পুতিনের পতন এবং গাজায় হামলা বন্ধ

ড. মঞ্জুরে খোদা

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
সম্প্রতি ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের শীর্ষ ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস সুইজারল্যান্ডের একটি মিডিয়াতে সম্প্রচারের জন্য একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। কিন্তু তা আনুষ্ঠানিক সম্প্রচারের আগেই প্রকাশ হয়ে যায়। সেখানে তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনের শান্তি আলোচনার সাহস থাকা উচিত। মৃত্যু ও ধ্বংস বন্ধ-রোধে তাদের সেটা করা উচিত।’ সাক্ষৎকারটি প্রকাশ হবার পর ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাখোঁ বলেছেন, ‘ন্যায়সঙ্গতভাবে এই যুদ্ধের পরিসমাপ্তির উপায় হচ্ছে পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরানো।’ তাকে ‘গণহত্যাকারী’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অত্যাচারীর পতন না হওয়া পর্যন্ত শান্তি আসবে না।’ গার্ডিয়ানের মতামত কলামে সাইমন ট্রিসডেল বিষয়টি তুলে ধরে একটি বিশ্লেষণ হাজির করেন। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে পশ্চিমা শক্তি প্রধান যে যুক্তিটি তুলে ধরেন তা হলো, ‘রাশিয়ার এই আগ্রাসনকে যদি প্রতিহত করা না যায়, তাদের পরাজয় যদি নিশ্চিত করা না যায় তাহলে পৃথিবীর কোনো দেশ নিরাপদ থাকবে না। রাশিয়ার এই কর্ম বৈধ হলে বিশ্বে এই উদাহরণ তৈরি হবে যে যার ক্ষমতা আছে সে শক্তি দিয়ে যে কোন দেশ-অঞ্চলকে দখল করে নিতে পারবে’। সাধারণ যুক্তিতে তাদের এই বক্তব্য যুক্তিসঙ্গত মনে হলেও বিয়ষটি কি আসলে এতটা নিরীহ ও সরল? মোটেই তা নয়। এর আছে দীর্ঘ আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কূটনীতি ও পরাশক্তির দ্বন্দ্ব। যার দায় মার্কিন ও পশ্চিমারা কোনভাবেই এড়াতে পারে না। তাদের ছকেই ইউক্রেনকে দিয়ে রাশিয়াকে যুদ্ধের ফাঁদে টেনে আনা হয়েছে। যাতে করে রাশিয়া কোনোভাবেই বিশ্বশক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। তারা যে যুক্তি দিচ্ছে রাশিয়ার এই আগ্রাসন বিশ্বে খারাপ উদাহরণ হয়ে থাকবে! কিন্তু এই উদাহরণ কি রাশিয়া প্রথম তৈরি করেছে? ফ্রান্স, ব্রিটেন, আমেরিকা কি শতাব্দির পর শতাব্দি তা চালিয়ে যায়নি? এখনো চালাচ্ছে না? আমেরিকা কি মিথ্যা অজুহাতে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়ার মত দেশসমূহকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়নি? লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা, কোটি কোটি মানুষকে উদ্বাস্তু করেনি? ম্যাখোঁর ফ্রান্স আফ্রিকার দেশে দেশে তাদের পছন্দের শাসক বসিয়ে দখল ও অত্যাচারের রাজত্ব কায়েম করেনি? ব্রিটেন কি এশিয়ার বিভিন্ন দেশ দখল করে নেয়নি? শতাব্দির পর শতাব্দি তারা শাসন-শোষণ লুণ্ঠন করেনি? সময়ের পরিবর্তনে তারা তাদের দখল-শোষণের কৌশল পরিবর্তন করে লুণ্ঠন অব্যাহত রেখেছে। তাহলে তারা কোন নৈতিকতায়, যুক্তিতে রাশিয়াকে এমন অপবাদে অভিযুক্ত করছে? কাহিনী নিশ্চয়ই অন্য কিছু? এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি হোক সেটা পশ্চিমারা চায় না, তাকে তারা মেনে নেবে না। সেটাই এই দ্বন্দ্ব ও শত্রুতার মূল কারণ নয় কি? ম্যাখোঁর বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে তাঁরা পুতিনের পতন চান, প্রত্যাশা করেন। তাঁরা কি শুধু সেই কথা বলে খ্যান্ত? সেই চেষ্টা কি করেননি, করছেন না? তাঁরা পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরাতে যত তৎপর পুতিন ততো শক্তপোক্ত হয়ে ক্ষমতায় জেকে বসছেন। সেখানে তাঁর জনপ্রিয়তা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আমি পুতিনের এককেন্দ্রিক শাসন ও ক্ষমতায় আকড়ে থাকাকে সমর্থন করি না। কিন্তু এটা তো মানতে হবে যে রাশিয়ায় তাঁর জনপ্রিয়তা আছে। রাশিয়ার জনগণ মনে করেন এই মুহূর্তে তাদের কাছে পুতিনের কোনো বিকল্প নেই। সে দেশের সিংহভাগ মানুষ তাঁকে সমর্থন করেন। রুশ জনগণ মনে করেন পশ্চিমারা রাশিয়াকে বিভক্ত ও ক্ষতি করতে তাদের অনুগত শাসক চায়। তারা বিশ্বশক্তি হিসেবে রাশিয়ার উত্থানকে ঠেকাতে চায়। সুতরাং