প্রতারিত মেহনতিরা, পরাস্ত করুন বিজেপিকে
বাংলাদেশে মেহনতিরা যেমন ভালো নেই ক্রমাগত শোষণ-বৈষম্য-নিপীড়ন বৃদ্ধির কারণে, তেমনই ভারতেও মেহনতিদের দুদর্শা আরো বাড়ছে। এবারের নির্বাচনে মোদির বিজেপি সরকার আবার ক্ষমতায় এলে এই দুর্ভোগ আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। সেই আশঙ্কাই উঠে এসেছে এ লেখায়
ভারতে গত ১০ বছরে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের জমানায় শ্রমিকদের রুটিরুজি এবং কাজের পরিবেশের ওপর নেমে এসেছে নিরন্তর আক্রমণ। শ্রমিকদের বহু কষ্টার্জিত অধিকারগুলিকে ক্রমাগত সংকুচিত করার চেষ্টা হয়েছে, যেন বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলির লাগামছাড়া শোষণ চালিয়ে যাওয়ার সুবিধা হয়।
২৯টি চালু শ্রম সংক্রান্ত আইনকে বিজেপি সরকার মাত্র চারটি শ্রম কোডের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রচার করা হচ্ছে যে, শ্রম কোড চালু হলে ন্যূনতম মজুরি একটা সর্বজনীন চেহারা নেবে, সামাজিক নিরাপত্তার রক্ষাকবচ আরও বাড়াবে এবং কাজের পরিবেশের উন্নতি ঘটবে। এসবের চেয়ে বড় মিথ্যা আর কিছুই হতে পারে না।
২০১৯ সালে মোদি সরকার ক্ষমতায় ফেরার পরপরই মজুরি সংক্রান্ত কোড পাস করানো হয়েছিল। তবে এই কোড আদপেই সর্বজনীন ন্যূনতম মজুরির ব্যবস্থা করেনি, কারণ এতে বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য বিভিন্ন ধরনের মানদণ্ড প্রয়োগ করা হয়েছিল। মজুরি সংক্রান্ত কোড অসংগঠিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরিও নিশ্চিত করে না। পঞ্চদশ ইন্ডিয়ান লেবার কনফারেন্স (আইএলসি)-র সুপারিশ মাফিক ন্যূনতম মজুরি ধার্য করার ফর্মুলাটি শুধুমাত্র বিধির (জঁষবং) মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু মূল আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মোদি সরকার যে ‘ফ্লোর ওয়েজ’ ধার্য করেছিল তা ২০১৭ সালে ছিল ১৭৬ টাকা। ২০১৯ সালে ফ্লোর ওয়েজ বাড়িয়ে করা হয়েছিল ১৭৮ টাকা। মানে বৃদ্ধি মাত্র ২ টাকা!
শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ বিষয়ক চালু শ্রম আইন, সেইসব আইন প্রয়োগ ও কার্যকর করার ব্যবস্থাসমূহ- এসব কিছুকেই পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত কোডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চালু আইনগুলিতে যেসব ব্যবস্থার কথা বলা ছিল নতুন কোডে সেগুলির গুরুত্ব দারুণভাবে হ্রাস করা হয়েছে অথবা সেইসব ব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে বদলে ফেলা হয়েছে, যেন নিয়োগকর্তাদেরই সুবিধা হয়।
নতুন কোড মারফৎ কাজের সময় বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টাও করা সম্ভব। এছাড়াও, নমনীয়তার অজুহাতে নির্দিষ্ট মেয়াদের নিয়োগ, চুক্তিভিত্তিক কাজ ইত্যাদি নানা ধরনের অস্থায়ী ও দুর্বল ধরনের নিয়োগে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে এবং সেগুলি আইনসিদ্ধ করা হয়েছে। এভাবে নিয়োগের সম্পর্কের চরিত্রের ক্ষেত্রেই বড় ধরনের রদবদল ঘটানো হয়েছে। ফলে একদিকে যেমন শোষণ বেড়েছে, আবার একই কাজের জায়গায় একই ধরনের কাজ করা শ্রমিকদের ভিন্ন ভিন্ন মজুরি ও ভিন্ন ভিন্ন কাজের পরিবেশের ভিত্তিতে বিভাজিত করে ফেলা হয়েছে। শ্রমিকেরা যাতে ইউনিয়ন গঠন করে যৌথ সংগ্রাম গড়ে তুলতে না পারেন সেজন্যই এমন বিভাজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চুক্তিভিত্তিক ও পরিযায়ী শ্রমিকেরা। আন্তঃরাজ্য পরিয়ায়ী শ্রমিক আইন পরিযায়ী শ্রমিকদের কিছু নিরাপত্তা দিত। সেটাকেও এই কোডের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে এই আইনের সবরকম নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাগুলির গুরুত্ব হয় খর্ব করা হয়েছে নতুবা পুরোপুরি ছেঁটে ফেলা হয়েছে।
শিল্প সম্পর্ক সংক্রান্ত কোডের কারণে শ্রমিকেরা তাঁদের সংগঠন করার ও যৌথ সংগ্রাম গড়ে তোলার মৌলিক অধিকার থেকেই বঞ্চিত হয়েছেন। এই কোডের কারণে ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে। রেজিস্ট্রারদের হাতে খুশিমতো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যার সাহায্যে তারা ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দিতে পারেন। এতে করে নিয়োগকর্তারা ‘যখন খুশি ছাঁটাই করা’র জমানা চালু করতে পারবেন। কোডে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে যৌথ সংগ্রাম গড়ে তোলার কাজটা একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই কোড কর্তৃপক্ষকে এমন ক্ষমতা দিয়েছে যার সাহায্যে তারা বেশিরভাগ ধর্মঘটকেই ‘বেআইনি’ ঘোষণা করতে পারবেন।
সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোডে শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট কোনও সুবিধার প্রস্তাব করা হয়নি। এতে সামাজিক নিরাপত্তার সুনির্দিষ্ট কোনও প্রকল্পও নেই। প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দের ব্যবস্থাও নেই। বস্তুত এই কোড বিরাট সংখ্যক শ্রমিকদের জন্য চালু সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত অধিকার ও ব্যবস্থাগুলিকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে। বিড়ি শিল্প, লৌহ আকরিকের খনি, অভ্রের খনি, চুনাপাথরের খনি এবং ডলোমাইটের খনি — এসব শিল্পের শ্রমিকেরা ছিলেন সুনির্দিষ্ট আইনের আওতায় যে আইনগুলি তাঁেদর দিত সামাজিক নিরাপত্তাজনিত সুবিধা। এই সব আইনগুলিকে এখন সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জিএসটি চালু হওয়ার ফলে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অর্থ যোগানোর জন্য সেস আদায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নির্মাণ কর্মীদের জন্য বিল্ডিং অ্যান্ড আদার কনস্ট্রাকশন ফান্ড অ্যাক্টের আওতায় যে সেস আদায়ের ব্যবস্থা ছিল এবং অভিযোগের প্রতিকারের যেসব ব্যবস্থা ছিল সেগুলির গুরুত্বও দারুণভাবে হ্রাস করা হয়েছে।
ইপিএফ এবং ইএসআইয়ের মতো সময়ের পরীক্ষায় উতরে যাওয়া চালু সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রকল্পগুলির আরও সংস্কার করার অজুহাতে সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কোডটি আসলে এই প্রকল্পগুলি তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়ার সূচনা করেছে। গোটা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের পক্ষ থেকে যে গ্র্যাচুইটির দাবি তোলা হয়েছে, এই কোডে সেই দাবিকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ন্যূনতম ইপিএস পেনশন মাসিক সামান্য ১০০০ টাকা থেকে আরও বাড়ানোর দাবি বিজেপি সরকার পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছে। এমনকী এই সামান্য টাকাটাও ঠিকমতো দেওয়া হচ্ছে না।
যে কোনও আইন কার্যকর করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হলে প্রাথমিক প্রয়োজন হল পরিদর্শন ও নজরদারি। স্ব-শংসাপত্র ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে শ্রম কোড পরিদর্শন ও নজদারির চালু ব্যবস্থাগুলিকে পুরোপুরি ভেঙে ফেলেছে। শ্রম কোডে অনেক বেশি সংখ্যায় ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে’ জাতীয় ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শ্রম কোড পাস করানো হয়েছিল সংসদে। অথচ ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে’ জাতীয় ব্যবস্থা থাকার ফলে শ্রম সংক্রান্ত কোনও বিষয় পরিবর্তনের জন্য আর সংসদে যাওয়ার দরকার হয় না। উল্টে এই জাতীয় ব্যবস্থা নির্বাহী (এগজিকিউটিভ) বিভাগের ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সংসদে না গিয়েই পরিবর্তনগুলি করে ফেলার ক্ষমতা সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে।
মোদি সরকার যে শ্রম কোড প্রণয়ন করেছে, তা আসলে করা হয়েছে যাতে বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলি ‘সহজে ব্যবসা করতে পারে’ তা নিশ্চিত করার জন্য। শ্রমিকদের বহু কষ্টার্জিত, বিদ্যমান বুনিয়াদি অধিকারসমূহের ওপর আক্রমণ নামিয়ে এনে এবং তাদের লাগামছাড়া শোষণের সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে মোদি সরকার বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলির সহজে ব্যবসা করার অধিকার কায়েম করতে চায়।
সরকারি কর্মচারীদের নতুন পেনশন নীতি বাতিল করা এবং পুরনো পেনশন প্রকল্প চালু করার দাবির একরোখা বিরোধিতা করে চলেছে বিজেপি।
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও তাদের সহায়কদের পারিশ্রমিক ২০১৮ সাল থেকে এক টাকাও বাড়ায়নি মোদি সরকার। মোদি সরকারের দশ বছরের শাসনকালে আশাকর্মী এবং মিড ডে মিল কর্মীদের পারিশ্রমিক একবারের জন্যও বাড়েনি।
