দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে দেশে দেশে ফ্যাসিবাদের উত্থানের যে আশঙ্কা দেখা দেয় তা প্রতিহতের লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে তীব্র হয় ফ্যাসিবাদবিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন। পরাধীন ভারতবর্ষেও তার ঢেউ আছরে পরে। গড়ে ওঠে ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ। সেই প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস নিয়েই এ লেখা
একতা বিশেষ ফিচার :
গত শতাব্দীতে ত্রিশের দশকের সূচনা থেকেই অবিভক্ত বাংলায় মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীরা শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কমিউনিজমের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে থাকে। ইতোপূর্বে বিশের দশক থেকেই প্রধানত রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের প্রেরণায় কাজী নজরুল ইসলাম (সাম্যবাদে যাঁর নিজস্ব মনন-সমৃদ্ধ আস্থার একটি জোরদার ভিত্তি ছিল); নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় (যিনি বাংলা ভাষায় প্রথম ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাস অনুবাদ করেন); শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় (বাংলা কথা-সাহিত্যে শ্রমিকশ্রেণি যাঁর জন্য প্রথম সম্মানজনক স্থান করে নিতে পেরেছিল) প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকগণ সাম্যবাদী বা মার্কসবাদী মতাদর্শের মূল নির্যাসকে তাঁদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। ত্রিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রের সহিত্য সৃষ্টিতেও এর প্রভাব যথেষ্টই উপলব্ধি করা গিয়েছিল- যদিও এঁরা কেউই প্রচলিত অর্থে মার্কসবাদী বা কমিউনিস্ট ছিলেন না। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ বাংলা তথা ভারতবর্ষের বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত সমাজে সর্বপ্রথম ব্যাপকভাবে সোভিয়েত রাশিয়া সম্পর্কে আগ্রহ ও উদ্দীপনা বাড়িয়ে তোলে। ১৯৩১-৩২ সাল থেকে স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ ও বিপ্লবী নেতা ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (এবং অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকারও) ইউরোপ থেকে মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে দেশে ফিরে মার্কসীয় দৃষ্টিতে শিল্প, সাহিত্য ও সমাজতত্ত্ব বিশ্লেষণে অগ্রসর হন। পরে ‘সাহিত্যে প্রগতি’ (১৯৪৫) গ্রন্থে এগুলি সংকলিত হয়।
উনিশশো বিশের দশকে ম্যাক্সিম গোর্কির রচনা সেই সময় পরাধীন দেশের সাহিত্যিকদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফফর আহ্মদ তখন সদ্য-যুদ্ধ ফেরত হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতাকে কেন্দ্র করে সান্ধ্য নবযুগ-এর পৃষ্ঠায় নিপীড়িত মানুষের বেদনা ও বিক্ষোভকে নতুন ভাষায় প্রকাশ করলেন। শীঘ্রই আত্মপ্রকাশ করলেন জগদীশ গুপ্ত, হেমন্তকুমার সরকার, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো নতুন যুগের লেখকরা ‘সংহতি’, ‘আত্মশক্তি’, ‘বিজলী’, ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’, ‘লাঙ্গল’, ‘গণবাণী’, ‘নবশক্তি’, ‘বঙ্গবাণী’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় তাঁদের সৃজনশীল রচনাগুলিতে তুলে ধরলেন সমাজের নিচুতলায় মানুষের জীবন-যন্ত্রণা এবং রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের সদর্থক দিক।
