দাবদাহ : ধনীদের দায়, খেসারত জনগণের

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
গত সপ্তাহে সকালবেলায় অফিসে যাবার সময় যে রিকশায় সওয়ার হলাম সেই রিকশার চালক বেশ প্রৌঢ়। এই কাঠফাটা রোদে স্বল্প দূরত্বেই তিনি হাঁপিয়ে উঠলেন। অফিস পর্যন্ত নিয়ে যেতে যেতে তিনি একদম ঘামে ভিজে একাকার। কারণ, সারাদেশে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলছে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ। রিকশাচালক নিজেও গল্প করলেন, এমন গরম এর আগেও তিনি দেখেছেন, কিন্তু এবারকার গরমটা একটু বেশিই। তিনি স্মরণ করে বললেন- এই চৈত্র-বৈশাখ মানেই কাঠফাটা রোদ। আর সেটা দেখে এসেছেন ছোটবেলা থেকেই। আমি প্রশ্ন করলাম- কিন্তু এই গরমটা কি আগের তুলনায় আলাদা? তিনি বললেন, ‘হ আলাদাতো অবশ্যই। আগে গরম থাকতো আবার বাতাস থাকতো, গাছপালা আছিলো, মানুষ জিরাইতে পারতো। এখনতো কারেন্ট ছাড়া, ফ্যান ছাড়া বাঁচার উপায় নাই। আর বড়লোকদের জন্য এসিতো আছেই। চলমান সময়ে বাংলাদেশের জন্য একটি অত্যন্ত জরুরি আলোচনা হলো এই অতি দাবদাহ। গত প্রায় একমাস ধরে ঢাকাসহ প্রায় দেশব্যাপী মানুষ অনুধাবন করলো প্রচণ্ড দাবদাহ। গত এক সপ্তাহ হলো খানিক বৃষ্টির কারণে সামান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই দাবদাহ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা এবং এর প্রভাবে স্কুল কলেজ পর্যন্ত সরকার বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। এই তাপদাহের কী কারণ, এর প্রভাবে কীভাবে আমাদের প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে এর সম্পর্ক কী–এমন হাজারো আলোচনা আমরা প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছি গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু এই ভয়াবহ তাপ থেকে আমাদের মুক্তি মিলছেই না। বেশ কিছুদিন ধরেই আমরা দেখতে পাচ্ছি তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রির উপরেই থাকছে। কিন্তু তা অনুভব হচ্ছে ৪৩, ৪৪ বা তারও বেশি। আমরা আগে দেখতাম বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকে, কিন্তু বর্তমান সময়ে তা পাল্টে গেছে। বইতে পড়েছিলাম নাটোরের লালপুর সবচেয়ে বেশি উষ্ণ, কিন্তু এখন তা ছাড়িয়ে রাজশাহী, যশোর, চুয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন জেলায় উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। ঢাকা শহরের সর্বত্র এই দাবদাহ জনজীবনকে স্থবির করে ফেলছে। সারা দেশে অসংখ্য মানুষও তাপদাহে মারা গেছেন। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে- কেন এই দাবদাহ? বিশ্বকে উত্তপ্ত করার মতন হাজারো ঘটনা প্রতিদিন ঘটানো হচ্ছে বলেই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এবং সেটার প্রভাবেই এই প্রাকৃতিক নানান বিপর্যয় কিংবা দুর্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো তাদের নির্বিচারে ভোগ ও জীবাষ্ম জ্বালানির ব্যবহারের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। আজকে তাদের কারণেই আমাদের মতন দেশগুলোর ওপর প্রকৃতির নিদারুণ নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আমরা হারাচ্ছি আমাদের প্রাণ-প্রকৃতির বৈচিত্র্যকে। উত্তর মেরুর বরফ যেমন এই প্রভাবে গলছে তেমনই সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বেড়ে আমাদের মতন দেশ পড়ছে হুমকির মুখে। এই বৈচিত্র্য হারিয়ে যাবার কারণেই আজ পুরো পৃথিবীকে তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে। গত বছর বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলন হয়ে গেলো দুবাইতে। কিন্তু এই দুবাই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এবং জীবাষ্ম জ্বালানি ব্যবহারে পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্র। এমনকি এই ধরনের সম্মেলনে যে পরিমাণ জ্বালানির ব্যবহার হয় তা-ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে