩৯ সনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে কমিউনিস্টদের উপর চরম নির্যাতন নেমে আসে। কমিউনিস্ট পার্টির অন্যান্য সদস্যের সাথে হীরালাল দাসগুপ্তও আত্মগোপনে চলে যান। আত্মগোপন অবস্থায় তিনি যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল নামে পিরোজপুর জেলার আমড়াজুরি এম,ই, স্কুলে শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। সে সময়ে বরিশালের ডি,আই,- ওয়ান বোথনাথ মুখার্জী ঐ স্কুলের কিছু ছাত্রের সাক্ষাৎ পান এবং তাদের মুখে তাদের শিক্ষক যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের ভুয়সী প্রশংসায় তার সন্দেহ হয়। ছাত্রদের তিনি কৌশলে আত্মগোপনকারী বিপ্লবীদের ছবি দেখিয়ে সন্দেহ নিরসন করেন এবং পরে হীরালাল দাসগুপ্তকে গ্রেফতার করেন। ১৯৪৩ সনে মন্বন্তরে তাঁর ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট লিউলিনের সঙ্গে এ ব্যাপারে অন্যান্যকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করতে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। এতে করে হীরালাল দাসগুপ্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তাঁর চিৎকারে লিউলিন সাহেব নেমে আসেন এবং তাদের কথা শুনে দুর্গতদের খাদ্য,বস্ত্র, ওষুধপত্র প্রভৃতির প্রয়োজন মেটাবার দায়িত্ব স্বীকার করেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে এ সময়ে বরিশালে জীবন রক্ষা সমিতি নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। যার উদ্যোক্তা ও নেতা ছিলেন হীরালাল দাসগুপ্ত। ১৯৪৪ সালে চাঁদসী ইউনিয়নের সাওড়া স্কুল ময়দানে জেলা কৃষক সমিতির পঞ্চম বার্ষিক সম্মেলনে হীরালাল দাসগুপ্তকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এ সময়ে বরিশাল জেলার মুলাদিতে মজুদদার ও হাটের ইজারাদারদের বিরুদ্ধে এবং ট্যাক্স মওকুফের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। এসব আন্দোলনে হীরালাল দাসগুপ্তের বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। ১৯৪৫ সনে ৬ষ্ঠ এবং ১৯৪৬ সনে ৭ম কৃষক সম্মেলনেও হীরালাল দাসগুপ্তকে কৃষক সমিতির সভাপতি নির্বাচন করা হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পর ‘ভারতের চর’ হিসেবে আখ্যায়িত করে শত শত কমিউনিস্টকে গ্রেফতার করে তাদের ওপর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। হীরালাল দাসগুপ্তও রেহাই পাননি। ১৯৪৯ সনে তিনি গ্রেফতার হন এবং দীর্ঘদিন বরিশাল ও ঢাকা জেলে আটক থাকার পর ১৯৫৪ সনের শেষের দিকে মুক্তি পান। এরপর থেকে তিনি স্থায়ীভাবে পটুয়াখালীতে সদানন্দ কর্মকার (বৃদ্ধি কর্মকার) এর বাড়িতে ও তার তত্ত্বাবধানে বসবাস করতে থাকেন। ১৯৫৮ সনে স্বৈরাচারী আইয়ুব ক্ষমতায় এলে তিনি বড় বাইশদিয়ায় চলে যান এবং সেখানে এ, কে হাইস্কুলে শিক্ষকতার কাজ নেন। এসময়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে কিন্তু জনতার মাঝ থেকে তাকে নিয়ো আসতে ব্যর্থ হন। ১৯৬৫ সনে তিনি বাউফলের মাধবদি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে গ্রেফতার হন। এসময়ে তার একটি পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বছরাধিককাল কারাভোগের পর তিনি ছাড়া পান এবং স্থায়ীভাবে পটুয়াখালী শহরে অবস্থান করেন এবং ঐ সদানন্দ কর্মকারের বাড়িতে থেকেই তিনি মার্কসবাদ লেনিনবাদের আদর্শ সম্পর্কে ছাত্র-যুবক ও কমিউনিস্ট কর্মীদের শিক্ষিত করে তোলা, কমিউনিস্ট পার্টির কাজকর্ম সম্পর্কে তাদের পরামর্শ দান এবং জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের উৎসাহিত করার কাজেই ব্যাপৃত থেকেছেন। চিরকুমার হীরালাল দাসগুপ্ত ছিলেন একজন তেজোদ্দীপ্ত ভোগবিলাসহীন খাঁটি কমিউনিস্ট। ১৯৭১ সনের ২৬ এপ্রিল পাক পানাদার বাহিনী কর্তৃক পটুয়াখালী দখল হলে অসুস্থ শয্যাশায়ী হীরালাল দাসগুপ্তকে পায়ে রশি লাগিয়ে ট্রাকের পিছনে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে ধরে নিয়ে যায় এবং পটুয়াখালী জেলে বন্দি করে রাখা হয়। এসময় প্রায় প্রতিদিনই তার ওপর বর্বর হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক নির্যাতন চলে। অবশেষে ১৯৭১ সনের ৭ জুন তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শহীদ কমরেড হীরালাল দাসগুপ্ত লাল সালাম। লেখক : সিপিবি নেতা

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..