পাশ্চাত্য ‘উদারতাবাদের’ স্লান আলোয় অবাঞ্ছিত আত্মানুসন্ধান
কানাই দাশ
একটি দেশের জনজীবন, অর্থনীতি, অসাম্প্রদায়িক নাগরিক চেতনা সবকিছুই নির্ভর করে একটি গণতান্ত্রিক জবাবদিহিমূলক বিধিবদ্ধ শাসন ব্যবস্থার ওপর। ইউরোপীয় সদ্য স্বাধীন দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তা হতে দেয়নি নানা কৌশলে। ভাবনার ক্যানভাস বিস্তৃত না করে দেখলে আমরা এর কারণ খুঁজতে থাকব শুধু আমাদের কথিত অন্তর্গত ক্রটির মধ্যে। ১৯৮০’র দশক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাংকের চাপে দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি দেশে নিউ লিবারেল রাজনৈতিক অর্থনীতি অনুসৃত হচ্ছে। যার মূল প্রতিপাদ্য হল অবাধ প্রাইভেটাইজেশন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু ধনিক গোষ্ঠীর সরকারি সম্পত্তি লুটপাট, সরকারি ক্ষমতা ক্রমে কুক্ষিগত করা ও নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে জবাবদিহিবিহীন অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করা যাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ঐ লুটেরা ধনীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এরই স্বাভাবিক অনুষঙ্গ হিসেবে মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করে রাখতে ধর্মের পুরনো বর্ম ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়ে যেন লুটপাটে নিষ্পিষ্ট মানুষের ক্ষোভ লুটেরা গোষ্ঠীর প্রতি না গিয়ে সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ ঘৃণায় রূপ নেয়। ফলে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা এসব দেশে সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতার ক্রমে সামাজিকীকরণের ফলে অসহায় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় দিন যাপনের পাপ ক্ষয় করে থাকে দেশে দেশে। এই রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সাম্প্রদায়িক বিভেদের মনস্তত্ত্বের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হল কথিত উদারবাদী পাশ্চাত্য দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র।
একটি সমাজে উদারবাদের মূল উৎস মুক্তবুদ্ধির চর্চা, বিজ্ঞানমনস্কতা, ইহজাগতিকতা বা সেক্যুলার সামাজিক রাজনৈতিক চর্চা, গণতান্ত্রিক জবাবদিহি। এসব কিছুই নিউ লিবারেল অর্থনীতির জবরদস্তি বা কথিত মুক্তবাজার অর্থনীতির মে․লিক প্রত্যয়ের বিরোধী। নিজ দেশে “উদার মানবতাবাদী” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত অর্ধশতাব্দিরও বেশি সময় ধরে বিশ্বব্যাপী অপছন্দের সরকার পরিবতন করার পুলিশি ভূমিকা পালন করে চলেছে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দির কথা বাদ দিলেও এক হিসেবে দেখা যায় ১৮২০ থেকে ১৯২০ এই ১০০ বছরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে ৬ কোটিরও বেশি শ্বেতাঙ্গ উত্তর আমেরিকাতে পাড়ি জমায়। এরাই ধ্বংস করেছে মায়া ও আজটেক সভ্যতা, গণহত্যা চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে সব আমেরিকান আদিবাসীদের।
অনুপ্রবেশকারী শ্বেতাঙ্গরাই আজ বলছেন- অসবৎরপধ ভড়ৎ অসবৎরপধহং। বিগত ২৫০ বছর ধরে চালু রেখেছে এক দ্বিদলীয় শাসন ব্যবস্থা। আর্থিক ও অভ্যন্তরীণ বা বিদেশ নীতিতে এই দুই দলের শাসন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনার পার্থক্য খুবই কম। অতিকায় সব মার্কিন কর্পোরেট ক্যাপিটেলের অতিবান্ধব এই দুই দলকে পরস্পর বিরোধী না বলে বলা যায় পরস্পর পরিপূরক। বস্তুত কোন আদর্শগত বিরোধীদল বিহীন এক সামাজিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সেখানে বিরাজমান। রিপাবলিকান আমলে যেমন নিক্সন সরকার বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য দায়ী তেমনি খ্যাতনামা ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ভিয়েতনাম যুদ্ধের জন্য দায়ী। বর্তমানে বিশেষ করে উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদের পুনরুখান, সেই কথিত গণতান্ত্রিক স্থিতাবস্থার অভ্যন্তরে চিড় ধরিয়েছে। গত নির্বাচনে ফলাফল না মেনে ট্রাম্পের নির্দেশে মার্কিন