ত্রিশের দশকের প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্যে সমাজ-বাস্তবতার সুস্পষ্ট আভাস দেখা যায় ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকায় শিবরাম চক্রবর্তীর ‘আজ ও আগামীকালে’র প্রবন্ধগুলিতে। মণীন্দ্রলাল বসু রচিত গল্পে (কিরণের কথা’) নায়কের মুখে এই উক্তি সেদিন আর অস্বাভাবিক মনে হয়নি : ‘‘শিল্পী কি শুধু রঙ নিয়ে খেলা, সুন্দরীর মুখ আঁকা? কুলীদের বস্তির কদর্যতা, চাষী-মজুরের কর্মজীবন, পতিতার বেদনাকে আমি মূর্ত করতে চাই।’’ বস্তুত ‘মজুর সাহিত্য’ সৃষ্টিতে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত পরিচালিত ‘কল্লোল’ পত্রিকার ভূমিকাও সেদিন ছিল উল্লেখযোগ্য—যদিও তাঁর লেখকগোষ্ঠীর ভাবনায় মার্কসবাদী তত্ত্ব প্রয়োগের কোনো পরিচয় ছিল না (অচিন্ত্যকুমারের নিজের ভাষায় তা ছিল উদ্ধত যৌবনের ফেনিল উদ্দামতা’)- তথাপি অচিন্ত্য কুমার, মণীশ ঘটক, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এবং পরবর্তীকালে জগদীশ গুপ্ত, হেমন্তকুমার সরকার বা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাব্যে ও কথাসাহিত্যে মার্কসীয় সমাজ-বাস্তবতার ছোঁয়াচ লেগেছিল। আর প্রত্যক্ষভাবে মার্কসবাদে বিশ্বাস নিয়ে রচিত ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দুটি উপন্যাস ‘অন্তঃশীলা’ ও ‘আবর্ত’ (১৯৩৫), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ (১৯৩৬); মনোরঞ্জন হাজরার কৃষক সংগ্রাম কেন্দ্রিক কাহিনী ‘পলিমাটির ফসল’, ‘নোঙরহীন নৌকা’ (১৯৩৭) এবং সদ্য কারামুক্ত গোপাল হালদারের ‘সন্ত্রাসবাদ’ থেকে মার্কসবাদে উত্তরণের কাহিনী ‘একদা’ (১৯৩৯তে প্রকাশিত; কিন্তু রচিত ১৯৩৪-৩৫ সাল) বাংলা প্রগতিশীল সাহিত্যে নতুন মোড় ফিরিয়েছিল এবং জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে কমিউনিস্ট চিন্তাধারার সংস্রব ঘটাতে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল।
উনিশশো ত্রিশের দশকের সূচনা থেকেই বাংলায় কমিউনিস্ট চিন্তাধারা ও মার্কসবাদের যে প্রসার ঘটেছিল তার পশ্চাতে নানা ধরনের মার্কসীয় প্রকাশনারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মার্কসীয় সাহিত্য, তাত্ত্বিক গ্রন্থাবলী এবং সংবাদপত্রগুলি অল্প সংখ্যায় হলেও এক শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে মার্কসবাদের প্রচার চালিয়ে যেত। ১৯৩১ সালে ২২বছরের তরুণ কমিউনিস্ট সোমনাথ লাহিড়ীর মৌলিক গ্রন্থ ‘সাম্যবাদ’ প্রকাশিত হয়- যা প্রকাশমাত্রই পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৩১ সাল থেকেই বাংলায় মার্কসীয় প্রকাশনার একটি সংগঠিত উদ্যোগ শুরু হয়। হিন্দি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হতে শুরু করে। যেমন : অভিযান (১৯৩০; সম্পাদক-সোমনাথ লাহিড়ী); ‘চাষী মজুর’ (১৯৩১ সং-বৈদ্যনাথ মুখার্জি); ‘মার্কসবাদী’ (১৯৩৩ সম্পাদক-অবনী চৌধুরী); ‘মার্কসপন্থী’ (১৯৩৩; সম্পাদক-আব্দুল হালিম); ‘গণশক্তি’ (১৯৩৪; সাপ্তাহিক) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ১৯৩৩ সালে ‘গণশক্তি পাবলিশিং হাউস’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই উদ্যোগ বিস্তারলাভ করে। এছাড়া ১৯৩৪-র জানুয়ারিতে প্রায় সাত বছর পরে ইউরোপ থেকে কলকাতায় ফিরে মার্কসবাদী সৌম্যেন ঠাকুর সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’ প্রকাশ শুরু করেন।
