ব্যাংকের সংযুক্তিকরণ: উদ্দেশ্য কী?
এম. এম. আকাশ
সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করছি যে, বাংলাদেশ ব্যাংক একটু নড়েচড়ে বসেছেন। গত ৫ ডিসেম্বর ২০২৩ সালেই বি.আর.পি.ডি-র (Banking regulation and policy Department) অধীনস্থ সকল তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সিইও বা নির্বাহী পরিচালককে ‘দ্রুত সংশোধনীমূলক কার্যক্রমের কাঠামো’ (Prompt Corrective Action Framework) শিরোনামে কিছু উদ্যোগ গ্রহণের জন্য চিঠি প্রদান করা হয়। ঐ চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয় যেন ঐ চিঠির আধেয় (Content) অনতিবিলম্বে প্রতিটি ব্যাংকের পরিচালক বোর্ডের সভায় পেশ করে আলোচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া শুরু করা হয়।
ঐ চিঠির আধেয়?
ঐ চিঠিতে কী বলা হয়েছিল? ঐ চিঠি জারির পর ব্যাংকিং সেক্টরে হৈ-চৈ পড়ে যায়। কারণ সেখানে ব্যাংকগুলিকে চারটি ভাগে বিভক্ত করার কথা বলা হয়। ব্যাংকগুলির আর্থিক স্বাস্থ্য টেকনিক্যাল পরিমাপ করে কতকগুলি ব্যাংককে এক নম্বর, কতকগুলিকে দুই নম্বর, কতকগুলিকে তিন নম্বর এবং সর্বশেষে কয়েকটিকে চার নম্বর ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে বলে জানানো হয়। সার্কুলারে এই চিহ্নিত করার স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতিগুলিও ছকের আকারে তুলে ধরা হয়। এই ছকটি নিম্নরূপ–
ছক– দ্রুত সংশোধনীমূলক কার্যক্রমের ম্যাট্রিকস (Matrix)
নির্দেশিকাসমূহ: পুঁজি ও নীট খেলাপি ঋণের সহনীয় মাত্রা ও “ট্রিগার পয়েন্ট”
উৎস: BPRD-Circular 2- Annexure-2 (বঙ্গানুবাদ-লেখক)
উল্লেখিত ছকে বর্ণিত মাপকাঠিগুলির পরিমাণগত সীমারেখা বা ট্রিগার পয়েন্ট নিয়ে নানা মত থাকলেও মাপকাঠি বা নির্দেশিকাগুলির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কারণ এগুলি যথাযথ সীমা অতিক্রম করে গেলে বা যথাযথ মাত্রায় না থাকার অর্থ হচ্ছে ব্যাংকগুলি যে ‘পরের ধনে পোদ্দারি’ করে থাকে (আমানতকারীদের পুঁজি বা সঞ্চয় ব্যাংকে জমা রয়েছে!) তার নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আর আইন অনুযায়ী প্রতিটি রাষ্ট্র ও প্রতিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবশ্যই জনগণের আমানতের নিরাপত্তা দিতে হবে। তাই পৃথিবীব্যাপী এসব মাপকাঠি ব্যবহার করে ‘ব্যাংকগুলির’ স্থিতিশীলতা মাপা হয় এবং মাপকাঠিগুলি লঙ্ঘিত হলে দ্রুত যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে হয়। কারণ দ্রুত হস্তক্ষেপ না করলে ব্যাংকগুলির স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হতে থাকবে। এবং সেক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের বা ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ অনেক দ্রুত সেখানে বাড়তে থাকবে। ফলে প্রশ্ন এটা নয় যে, “বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলি বা আর্থিক বাজারে হস্তক্ষেপ করছেন কেন? কেন বাজারের হাতে অন্যান্য কোম্পানির মত ব্যাংকগুলিকেও ছেড়ে দেয়া হচ্ছে না?” বাজার মৌলবাদের অনুসারীরা এইভাবে প্রশ্নটা রাখতে পারেন। কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে এক্ষেত্রে কী হবে বা কী হতে পারে এবং সেটা আদৌ কাম্য কি না?