রাশিয়ার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পুতিনের হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। সর্বশেষ মধ্য মার্চের ৩ দিনের নির্বাচনের ফলাফল সে কথাই প্রমাণ করেছে। কিন্তু পশ্চিমারা মনে করে পুতিনের দেশে তাঁর কোনো জনপ্রিয়তা নেই। তিনি গায়ের জোরে ক্ষমতায় আছেন। বিষয়টি কি আসলে তাই? কিন্তু পুতিনের পতন কবে, কীভাবে হবে? তারা কি সেটা বলতে পারেন? আপাতত ২০৩০ সাল পর্যন্ত তিনি তাঁর ক্ষমতায় থাকাকে নিশ্চিত করেছেন। যদি কোনো দৈব-দুর্বিপাক না ঘটে তিনি আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবেন। তার মানে ইউক্রেনকে আরো আগামী পাঁচ বছর যুদ্ধ টেনে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তারপর যে সেটা শেষ হবে- তার নিশ্চয়তা কোথায়? তাহলে? যুদ্ধের দুই বছরেই পশ্চিমা শক্তি হাপিয়ে উঠেছে। মার্কিন সাহায্য আটকে আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের টানাপোড়েন, ন্যাটোতে দ্বিধা ইত্যাদি। সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিই তাঁর বক্তব্যে এমন অভিযোগ, অভিমানের কথা উল্লেখ করেছেন। যে মার্কিন নেতৃত্বে ইউক্রেন যুদ্ধ প্রযোজিত হচ্ছে সেখানেও পরিবর্তন অত্যাসন্ন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বাইডেনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্প যুদ্ধ ও সাহায্য বন্ধের আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। জেলেনস্কি সে কারণে মিডিয়াতে তার উদ্বেগের কথাও প্রকাশ করেছেন। পুতিনের পতন হলে ইউক্রেন যুদ্ধ হবে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান-, সেই সুখ স্বপ্নের ঘোরে ম্যাখোঁ, জেলেনস্কিরা থাকুক। কিন্তু ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা করে ধুলোয় মিশিয়ে দিলো, কিমা-গ্রিল বানিয়ে ফেললো সেটা বন্ধ হবে কীভাবে, কার পতনে? কার কোমড়ের শক্তিতে নেতানিয়াহু এতটা বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন? জাতিসংঘ ও বিশ্ব জনমতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে? জাতিসংঘের কারা, কোন শক্তি চারবার ভেটো প্রদান করলো? তাহলে সেই শক্তির পতন না হলে কি গাজার মুক্তি আসবে না? সাইমন ট্রিসডেলরা সে কথা বলেন না, লিখতে পারেন না, তাঁদের দম ফুরিয়ে যায়। গাজার যুদ্ধ শুরু হয়েছে গত বছরের ৭ অক্টোবর, তার মানে এই যুদ্ধ চলছে প্রায় ৬ মাস। আর ইউক্রেনের যুদ্ধ তিন বছরে পড়লো। ইসরায়েলের হামলা-আক্রমণে গাজায় নিহতের সংখ্যা ৩২ হাজারের উপরে, আহতের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। এরমধ্যে প্রায় ৭০ ভাগ নারী-শিশু, সাংবাদিক শতাধিক, মানবাধিকার কর্মী কয়েকশো, যাদের সাথে যুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই। বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা ও হৃদয়হীনতার এমন কোনো নজির নেই যা এই মার্কিন সমর্থিত ইসরায়েলি শাসকরা গাজায় করেনি। ২০২২ সালে যুদ্ধ শুরু হবার পর এখন পর্যন্ত ইউক্রেন যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ১০ হাজার ৭০৩ জন। এরমধ্যে শিশুর সংখ্য ৫৯৪ জন। দুই বছরে রুশ বাহিনীর আক্রমণে যে পরিমাণ ইউক্রেন নাগরিক নিহত হয়েছে ছয় মাসে তার তিনগুণ নিহত হয়েছে ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণে গাজায়। তাহলে এই যুদ্ধ দুই বছর টানলে নিহতের সংখ্যা কত হবে? সে কথা ভাবতেই গা শিউড়ে ওঠে। তার মানে তাদের উদ্দেশ্য কী? ইউক্রেনে শান্তি না পুতিনের পতন? পুতিনের পতন না হওয়া অবধি কি হত্যা, ক্ষতি, ধ্বংস অব্যাহত থাকবে? মানচিত্র থেকে দেশটাকে মুছে ফেলে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে হবে? সেটা কি সম্ভব? রাশিয়া কি ইরাক, লিবিয়ার মত কোনো দেশ? পুতিন কি সাদ্দাম-গাদ্দাফির মতো কোন শাসক-নেতা? কিন্তু তাঁরা স্বপ্ন দেখেন মাটির কোনো গর্ত বা মরুভূমির ধুলো থেকে তাঁকে আবিষ্কার করবেন? পুতিনের তর্জনি উঁচানো হুঙ্কার কি পশ্চিমারা বুঝতে অক্ষম? এতটা নাদান কি তারা? তাহলে কীসের ভরসায়, কোন ছকে- সিংহের সামনে শেষ শাবককে ছেড়ে দিলেন? লেখক : গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..