১৯৩০-এর দশকে কয়েকটি পত্র-পত্রিকাকে কেন্দ্র করে কমিউনিস্ট পার্টি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জোরদার হয়ে উঠেছিল। এই প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই পত্রিকার আড্ডাকে কেন্দ্র করে হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জি, বিষ্ণু দে প্রমুখ বিখ্যাত বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশ ঘটতো। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সম্পাদনায় ‘পরিচয়’ পত্রিকার প্রকাশ (১৯৩১) এই ধারায় একটি নতুন সংযোজন ছিল। ‘পরিচয়’কে কেন্দ্র করেই বাংলার চিন্তা-চেতনার জগতে কিছু বুদ্ধিজীবী ও চিন্তকের তৎপরতা সৃষ্টি হয়। সুধীন্দ্রনাথ নিজে কমিউনিজমের আদৌ সমর্থক না হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পত্রিকাকে তিনি প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনা এমনকি মার্কসবাদী ভাবাদর্শ প্রচারের জন্য উন্মুক্ত রেখেছিলেন। এই উদারতা তাঁর ছিল। সাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা, সমাজদর্শন ও শিল্প-সাহিত্য বিশ্লেষণে মার্কসবাদী তত্ত্বের প্রয়োগ, লেখক-শিল্পীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে এবং সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের ব্যাপক অগ্রগতি বিষয়ে ত্রিশের দশকের প্রথমার্ধেই অসংখ্য লেখা ‘পরিচয়’-এর পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হতো। পরিচয়ের পৃষ্ঠায় যে সকল মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী লিখতেন বাংলার শিক্ষিত সমাজে তাঁরা যথেষ্টই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সুশোভনচন্দ্র সরকার, নীহারেন্দ্রনাথ রায়, হিরণকুমার সান্যা ল, বিষ্ণু দে, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। মার্কসবাদী রূপেই এঁরা সুপরিচিত ছিলেন। এছাড়াও আরো অনেকে এঁদের সঙ্গে সহমত পোষণ করতেন। পরবর্তীকালে (১৯৪৩) ‘পরিচয়’ পত্রিকার মালিকানা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছেড়ে দেন কমিউনিস্ট পার্টির হাতে। এছাড়া পরে চল্লিশের দশকে জনপ্রিয়তা পায় ‘অগ্রণী’ (স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য সম্পাদিত) ও ‘অরণি’-র (সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার সম্পাদিত) মতো বামপন্থী পত্রিকাগুলি।
১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রগতি লেখক সংঘ-র ভিত্তি প্রকৃতপক্ষে তৈরি হয়েছিল ১৯৩২-৩৪ সালে লন্ডনের মাটিতে। সেখানে মুলকরাজ আনন্দ, সাজ্জাদ জাহির, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ভবানী ভট্টাচার্য, ইকবাল সিং, রাজা রাও, মহম্মদ আসরফ প্রমুখ লন্ডন-প্রবাসী ভারতীয়-ছাত্রদের দ্বারা। এছাড়াও ছিল জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ ও প্যারিসবাসী প্রমোদরঞ্জন সেনগুপ্তের সহায়তা। তাঁরা অনুপ্রাণিত হন রোমাঁ রোল্যাঁ, বারব্যুস, গোর্কি, ফর্স্টার, স্ট্রাচি প্রমুখ মনস্বীদের ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের আহ্বানে এবং হ্যারল্ড ল্যাক্সি, হাবার্ট রীড, মন্টেগু শ্ল্যাটার, রজনীপাম দত্ত প্রমুখ বিদেশী মার্কসবাদী বন্ধুদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে জর্জি ডিমিট্রভ ততদিনে (১৯৩৫) ‘সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী যুক্তফ্রন্ট’-তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। এই আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৩৬-এর এপ্রিলে লক্ষ্ণৌতে মুন্সী প্রেমচন্দ-র সভাপতিত্বে গঠিত হলো নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ। প্রকৃতপক্ষে প্রগতি লেখক সংঘ প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে যুগ্মভাবে ছিল মার্কসীয় বুদ্ধিজীবী ও কমিউনিস্টদের সক্রিয় উদ্যোগ তথা তৎকালে বামপন্থি রূপে পরিচিত কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরুর পরোক্ষ উৎসাহ। সদ্য ইউরোপ-প্রত্যাগত সাজ্জাদ জাহির, হীরেন্দ্রনাথ মুখর্জিরা ছিলেন এর নেতৃত্বে। প্রগতি লেখক সংঘের এই ঘোষণাপত্রটি ছিল সুদীর্ঘ এবং নানা কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ইশতেহারের (এটির প্রস্তুতিতে ভবানী ভট্টাচার্য ও সাজ্জাদ জাহিরের বিশেষ ভূমিকা ছিল।) প্রধান কয়েকটি বাক্য উল্লেখযোগ্য : ‘‘....