বর্তমানে অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে, সেরকম ছেড়ে দিলে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংকে হয়তো লাল বাতি জ¦লবে অর্থাৎ তারা দেউলিয়া হয়ে যাবেন বা তারা নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে তাদের পুঁজি তাদের প্রাপকদের মাঝে বণ্টন করে দিতে বাধ্য হবেন, সেটাও না পারলে মালিককে তখন জেলে যেতে হতে পারে। অথবা বিশ্ববাজারের কোনো বহুজাতিক বোয়াল বা দেশীয় বাজারের বড় রাঘব বোয়াল বা মাঝারি শৈল জাতীয় ব্যাংকগুলি যদি একটি পুঁটি ব্যাংককে এক লহমায় গ্রাস করা লাভজনক মনে করে– তাহলে সেটাও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকটির একধরনের ভবিতব্য হতে পারে। তখন বিপদগ্রস্ত ব্যাংকটি অন্য একটি সবল ব্যাংকের সঙ্গে আংশিক সংযুক্তি বা পূর্ণ সংযুক্তির মাধ্যমে নতুন বড় ব্যাংক তৈরি হতে পারে। এভাবেও অনেক সময় ব্যাখ্যা করা হয়। এটাকে আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ‘সংযুক্তি’ (Merger বা Amalgamation) বলে বর্ণনা করা হয়। নিয়ন্ত্রণহীন পুঁজিবাদী অবাধ প্রতিযোগিতার এটি একটি চিরন্তন নিয়ম। এই নিয়মকে কেউ কেউ নাম দিয়েছেন সৃজনশীল ধ্বংস (Creative Destruction)। কিন্তু অর্মত্য সেনের মতে এটি হচ্ছে এক ধরনের ডারউইনীয় বাজার নিয়ম। অর্থাৎ এই হৃদয়হীন নিয়মটি হচ্ছে– ‘Struggle for Existence and Survival of the Fittest’
সুতরা বি.আর.পি.ডি-এর ২০২৩ সালে সার্কুলারে আর্থিকখাতের প্রতিষ্ঠানগুলি তথা ব্যাংকের স্বাস্থ্য মেপে ব্যাংকগুলিকে ৪ ভাগে বিভক্ত করার উদ্দেশ্য দুরকম হতে পারে। উদ্দেশ্য হতে পারে, যোগ্যতা অনুযায়ী ব্যাংকগুলির সংশোধন করে তাদের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা। এটাই আর্থিক খাতের সংস্কারের প্রচলিত সাধারণ নীতি বা লক্ষ্য। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা যদি ভেতরে ভেতরে বাজার মৌলবাদী হন তাহলে তারা চাইবেন এইসব নীতি কার্যকরী করে ব্যাংকের সংখ্যা কমাতে এবং বৃহৎ গুটিকয়েক ব্যাংক তৈরি করবেন, যাদের স্বাস্থ্য হয়তো অপেক্ষাকৃত ভালো হতেও পারে না-ও হতে পারে, কিন্তু তারা হবেন ব্যক্তি মালিকানাধীন বিশাল একচেটিয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এজন্য প্রথমে সংশোধন ও সংস্কারের কর্মসূচির কথা বলা হবে; তারপর তা ব্যর্থ হলে ‘ছোটর সঙ্গে বড়র’ সংযুক্তির দিকে তা ধাবিত হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আসলেই সেরকম আধুনিক সংযুক্তির কোনো সম্ভাবনা বর্তমানে বাংলাদেশে আছে কি? তথাকথিত উন্নত পুঁজিবাদী ‘সৃজনশীল ধ্বংস’ বাংলাদেশে সম্ভব কি না?
এমনকি আমেরিকাতেও আমরা দেখেছি ২০০৮ সালের সংকটের সময় রাষ্ট্র ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে বৃহৎ দেউলিয়া প্রতিষ্ঠানগুলিকে বেল-আউট করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তখন বাজারের নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতার আদর্শের দোহাই বুর্জোয়া সভ্য রাষ্ট্র দিতে পারে নি, শক্তিশালী পুঁজি রাষ্ট্রের ঘাড় ধরে রাষ্ট্রের কাছ থেকে ‘ভর্তুকি’ আদায় করে নিয়েছিল। জনগণের টাকা ব্যবহার করে দেউলিয়া ধনী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেল-আউট করা হয়েছিল।
২০২৩ সালের দ্রুত সংশোধনী
কার্যক্রমের আধেয় কী ছিল?