পার্লামেন্ট ভবনে তাঁর সমর্থকদের সশস্ত্র হামলা ও হত্যার নজিরবিহীন ঘটনাকে কর্পোরেট মিডিয়ার কল্যাণে লঘু করে দেখানো হয়েছে। বর্ণবাদের উত্থান, তীব্র ধনবৈষম্য, অবাধ বন্দুকধারীদের নিরন্তর বর্ণবাদী হামলা কোনো সমাজকে উদারবাদের দিকে নেয় না, বরং ক্রমে পেছনে টানে। ট্রাম্পের মতো দুশ্চরিত্র ও বর্ণবাদী রাজনীতিবিদের জনপ্রিয়তা ও পুনরায় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারা এর প্রমাণ। পৃথিবীর দেশে দেশে অব্যাহত নৃশংসতা চালিয়ে, কর্পোরেট ক্যাপিটেলের শোষণের আষ্টেপৃষ্ঠে মানুষকে বন্দি করে, আমাদের দেশে জামাতের মত ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তির আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা হয়ে স্বদেশে কথিত উদারবাদিতা, ইহজাগতিকতার চর্চা নিঃসন্দেহে অসততা ও হিপোক্র্যাসি। শুধু অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশ্বব্যাপী খনিজসম্পদ লুট করে, অর্থের জোরে হিপোক্র্যাট ও অসৎ নেতৃত্বে একটি সমাজ চলতে পাওে না বেশিদূর। ইতোমধ্যে চীন-রাশিয়ার সাম্প্রতিক মেরুকরণ তা প্রমাণ করছে।
আধুনিকতার সূচনা পর্বে অর্থাৎ ইউরোপীয় রেনেসাঁর মানবতাকেন্দ্রিক ভাবধারার প্রভাবে, বিজ্ঞানের নবতর আবিষ্কার ও ভাবনার পটভূমিতে যে সামাজিক আলোকায়ন বা এনলাইটেনমেন্ট শুরু হয় তা যেমন সমাজকে আলোকিত করে তেমনি তা সামন্তবাদী নিপীড়ন ও ভাবাদর্শ থেকে পুঁজিতন্ত্রের বিকাশে শক্তি যোগায়। ভূমিদাস অপেক্ষাকৃত স্বাধীন শ্রমদাসে পরিণত হয়। মজুরি দাসত্বের এই ব্যক্তিস্বাধীনতা রেনেসাঁর চেতনার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ বটে, কিন্তু তাতে মানুষ আটকে যায় পুঁজির নবতর সুকঠিন শোষনের জালে। সামন্তবাদী শাসকদের শাসনের হাতিয়ার খ্রিষ্টীয় সৃষ্টিতত্ত্ব ও চার্চের প্রভাব নব্য পুঁজির মালিকদের আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সীমিত হয়ে পড়ে এবং অবশেষে রক্তাক্ত সংঘাতের মাধ্যমে অর্থোডক্স চার্চের হাত থেকে রাষ্ট্র মুক্ত হয় ও ব্যক্তি স্বাধীনতার দ্বার খুলে যায়। ইউরোপীয় রেনেসাঁর মর্মবস্তু- উদারবাদের চর্চা, ইহজাগতিকতার প্রভাব বাড়তে থাকে পরিবর্তনের অনুষঙ্গ হিসাবে। কিন্তু পুঁজিবাদের এই বিশ্বজনীন আপাত প্রগতিশীলতা একটা পর্বে এসে মুনাফা লোভী পুঁজির বিস্তারের কারণে আর টেকেনি। বাজারের প্রয়োজনে পুঁিজর মালিকরা প্রাচ্যকে নির্মম ভাবে পদানত করে দখল করে ও ভাগ বাটোয়ারা করে নেয় পুরো দুনিয়া। খসে পড়ে পাশ্চাত্য উদারবাদের কথিত মহিমা। ক্রমে স্ফীত হতে থাকা পুঁজিবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্তরে রূপান্তর ঘটে উনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে যার উৎকট রূপ বিংশ শতাব্দিতে ফ্যাসিবাদে পরিণত হয়ে সমস্ত মানবিক সুকুমার বৃত্তিকে ধ্বংস করতে উদ্যোগী হয় এবং দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত করে প্রায় ৮ কোটি মানুষের করুণ মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠে পুঁজিবাদ।
আমাদের দেশের কথা যদি বলতে হয় তা হলে বলতে হবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতবর্ষ ছেড়ে যাওয়ার সময় ভবিষ্যৎ ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা জেনেও মুসলিম লীগের অন্যায্য দাবি মেনে বা ইচ্ছা করে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে একটি দেশকে বিভক্ত করে দিয়ে যায়। দক্ষিণ এশিয়ার অগ্রগতিতে যে বিভক্তি এখনো একটি প্রধান বাধা হিসাবে বিরাজমান। তার পরে যুক্তরাষ্ট্র রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়ে পাকিস্তানে জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে দেয়নি। মার্কিন যুদ্ধজোটে সদস্য করে নিজ স্বার্থে সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে ব্যবহার করে যাদের ট্রাম্পকার্ড ছিল নির্মম সাম্প্রদায়িকতা, যার প্রকোপ থেকে উপমহাদেশ আজও মুক্ত হয়নি বরং তা গভীর হচ্ছে সম্প্রতি। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের ব্যর্থতায় ভারতও সেই মার্কিন চক্রান্তে ক্রোনি ক্যাপিটেলিজমের খপ্পরে পড়ে যার ফলে সাম্প্রাদায়িক কিছু দুর্বৃত্ত গণতান্ত্রিক ভারতের ক্ষমতায় আসীন হয়ে আছে। কথিত ইঙ্গ মার্কিন উদারবাদ ও সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে শেষ জীবনে রবীন্দ্রনাথ বলছেন- “সভ্যের বর্বর লোভ নগ্ন করল আপন নির্লজ অমানুষতা”। এ দেশে ব্রিটিশ শাসনের নির্মম অমানুষতা, ’৭১ এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি মদদে নজির বিহীন গণহত্যা ভুলে গিয়ে যারা মার্কিন তথা পাশ্চাত্য সভ্যতা, এর নির্বিকার সমাজমানস, কথিত উদার বাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তাদের নিয়ে কিছু বলতে চাই না। শুধু বলব স্বদেশের অধোগতির জন্য স্বদেশিদের দায় আছে ঠিকই, কিন্তু তা মূলত আরোপিত।
আমাদের দেশে এবং উপমহাদেশে প্রথমেই উল্লিখিত আমেরিকার চাপিয়ে দেয়া অগনতান্ত্রিক দুঃশাসনের ফলে সৃষ্ট দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা, সামাজিক বিশৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতিকে পাশ্চাত্য উদারবাদের তুলনার অপরিবর্তনীয় মনে করে কেউ, কেউ সে দেশ ঘুরে এসে বা ওখানে বাস করে সামাজিক শৃঙ্খলায় বিমোহিত হয়ে আমাদের হিতোপদেশ দিতে গিয়ে ভুলে যান সে দেশের শ্বেতাঙ্গ শাসকদের স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগলেই কী রকম হিংস্র তারা হয়ে উঠতে পারে দেশে-বিদেশে। মার্কিন শাসক গোষ্ঠীর কাছে মডারেট বলে পরিচিত ’৭১ এর খুনিরা এদেশে ক্ষমতায় বসলেও তাতে তাদের কোন আপত্তি নেই, বরং মনে হয় তারা খুশি। যুক্তরাষ্ট্রের এই “উদারতাবাদ” যে কোন কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ কি মানতে পারে? বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডকে বৈষম্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সৃষ্ট প্রধান প্রতিবন্ধকতা এবং আজকের এই সার্বিক অধোগতির কারণ হিসাবে যাঁরা মনে করেন তাঁরা সেই হত্যাকান্ডের প্রমাণিত মূল ইন্ধনদাতা ও হত্যাকারীকে এখনো রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া আমেরিকার চাকচিক্যময় বহিরঙ্গ ও আপাত উদারবাদের অনৈতিক অনুজ্জ্বল আলোয় একটিবারও কি আত্মানুসন্ধান করে দেখবেন না যে- ’৭১ বাংলাদেশেকে তার প্রকৃত চলার পথ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কতদূরে ঠেলে দিয়েছে? যুক্তরাষ্ট্রই পাকিস্তানকে গত ৭৫ বছর ধরে মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্টের চাপে, গণতন্ত্রহীন অবস্থায় একটি জঙ্গি ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। ’৪৭ সাল থেকে সংখ্যালঘূ শূন্য করে ফেলার পরেও কোনদিন পাকিস্তানকে এই নির্মমতা নিয়ে চাপ দেয়নি, কেননা পাকিস্তান ছিল মার্কিন আজ্ঞাবহ মিত্র। সম্প্রতি মোদিকে দিয়ে গান্ধী নেহেরুর জোটনিরপেক্ষ ভারতকে প্যাসিফিক যুদ্ধ জোটের সদস্য করে ক্রমে পাকিস্তানের মত একটি থিওক্র্যাটিক বা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র তৈরির পশ্চাদপদতার পিচ্ছিল পথে নিয়ে যাচ্ছে। পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক অবস্থান ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায় না, শতাব্দি ধরে তা মৌলিকভাবে অপরিবর্তিত হতে থাকে। মুনাফার প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে কৌশল পরিবর্তন করে মানবিকতার মুখোশ পরে আর তাতেই আমরা অতি উৎসাহিত হয়ে পড়ি। তাৎক্ষণিকতার বিবেচনায় মৌলিক ভাবনা পাল্টানো যায় না। পুঁজিবাদের অসম বিকাশের অনিবার্য প্রক্রিয়ায় একে এর প্রাথমিক পর্যায়ের উদারবাদ ও ইহজাগতিকতার প্রোজ্জ্বল আলোয় নয়, দেখতে হবে সম্প্রতি ইরাকে, লিবিয়ায়, সিরিয়ায় ও অনত্র তার নয়া ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের অনালোকিত বদ্ধ গলির ম্লান আলোর অপচ্ছয়ায়। যার সর্বশেষ উদাহরণ হলো গাজার নির্মম শিশু ও নারী হত্যার নারকীয় চিত্র। উন্নত পাশ্চাত্য প্রবাসীর চোখে বা সেখান থেকে সদ্য ঘুরে আসা কোনো পর্যটকের মোহ অঞ্জন মাখা দৃষ্টিতে নয়, দেখতে হবে সমাজ ও সভ্যতার স্বতঃপরিবর্তনের সর্পিল কিন্তু দ্বান্দ্বিক বিকাশের পথে।
লেখক : সভাপতি, চট্টগ্রাম দক্ষিণ কমিটি, সিপিবি
Login to comment..