যা কিছু আমাদের নিশ্চেষ্টতা, অকর্মণ্যতা, যুক্তিহীনতার দিকে টানে, তাকে আমরা প্রগতিবিরোধী বলে প্রত্যাখ্যান করি। যা কিছু আমাদের বিচার বুদ্ধিকে উদ্বুদ্ধ করে, সমাজব্যবস্থা ও রাজনীতিকে যুক্তিসঙ্গতভাবে পরীক্ষা করে, আমাদের কর্মনিষ্ঠ, শৃঙ্খলাপটু ও সমাজের রূপান্তরক্ষম করে, তাকে আমরা প্রগতিশীল বলে গ্রহণ করব।’’ সন্দেহ নেই এই ইশতেহারে ভারতের বৌদ্ধিক জগতে দায়বদ্ধ শিল্প-সাহিত্য সৃজনের এক নতুন যুগের উদ্বোধন ঘটিয়েছিল।
অবিভক্ত বঙ্গদেশে অবশ্য ইতোমধ্যেই ১৯৩৫-এর ২৭শে অক্টোবর বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীরা একত্রে মিলে এক ঘরোয়া সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ নিয়েই গঠন করেছিলেন যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সংঘের সাংগঠনিক কমিটি। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক্ষেত্রে বিশেষ উৎসাহ ছিল। ধনঞ্জয় দাশের গবেষণা-গ্রন্থে (মার্কসবাদী সাহিত্য-বিতর্ক, করুণা) এ বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। জানা যায় লক্ষ্ণৌ সম্মেলনে গঠিত প্রগতি লেখক সংঘের ঘোষণাপত্রকে ভিত্তি করে বাংলার প্রগতিশীল লেখক ও বুদ্ধিজীবীরাও একটি সাংগঠনিক কমিটির মাধ্যমে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। ১৯৩৬ সালের ১৮ই জুন গোর্কির মৃত্যুসংবাদ ঘোষিত হলে, নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘের সাংগঠনিক কমিটি গোর্কির মৃত্যুতে ১১ই জুলাই এলবার্ট হলের (বর্তমান কলেজ স্ট্রিটের কফি-হাউস) কমিটি রুমে একটি শোকসভার আয়োজন করেন। এই শোকসভার আহ্বায়ক ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার তৎকালীন প্রখ্যাত সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার (পাঁচ বছর পরে ইনি আনন্দবাজার পরিত্যাগ করে অরণি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন যা বাংলায় সংবাদ-সাহিত্য ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদবিরোধিতায় নতুন মাত্রা সংযোজন করে), কাজী নজরুল ইসলাম, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী (পরে যিনি ফ্যাসিস্ত-পন্থীদের দ্বারা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হন) ও খগেন্দ্রনাথ সেন-সহ দুইজন বিখ্যাত সম্পাদক ধীরেন্দ্রনাথ সেন (অ্যাডভান্স) ও বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় (যুগান্তর)। ম্যাক্সিম গোর্কির স্মরণে আয়োজিত এই শোকসভা থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তকে সভাপতি ও অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামীকে সম্পাদক করে বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ গঠনের ঘোষণা করা হয়।
১৯৩৫ সাল থেকেই ইউরোপে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। ইতালি ১৯৩৫-এ আবিসিনিয়া (ইথিওপিয়া) এবং জার্মানি স্পেনের উপর হামলা শুরু করেছে। পাবলো পিকাসোর মতো শিল্পী তাঁর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ছবি এঁকে। ১৯৩৬-এর ৩রা সেপ্টেম্বর রোমা রল্যাঁর আহ্বানে ব্রাসেলস শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে AIPWA-এর পক্ষ থেকে যে ঘোষণা-বার্তা প্রেরণ করা হয় তাতে বলা হলো : ‘‘পৃথিবীর সম্মুখে আজ আতঙ্কের মতো আর এক বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা সমুপস্থিত। ফ্যাসিস্ত স্বৈরতন্ত্র মাখনের বদলে কামান তৈরিতে মগ্ন। তারা সংস্কৃতির বিকাশের বদলে বিকশিত করছে সাম্রাজ্য জয়ের উন্মাদ লালসা, প্রকাশ করছে নিজের হিংস্র সামরিক স্বরূপকে।’’ ১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসে Mode Review-এর পৃষ্ঠায় প্রকাশ পায় বিশ্ববাসীর কাছে মনীষী রোমা রল্যাঁ র ‘‘মনুষ্যত্ব, মানব সভ্যতা আজ বিপন্ন’’ শীর্ষক আকুল আবেদন। মার্চ মাসে প্রগতি লেখক সংঘের তৎপরতায় রবীন্দ্রনাথকে সভাপতি, অধ্যাপক কে টি শাহকে কার্যকরী সভাপতি ও সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সম্পাদক করে গঠিত হয় Leagu Against Fascism & War-এর সর্বভারতীয় কমিটি স্বামী সহজানন্দ থেকে জয়প্রকাশ নারায়ণ, তুষারকান্তি ঘোষ, ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ ভারতের প্রায় সকল বৌদ্ধিক অগ্রপতিকরাই এতে যুক্ত হয়েছিলেন। এইসব শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীর মানস-সংস্কৃতির ফসল ধারণ করে আছে প্রগতি লেখক সংঘ প্রকাশিত Towards Progressive Literature এবং সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত প্রগতি নামক দুটি মূল্যবান সঙ্কলন গ্রন্থ যা আজ সময়ের দলিল। অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত প্রগতি-র ভূমিকাংশে লিখেছিলেন : ‘‘সামাজিক চৈতন্য সাহিত্য সৃষ্টির পরিপন্থি নয় এবং রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে পরস্পর মতভেদ থাকা সত্ত্বেও ফ্যাসিজমের বিরোধী হওয়া যায়। যাঁরা এই নীতিতে বিশ্বাসী প্রগতি লেখক সংঘ ও প্রগতির পৃষ্ঠায় সকলেই স্বাগত।’’ অর্থাৎ কলা-কৈবল্যবাদের স্বর্ণ-শৃঙ্খল লেখক-সাহিত্যিকদের পা থেকে খসে গেল সেদিন।
১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে হইহই করেই সংঘের সর্বভারতীয় দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যাতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অভিভাষণ প্রেরণ করেন মুসলিম জগতে তুরস্কের অগ্রগতিকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। সংঘের সক্রিয় সংগঠক রূপে এমন কয়েকজন তরুণ লেখক-সাহিত্যিক-কবি আত্মপ্রকাশ করেন যাঁরা পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যের মোড় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে গোপাল হালদার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিনয় ঘোষ, সমর সেন, সরোজ দত্ত, অনিল কাঞ্জিলাল, সুবোধ ঘোষ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। কয়েকজন অবশ্য পরে এই আন্দোলন পরিত্যাগও করেছিলেন নানা কারণে। তাঁর বিস্তারিত বিবরণ সুধী প্রধানের সংস্কৃতির প্রগতি এবং Marxist Cultural Movement in India (3Vols) প্রগতি সাহিত্য সম্পর্কে সে-সময়ের বিতর্কাদির জন্য দ্রষ্টব্য ধনঞ্জয় দাশের পূর্বোক্ত গবেষণাগ্রন্থ।
বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ অবশ্য ১৯৪২সালের ২৮শে মার্চ তারিখে কলকাতায় তরুণ কমিউনিস্ট লেখক সোমেন চন্দ-র (ইনি ঢাকার রাজপথে নির্মমভাবে প্রো-ফ্যাসিস্তদের দ্বারা নিহত হন ৮ই মার্চ, ১৯৪২) স্মরণসভা থেকে নাম বদল করে ফ্যাসিস্ত-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ পরিণত হয়। তার আগের বছর জ্যোতি বসু ও স্নেহাংশুকান্ত আচার্যের উদ্যোগে স্থাপিত হয় সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি। ১৯৪৩-এ প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। সারা ভারতজুড়ে সৃষ্টি হয় বৌদ্ধিক-জগতে এক মার্কসবাদী জাগরণের, যুদ্ধ, মন্বন্তর, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যা এক বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন সৃষ্টি করেছিল। নিঃসন্দেহে প্রগতি লেখক সংঘ ছিল তার প্রধান পথ প্রদর্শক ও অনুপ্রেরণা।