প্রথমে ২০২৩ সালের সার্কুলারে বি.আর.পি.ডি কতকগুলি দূরদর্শী (Prudential) প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে–
১। বিভিন্ন মাপকাঠির মান উদ্ধারের যে পরিকল্পনা ব্যাংকের পরিচালকমণ্ডলী অনুমোদন করেছেন তা কার্যকরী করা। অথবা সেরকম পরিকল্পনা না থাকলে তা অবিলম্বে প্রণয়ন করা।
২। ব্যাংকের পুঁজি সংরক্ষণের জন্য ব্যাংক আপাতত: মালিক বা শেয়ার হোল্ডারদের কোনো ডিভিডেন্ড দেবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ অনুমতি না দিলে বিদেশি ব্যাংকগুলিও তাদের মুনাফার অংশ রেমিট্যান্স হিসেবে বাইরে পাঠাবেন না।
৩। ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বৃদ্ধি যেন কম হয়; প্রতি ক্যালেন্ডার বছরে যেন কোনোমতেই ১০ শতাংশের চেয়ে বেশি তা না বাড়ে তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪। ব্যাংকগুলির পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধিরও রাশ টেনে ধরতে হবে। কোনোক্রমেই বর্তমান বছরের ব্যয় যেন আগের বছরের ব্যয়ের চেয়ে ৮ শতাংশের বেশি না বাড়ে।
৫। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলিকে বছরের সব সময়ই নির্দিষ্ট সময় পর পর পর্যবেক্ষণের অধীনে আনবে এবং দেখবে তারা কতটুকু নিয়ম-কানুন মেনে চলছেন।
৬। তবে ২নং, ৩নং বা ৪নং ইত্যাদি নিম্নতর গ্রেডের ব্যাংকগুলির জন্য আরো কঠোরতর নিয়ম-কানুন প্রণীত হয়েছে। বিশেষত: ৪নং গ্রেডের ব্যাংকগুলির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুর্বানুমতি ছাড়া কোনো নতুন আমানত জমা করা বা কোনো নতুন ঋণ প্রদানেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
ফলাফল কী হলো?
কিন্তু এসব নিষেধাজ্ঞা (restriction) বাধ্যতামূলক আদেশ (Manalatomy action) ও পদক্ষেপসমূহ (meanner) কি গত একবছরে কার্যকরী হয়েছে? আসল কথা হচ্ছে যদি সর্ষের মধ্যেই ভুত থাকে তাহলে সেই সর্ষে দিয়ে কি ভুত তাড়ানো সম্ভব। যদি প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিনিয়ত পরোক্ষ নিয়ন্ত্রক রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে এসব আইন কি কখনো পক্ষপাতহীনভাবে কার্যকরী হবে? তখন সম্মিলনের মাধ্যমে বৃহৎ বুর্জোয়াদের একচেটিয়া ক্ষমতা তৈরি হয়ে গেলে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ও রাষ্ট্র আরো আটকে যাবেন না?
এ কথা ঠিক আইনের লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে এযাবৎ অর্থঋণ আদালত খোলা ছিল। কিন্তু বৃহৎ ব্যবসায়ীরা তা থোরাই মেনেছেন। কেউ কেউ মনে করেন রাষ্ট্রের হাত অদৃশ্যভাবে হলেও আদালত পর্যন্ত প্রসারিত! সুতরাং আর্থিক খাতের সুস্বাস্থ্যের জন্য আগে সর্ব পর্যায়ে সেই ধরনের লোককে নির্বাচিত ও ক্ষমতায়িত করতে হবে, যিনি লোভ বা ক্ষমতার কাছে নতি স্বীকার না করে বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটি বাঁধতে পারবেন।
প্রথম পাতা
দেশে দ্রুত স্থিতিশীলতা আনতে হবে
শেয়ারবাজার কারসাজিতে লুটপাট কয়েক হাজার কোটি টাকা
‘জাতীয় সম্পদ রক্ষা ও মানব মুক্তির সংগ্রাম এগিয়ে নিতে হবে’
জাতীয় সঙ্গীত-পতাকা মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান নিয়ে ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াতে হবে
আন্দোলনে ওষুধ কারখানার শ্রমিকরা, উৎপাদন বন্ধ
ডেঙ্গু রোগী বাড়ছেই
মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা প্রশ্নে কোনো আপস নয়
‘কৌতুহলোদ্দীপক’
Login to comment..