ইতিহাসে বাংলা ভাষা ও বাঙালির মনন

মিজানুর রহমান সেলিম

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
প্রকৃতির মাঝে মানুষ টিকে থাকার জন্য যা কিছু সৃষ্টি করে তার সমষ্টিই সমাজ এবং মানব সৃষ্ট সমাজ জীবন থেকে উৎসারিত বোধই হলো সংস্কৃতি। আর এ দু’টো বিষয় সৃষ্টির নির্ভরতাই হলো মানুষের ভাষা। ভাষাই মানুষকে অন্য মানুষের সাথে এক ও অভিন্ন গ্রন্থিতে বেঁধে রাখে। মানুষ মানুষের সাথে যুথবদ্ধ হয়ে টিকে থাকার সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ভাষা সৃষ্টি করে এবং এই ভাষা মানুষের অস্তিত্বের সাথে এমনভাবে গ্রন্থিত হয় যা তাঁর সংস্কৃতি ও মননকেও নির্মাণ করে দেয়। তাই মানুষের মননের খোঁজ পেতে ভাষার খোঁজ করা জরুরি হয়ে পড়ে। এ সত্য পৃথিবীর সমস্ত ভূ-খণ্ডের সমস্ত মানুষের বেলায় একই রকম সত্য। তাই বাঙালির মননের খোঁজেও ভাষার খোঁজ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। মানুষের কাজ ও আচরণের মধ্যেই ভাষার আসল খোঁজ পাওয়া যায়। বাজারে পান কিনতে এখনও আমরা “কুড়ি” শব্দটি ব্যবহার করি। কুড়ি শব্দটি পানের গণনা করার পদ্ধতি হিসেবে চালু আছে। মূলত মানুষের হাত ও পায়ের কুড়ি আঙুলের সাথে কুড়ি শব্দটির সম্বন্ধ আছে। আদিকালে কুড়ি পর্যন্তই ছিল সংখ্যা গণনার দৌড়। কুড়ি, পন, গন্ডা, গুড়ি এসব সংখ্যা অস্ট্রিক ভাষা-ভাষীদের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। আসাম, মালয়, তালৈঙ, খাসিয়া, কোল, সাওতাল, নিকোবর প্রভৃতি ভূমির বিভিন্ন অধিবাসীরা যেসব ভাষায় কথা বলতো তা একই পরিবারভুক্ত। এই বিরাট ভাষা পরিবারের নাম “অস্ট্রিক”। অস্ট্রিক ভাষার বিস্তৃতি উত্তর ভারতের অনেক জায়গাতেই ছিল। পরের যুগে অস্ট্রিক ভাষাকে দ্রাবিড় ও আর্য্যভাষা পশ্চিম দিকে এবং ভোস্ট বর্মি ভাষা পূর্বদিকের অধিকাংশ জায়গাতেই গ্রাস করে ফেলে। নানা প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক কারণে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো অস্ট্রিক ভাষা কিছু লোকের মুখের বুলির মধ্যে এখনো টিকে আছে। উত্তর ও পূর্ব ভারতের কাশ্মীর, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, বিহার, উড়িষ্যা, কর্নাটক, আসাম, বাংলা, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ বিশেষভাবে গোটা গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়ে তখন আর্য্যভাষার প্রতাপ। এই আর্য ভাষাই আয্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাহন। আর্যভাষার প্রধান রূপ “সংস্কৃত; প্রকৃত জনের মধ্যে প্রাকৃত।” এই প্রাকৃতের অপভ্রংশ থেকে বর্তমান উত্তর পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষার উৎপত্তি। বাংলা ভাষা তার মধ্যে অন্যতম। যেসব শব্দের সঙ্গে বাঙালির দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সম্বন্ধ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং অবিচ্ছেদ্য, সেসব শব্দগুলো হলো, খাঁ খাঁ, বাখারি, বাদুড়, কারি (ছেড়া কাপড়ের টুকরা) ঠোঁট, পাগল, বাসি, ছাঁচ, কলি (চুন) ছোট, পেট, ঝাড়, ঝোপ, ডোম, চোঙ্গা, বোয়াল, করাত, দাও, বরজ, লাউ, লেবু, কলা কামরাঙ্গা, ডুমুর প্রভৃতি সব বাংলা শব্দই মূলত অস্ট্রিকগোষ্ঠির ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ। বোধ হয় গঙা ও বঙ্গ নাম দুটিও একই অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠির দান। বাংলাদেশে আজও লোকজন কুকুর ডাকার সময় চুচু বা তুতু বলে। কুকুরের অস্ট্রিক প্রতিশব্দ চুচু থেকে এ শব্দটি বাঙলায় এসেছে। অস্ট্রিক ভাষার মতোই দ্রাবিড় ভাষা থেকেও আর্যভাষায় সংস্কৃতে, প্রাকৃতে অপভ্রংশে অনেক শব্দ, পদ রচনা ও ব্যাকারনরীতি ঢুকে পড়েছে। এ থেকে প্রমান হয়, আর্য ভাষাভাষী লোকেরা