কম ভূমিকা রাখে না। অথচ এই সম্মেলনগুলোতে যে ঘোষণা আসে তার বাস্তবায়ন কখনোই দেখা যায় না। কারণ, উন্নত বিশ্ব তাদের অপরাধের দায় নিতে চান না, এমনকি তারা কোনো ক্ষতিপূরণ দিতেও রাজি থাকে না। এসকল সম্মেলন কেবলই মুনাফা ও পুঁজির কারসাজি। যেকারণে গত বছরের সম্মেলনে প্রধান ইস্যু ‘লস অ্যান্ড ডেমেজ’ থাকলেও আমাদের মতন দেশ জলবায়ু ঝুঁকির সর্বোচ্চ প্রভাবে থাকার পরও তেমন কোনো ক্ষতিপূরণের আশ্বাস পাননি। আর যা দেয়ার প্রতিশ্রুতি তারা দিচ্ছেন তার বাস্তবায়ন বিগত দিনেও দেখা যায়নি। বিশ্বব্যাপী যে পুঁজিবাদী দর্শন চলছে তার প্রভাবেই সব পাল্টাচ্ছে। পুঁজির ধর্মই যেখানে মুনাফা, সেখান পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির প্রশ্নে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি মুনাফা ব্যতিত আর কিছু নয়। আমরা দেখি যে যুদ্ধ উন্মাদনা আজকে মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর দেশে দেশে চলছে, তা-ও চাপিয়ে দিচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্ব। বিশ্বব্যাপী যে পারমাণবিক বলয় গড়ে তোলা হচ্ছে, তার প্রভাব বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে অন্যতম। এমনকি বিশ্বব্যাপী অধিক উৎপাদনের যে তত্ত্ব তা-ও পুঁজিবাদী দর্শন থেকেই উৎসারিত। যে কারণে আজকে বিশ্বকে একটি অমানবিক উৎপাদন যন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় আমাজন বন ধ্বংস কিংবা সুন্দরবন যে প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে তা একই সূত্রে গাঁথা। এই সূত্রকে ভাঙতে পারে কেবল শ্রমিকশ্রেণির বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে সকল প্রাণ ও প্রকৃতির মুক্তির সংগ্রাম নিহিত। আমাদের দেশেও এই একই পরিস্থিতি বিদ্যমান। এখানে উন্নয়নের নামে নির্বিচারে প্রকৃতি ও পরিবেশকে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। রাস্তা নির্মাণের কথা বলে বনভূমি ধ্বংস, নদী দখল, খাল ও জলাশয় দখল, হাওরের বুক চিরে ভয়ংকর রাস্তা, টিলা কেটে হোটেল নির্মাণ কিংবা আলতা দিঘী খননের নামে বনভূমির বিনাশ সকলই একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের মতন রাষ্ট্র ও তার অধিপতিরা পরিবেশকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি বিষয় হিসেবে দেখে। মনে পড়ে রাষ্ট্রের একজন কর্তা ব্যক্তি পরিবেশবাদীদের সরাসরি বলেছিলেন, আমরা আগে নিজেদের উন্নয়ন করবো, তারপর পরিবেশ নিয়ে ভাববো। তার যুক্তি ছিলো ইউরোপ-আমেরিকা আগে নিজেদের উন্নত করেছে এবং পরে পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করেছে। এটা যখন আমাদের মতন একটি উন্নয়নকামী দেশের নীতি নির্ধারকদের ভাবনা হয়, সেখানে একটি পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণকে কিংবা সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজ যাতায়াত করাকে কিংবা একটি পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণকে তারা বড় উন্নয়ন হিসেবে দেখবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর সেই যুক্তিতে দাবদাহকেও তারা এত বড় সমস্যা মনেই করেন না। দাবদাহ না দেখলেও তার প্রভাব কিন্তু ভয়াবহ মাত্রায় চলছে। এই যে উন্নয়নকামী ও পরিবেশ বিধ্বংসী রাষ্ট্রীয় কল-কৌশল তার প্রভাবেই আজকে আমাদের পরিবেশ, প্রাণ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্যকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। আমাদের শীতে আর শীত দেখা যায় না, বর্ষায় দেখা মেলে না বৃষ্টির, হেমন্ত এসেই বলে যাই- এই হলো আমার ঋতু বৈচিত্র্য। যার ফলে আমাদের কৃষি, উৎপাদন ব্যবস্থাতেও এসেছে মারাত্মক পরিবর্তন। আমাদের প্রাকৃতিক কৃষিকে দখল করে নিয়েছে রাসায়নিক কৃষিযন্ত্র। অধিক উৎপাদনের পুঁজিবাদী দর্শনের চাপে আমাদের কৃষকরা তাদের বীজের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন কর্পোরেট ও কোম্পানির হাতে। তাদের হাতেই বন্দি