প্রায় ৮০ লক্ষ শ্রমিক, যাঁদের বেশিরভাগই মহিলা, তাঁদের ভারত সরকারের নানা প্রকল্পে নিয়োগ করা হয়েছে। অথচ ‘শ্রমিক’ হিসাবে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। ইন্ডিয়ান লেবার কনফারেন্স (আইএলসি) ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুপারিশ করেছে যে, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও তাঁদের সহায়ক, আশাকর্মী, এনসিএলপির (ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার প্রজেক্ট) শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী, এধরনের সব প্রকল্পে কর্মরতদের ‘শ্রমিক’ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে, তাঁদের ন্যূনতম মজুরি দিতে হবে এবং সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধাগুলি দিতে হবে। অথচ এই সমস্ত সুপারিশ পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল যে, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও তাঁদের সহায়কদের গ্র্যাচুইটি দিতে হবে। ২ বছর পরেও শীর্ষ আদালতের এই নির্দেশ কার্যকর করা হয়নি। এই সব প্রকল্পের জন্য বাজেট বরাদ্দ মোদি সরকার নির্মমভাবে ছাঁটাই করেছে। মোদি সরকারের প্রথম বাজেটেই আইসিডিএসে বরাদ্দ ছাঁটাই করা হয়েছে ৫৫ শতাংশ, মিড ডে মিল কর্মসূচিতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে ৩০ শতাংশ এবং এনএইচএম প্রকল্পে বরাদ্দ ছাঁটাই করা হয়েছে ২০ শতাংশ।
বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে এই সব প্রকল্পগুলি উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। এগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে তুলে দেওয়া হচ্ছে বেদান্ত, পেপসিকো এবং পতঞ্জলির মতো বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থা এবং ইসকনের মতো কর্পোরেট স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে।
সারা বিশ্বের মধ্যে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার সবচেয়ে কম যেসব দেশে, ভারত তার মধ্যে অন্যতম। টানা কয়েক বছর কমার পর শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা বাড়তে দেখা গেছে। মোদি সরকার দাবি করছে এটা নাকি তাদের গৃহীত নীতির কারণেই হয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল, শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে বেতন বা মজুরি জোটে না এমন স্বনিয়োজিত ক্ষেত্র আরও বেশি দুর্দশার কবলে পড়ার ফলে। কোভিডের আগে, ৫০ শতাংশ নারী ছিলেন স্বনিয়োজিত। কোভিডের পর এই শতাংশ বেড়ে হয় ৬০। স্বনিয়োগ থেকে আয় প্রকৃত অর্থে এই পর্বে হ্রাস পেয়েছিল। কনফারেন্স অন ফিনান্স অ্যান্ড ইকনমি ইন ইন্ডিয়া-তে অর্থনীতিবিদেরা আলোচনা করে দেখিয়েছিলেন যে, ৫০ শতাংশের বেশি নারী স্বনিয়োজিত ক্ষেত্রে কর্মরত এবং তাঁদের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক নারী পরিবারে শ্রম দেন কিংবা পারিবারিক সংস্থায় কাজ করেন। এবং সেই কাজের বিনিময়ে তাঁরা কোনও মজুরি পান না।
মোদি সরকার দাবি করে আসছে যে, সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে তারা ১২ থেকে ২৬ সপ্তাহ করেছে। কিন্তু ঘটনা হল, এখন আরও বেশি বেশি সংখ্যায় মেয়েরা সেই ধরনের কাজে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন যেখানে কোনও মজুরি বা বেতন কিছুই পাওয়া যায় না। ৮২ শতাংশের বেশি নারী শ্রমিক রয়েছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে এবং তাদের বেশিরভাগই রয়েছেন কৃষিক্ষেত্রে। এঁরা সকলেই মেটারনিটি বেনিফিট অ্যাক্টের আওতার বাইরে। এরপরেও যাঁরা সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করছেন, তাদের একটা বিরাট অংশ আবার কর্মরত বেসরকারি ক্ষেত্রে চুক্তির ভিত্তিতে বা আউটসোর্স করা কাজে। এঁদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই মেটারনিটি বেনিফিট অ্যাক্ট কার্যকর করা হয় না। এরপর যদি পরিদর্শনের ব্যবস্থাও তুলে দেওয়া হয়, তাহলে এই সব নারী শ্রমিকদের অবস্থা আরও শোচনীয় হবে। আরও লজ্জাজনক বিষয় হল, সরকারের নিজস্ব প্রকল্পে কর্মরত লক্ষ লক্ষ আশাকর্মী ও মিড ডে মিল শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে ভারত সরকারই।