দ্রাবিড় ভাষাভাষী লোকদের সংস্পর্শে এসেছিল। প্রাচীন ও বর্তমান বাঙলায় অসংখ্য জায়গায় নাম এবং নামের উপান্ত হলো “ড়া’ “গুড়ি” জুলি, জুড়, যেমন: বগুড়া, হাওড়া, বিষড়া, বাঁকুড়া, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, নয়নাজুলি, নাড়াজোল, ডোমজুড়, ভিটা, কুন্ডু প্রভৃতি শব্দ দ্রাবিড় ভাষা থেকেই এসেছে। এভাবে ভাষা নানা পথ ঘুড়ে নানা ভাবে রূপান্তরিত হয়ে অবিরাম তার রূপ বদল করে। অনন্ত সমাজ জীবনের মতো ভাষার জীবনও নিয়ত বহমান তাই ভাষা মনুষ্য সমাজে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার একটি উপাদান ও উপায়ের মতোই জন্ম নেয় ও বিকশিত হয়। ভাষার উদ্ভব, জন্ম ও বিকাশের পরম্পরার দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ভাষা অবিরাম বদলায়। কোনো এক রূপে ভাষা স্থির থাকে না। ভাষার কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখী বদলের গতিপথ থাকে না। সুনির্দিষ্ট বাস্তবতা ভাষার যে বদলকে প্রভাবিত করে এবং অনিবার্য করে তোলে সে পথেই ভাষা অগ্রসর হয় এবং পরিবর্তিত রূপ গ্রহণ করে। তবে ভাষা বদলেরও নিয়ম আছে, খামখেয়ালে ভাষা বদলায় না। মনুষ্য সমাজ ও মনুষ্য জাতির নানা রকমের অদল বদল হয়, তাও ভাষার বদলে প্রভাব ফেলে। নদ নদী পাহাড় পর্বত প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশও ভাষা বদলে ভূমিকা রাখে। মানুষের কণ্ঠে, কবিদের কাব্যে নানা ভাব প্রকাশেও ভাষার বদল ঘটে। এসব বদলের কাল ও প্রকৃতি বিচার করলে বাংলা ভাষাকে সাধারণত তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। প্রথমটি প্রাচীন বাঙলা ভাষা, যার প্রচলন ছিল ৯৫০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, এর পরে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দেড়শো বছর সময়ে বাঙলা ভাষার কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় স্তরটি মধ্যযুগের বাংলা ভাষা। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে ভাষা পাই, তা মধ্যযুগের বাংলা ভাষা। এ ভাষাও আজকের বাঙলা ভাষার মত নয়। তবে তার কাছাকাছি। এ ভাষায় লেখা সাহিত্য অনায়াসে পড়া যায় এবং বোঝা যায়। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয় আধুনিক বাংলা ভাষা। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলেও একে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রাচীন ভারতীয় আর্য্য ভাষা এভাবে বদলের পরম্পরায় দিনে দিনে বদল হয়ে এক সময় হয়ে ওঠে বাংলা ভাষা। প্রথম আর্যভাষা বদল হয়ে রূপ নেয় ‘পালি’ নামক এক ভাষায়। পালি ভাষায় বৌদ্ধরা তাদের ধর্মগ্রন্থ ও অন্যান্য গ্রন্থও লিখেছেন। পালি ভাষা ক্রমে পরিবর্তন হয়ে জন্ম নেয় ‘প্রাকৃত ভাষা’। প্রাকৃত ভাষা আবার বদলাতে থাকে। প্রায় হাজার বছর ধরে বদলাতে বদলাতে দশম শতকের মাঝখানে এসে একটি নতুন ভাষা উদ্ভব হয়। যার নাম বাঙলা, যা আমাদের বাঙলা ভাষা। আজকের বাঙলা ভাষা এভাবে সুদূর অতীত থেকে নানা নরগোষ্ঠীকে আশ্রয় করে, নানাসমাজ, নানান সভ্যতা ও সংস্কৃতির পথ পাড়ি দিয়ে এখনকার আধুনিক বাংলা ভাষায় রূপলাভ করেছে। এভাবে ভাষার রূপান্তর অবিরাম। তা থেমে থাকার নয়। এটাই ভাষার প্রকৃতি। মানুষের অস্তিত্বের সাথে ভাষার গভীর সংযোগই মানুষের মনন নির্মাণের ভিত্তি। তাই মননের ভিত্তির খোঁজ পেতে আদিকালের প্রাচীন ভাষাভাষী মানুষের প্রকৃতি ও ভাষার ধরন-ধারণের দিকে তাকাতে হয়। ভাষা হচ্ছে মানুষের চেতনার শরীর, ভাষা সৃষ্টি না হলে মানুষ মানুষ হয়ে উঠত না। মানুষের মননের যা কিছু তা ভাষার মাধ্যমেই প্রকাশ করে। তাই ভাষা ও মনন একটি অবিচ্ছিন্ন সত্তা। আমাদের বাঙলা ভাষা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অস্ট্রিক ভাষা-ভাষীদের