সকল আয়োজন। আর রাসায়নিক সার, বিষের প্রভাবেও আমাদের পরিবেশকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে দীর্ঘসময় নিয়ে। আজকে আমাদের বনভূমিকে কেবল ধ্বংস করা হয়নি, তার বদলে এখানে নির্মাণ করা হয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসকারী সামাজিক বনায়ন। আর যার কারণে প্রকৃতি আমাদের প্রতি সদয় না হয়ে, হয়েছে বিরূপ। শুধু বৃক্ষরাজির কারণে ঢাকা শহরে তেজগাঁওয়ের তুলনায় ধানমন্ডি কিংবা শাহবাগ এলাকার তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কম থাকে। কিন্তু আমরা দেখেছি গত বছর ধানমন্ডি সাত মসজিদের সড়ক বিভাজকের গাছগুলোকে কি নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। যার ফলশ্রুতিতে আমরা এ বছর দেখছি সেই রাস্তায় কোনো ছায়া নেই, তীব্র তাপ সেই রাস্তায় চলাচলকারী মানুষেরা অনুভব করছেন। একই পরিস্থিতি চট্টগ্রাম কিংবা যশোরের ক্ষেত্রেও আমরা দেখতে পাচ্ছি। আর সারাদেশে যেন গাছ কাটার উৎসব শুরু হয়েছে। এসময়ে দাঁড়িয়ে যখন তীব্র দাবদাহ চলছে, আমরা তখন বলতে চাই- এই গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে, গাছ হত্যা নিষিদ্ধ করতে হবে। এটাই দাবদাহ থেকে বাঁচার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হতে পারে। আমাদের বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন এবং এখানে উন্নত দেশগুলোর নেতিবাচক প্রভাব কিংবা জলবায়ু ঝুঁকির তালিকায় আমাদের অবস্থান কী, তা-ও প্রসঙ্গক্রমে আলোচনায় চলে আসছে। আর আমাদের মতন একটি জলবায়ু ঝুঁকিতে অবস্থানকারী রাষ্ট্রের ওপর নানা শ্রেণিপেশার মানুষের জীবনেও তার প্রভাবে মাত্রাগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। শ্রেণিভেদে তীব্র তাপদাহের প্রভাবও ভিন্ন ভিন্ন হয়। আমাদের দেশের শ্রমজীবী নিম্নআয়ের মানুষেরা কীভাবে এই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলা করছেন তা একটু পরখ করে দেখা জরুরি। সারাদেশে যখন তীব্র দাবদাহ চলছে তখনো কিন্তু আমাদের শ্রমজীবী মানুষেরা কাজ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না, পাচ্ছেন না নিজেদের সুরক্ষিত করার কোনো ব্যবস্থা। এই তাপদাহে হিটস্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেছেন নানা শ্রেণিপেশার মানুষ আর তাদের মধ্যে শ্রমজীবীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমাদের কৃষক, ক্ষেতমজুর ও শ্রমজীবী মানুষ যখন প্রচণ্ড বিরূপ তাপদাহে মাঠে কাজ করতে বাধ্য হন তখন এদেশের পুঁজিবাদী শ্রেণির কাছে এই তীব্রতার কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। পুঁজিবাদী কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তখন গরম থেকে বাঁচতে কোমল পানীয় কিংবা এসির বিজ্ঞাপনের ঝাপি খুলে বসে। এমনকি তাপদাহের মাত্রাতিরিক্ত আলোচনাতেও রয়েছে কর্পোরেট বাণিজ্যের কূটকৌশল। এই আলাপের মধ্যেও বিশাল বাণিজ্য লুকিয়ে রয়েছে। বেশি দাবদাহ মানে বেশি এসি বিক্রি। সেদিন একজন এসি ব্যবসায়ীর মুখ থেকে শুনলাম তাদের এ বছরের টার্গেট বিক্রি একমাসেই শেষ হয়ে গেছে। এসি চাইলেও সাথে সাথে পাওয়া যাচ্ছে না। এই ভোগবাদী ও পরিবেশ বিধ্বংসী চিন্তা ও দর্শনের বাইরে এসে প্রাণ ও প্রকৃতিকেন্দ্রিক জীবন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের এই তীব্র দাবদাহ আর কিছু নয়, পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী দুনিয়ার একটি ভয়ংকর প্রভাব। আর এর থেকে মুক্তির পথও হলো পুঁজিবাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি ও মানবমুক্তির সংগ্রামকে বেগবান করা। সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে ভোগবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো শ্রেণিসচেতন মানুষের তথা শ্রমিক শ্রেণির। লেখক : সাধারণ সম্পাদক, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলন (পরিজা)

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..