স্থায়ী পদে নিয়োগ কমছে, চুক্তিপ্রথায় নিয়োগ বাড়ছে সরকারি দপ্তরে এবং কেন্দ্রীয় পরিচালনাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলিতে স্থায়ী নিয়োগ ভীষণভাবে কমে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলিতে স্থায়ী পদে নিয়োগ কমেছে ২ লক্ষ ৭০ হাজার। ২০১৩ সালের মার্চে এই সব সংস্থায় কর্মী সংখ্যা ছিল ১৭ লক্ষ ৩০ হাজার। আর ২০২২ সালের মার্চে এই সংখ্যা কমে হয় ১৪ লক্ষ ৬০ হাজার। এই একই সময়পর্বে চুক্তিভিত্তিক এবং আউটসোর্স করা কাজের শ্রমিক সংখ্যা ১৯ শতংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। এটা বলা হচ্ছে যে, গত ১০ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলিতে প্রায় ৬৫ শতাংশ চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ করা হয়েছে।
৭টি কেন্দ্রীয় পরিচালনাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগে মোট কর্মীর সংখ্যা গত দশ বছরে কমেছে ২০,০০০এর বেশি। বিএসএনএল-এ কর্মীসংখ্যা কমানো হয়েছে ১ লক্ষ ৮০ হাজার। স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া এবং এমটিএনএল-এ একই সময়পর্বে ৩০ হাজারের বেশি চাকরি স্রেফ উবে গেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মীসংখ্যা ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে কমেছে প্রায় ১ লক্ষ। এর পাশাপাশি ব্যাংক মিত্র বা ব্যাংকের ব্যবসায়িক প্রতিনিধির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৫ লক্ষের বেশি। এই সংখ্যাটি স্থায়ী ব্যাংক কর্মীদের চেয়ে প্রায় চার গুণেরও বেশি। এবং ব্যাংক মিত্ররা আদৌ ব্যাংকের কর্মী হিসাবে স্বীকৃত নন। এই একই সময় পর্বে বেসরকারি ক্ষেত্রের ব্যাংকগুলির কর্মীসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
রেলে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমানো হয়েছে। ভারতীয় রেলে ৩ লক্ষের বেশি শূন্যপদ ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এই সব শূন্যপদের মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা বিভাগ এবং লোকো পাইলটের পদও। অন্যদিকে, রেলে এখন কাজ করছেন পাঁচ লক্ষেরও বেশি চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক। এমনকি নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত যেসব কাজ যেমন রেললাইন ঠিক রাখা, সিগন্যালিং ইত্যাদি, সেখানেও চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ করা হয়েছে। যত বেশি কাজের বোঝা ও চাপ বাড়ানো হচ্ছে, তত বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে এবং তত বেশি প্রাণহানি হচ্ছে।
চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক এবং আউটসোর্স করা কাজের শ্রমিকেরা স্থায়ী কর্মীদের মতো একই কাজ করছেন, অথচ তাদের দেওয়া হচ্ছে স্থায়ী কর্মীদের বেতনের একটা সামান্য অংশ মাত্র। একথা সকলেরই জানা আছে যে, বেসরকারি ক্ষেত্রে চাকরিতে সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেই। একইভাবে সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেই আউটসোর্স করা এবং চুক্তিভিত্তিক কাজে।
মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক গঠবন্ধনের প্রতিনিধিত্ব করে। সংযুক্ত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের তরফে বার বার আর্জি জানানো এবং ডেপুটেশন দেওয়া সত্ত্বেও এই সরকার তাদের শ্রমিক বিরোধী ও জনবিরোধী নীতিগুলি বদলাতে অস্বীকার করেছে। যদি শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে হয় তাহলে নয়া উদারবাদী নীতিসমূহের পরিবর্তন ঘটাতে হবে এবং তা একমাত্র অর্জন করা যেতে পারে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামগুলিকে আরও তীব্র করে। বিজেপি সরকার শুধুমাত্র নয়া উদারবাদী নীতিসমূহকে চালিয়ে যেতেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নয়, এই সরকারকে পরিচালনা করে তীব্র মাত্রার সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনকামী শক্তি আরএসএস।
সে কারণে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে আরও শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলার পূর্বশর্তই হলো বিজেপিকে পরাস্ত করা।
সৌজন্যে : মার্কসবাদী পথ
Login to comment..