প্রভাবই অনেক বেশি। তাই আদি অস্ট্রেলীয়দের প্রকৃতি নিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি অস্ট্রেলিয়রা খুব সরল ও নিরীহ প্রকৃতির লোক ছিল। তাঁরা সহজেই পরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করতো এবং আত্মসমর্পণ করে নিজেদের টিকিয়ে রাখতো। এই মানুষেরা একাধিক জীবনে বিশ্বাস করতো। তাঁরা মনে করতো কেউ মারা গেলে আত্মা কোন পাহাড়, গাছ বা অন্যকোন জন্মে আশ্রয় করে বেঁচে থাকে। এই ধারণাই পরে হিন্দু ধর্মে পুনর্জন্মবাদ ও পরলোকবাদে রূপান্তরিত হয়। তাঁরা পাহাড়-পর্বত, গাছ-ফল-মূল ইত্যাদির ওপর দেবত্ব আরোপ করে পূজা করতো। আমাদের দেশে ধর্ম, সমাজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আজও ধান, দুর্বা, কলা, হলুদ, সুপারি, পান, সিঁদুর ইত্যাদি মানুষের মননের একটা বিশাল জায়গাজুড়ে আছে। আসলে এসবই সেই প্রাচীন কৃষি সভ্যতা ও কৃষি সংস্কৃতির স্মৃতি বহন করে চলছে। মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য তার মননের প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে যেসব জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে বাঙালির উৎপত্তি তা গবেষক স্যার হাবার্ট রিজলি’ব গবেষণা থেকে দেখা যায়। বাঙালি মূলত মঙ্গোলয়েড ও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে উৎপত্তি। এসব দ্রাবিড়ভাষী লোকেরা কর্মঠ ও সংঘ শিক্তিতে দৃঢ় এবং শিল্প সুনিপুণ জাতি। তাদের মধ্যে যেমন ছিল ভাবালুতা তেমন তাদের ছিল তীক্ষ্ম বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে তাদের মধ্যে শ্রেণিবিভাগ বৃদ্ধি পায়। তাদের ছুতমার্গ ও শ্রেণি পার্থক্য আর্যভাষীদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। যোগধর্ম ও সাধনপদ্ধতি দাবিড়ভাষীদের মধ্য থেকেই আর্য এবং পৌরাণিক হিন্দুধর্মে সঞ্চারিত হয়। মূর্তিপূজা, মন্দির, পশুবলি একাধিক দেবদেবী, শিব-বিষ্ণু এতসব আচার আয়োজনের মননে রয়েছে দ্রাবিড় ভাষীদের প্রভাব। আর্যভাষীরা ভারতবর্ষে এসে খন্ড, ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত ভারতকে ধর্মরাজ্যপাশে একভাষা ও এক সংস্কৃতির গ্রন্থিতে বেঁধে দিয়েছে। শতাব্দির বিরোধ আর মিলনের ভেতর দিয়ে আর্যভাষী নর্ডিকেরা এক সমন্বিত জ্ঞান, সমন্বিত ধর্ম, সমন্বিত সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলে। এই সমন্বিত জনের নাম ভারতীয় জন। বেদ-ব্রাহ্মণের ধর্মের সঙ্গে পূর্বতন বিচিত্র বিভিন্ন ধর্মের আনন্দ, আচার-অনুষ্ঠান সব মিলেমিশে গড়ে ওঠে এক নতুন ধর্ম পৌরাণিত ব্রাহ্মণ ধর্ম। আগেকার বিচিত্র সভ্যতার উপাদান, উপকরণ, অঙ্গিভূত করে নতুন যে সভ্যতা গড়ে ওঠে তাই হলো ভারতীয় সভ্যতা। পূর্বের জনসস্কৃতির সৃষ্টি, পুরাণ, দেবতাবাদ, ভয়-বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণার সঙ্গে বেদ-ব্রাহ্মণের সংস্কৃতি মিলেমিশে গড়ে ওঠে ভারতীয় সংস্কৃতি। এই সমন্বিত জন সমন্বিত ধর্ম, সমন্বিত সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্মনীড় হল উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় প্রদেশ। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ট-সপ্তম শতক থেকে আর্যভাষা আশ্রয় করে গাঙ্গেয় প্রদেশের ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঢেউ বাংলাদেশে প্রথম বইতে শুরু করে। আদিম বাঙালি, আদি অস্ট্রেলীয় আর দ্রাবিড় মনের গড়ন ক্রমে এক নতুন রূপ পায়। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে সৃষ্টির পালা বদলে বাঙালির মননকে এই নতুন রূপে মেলে ধরে। প্রাচীন বাঙলার লোকপ্রকৃতি ও তাদের মনন কেমন ছিল তা বাঙলার বাইরের বিভিন্ন পর্যটকের মতামতে কিছুটা উঠে আসে। সপ্তম শতকে চীনদেশের পর্যটক ইউয়ান চোয়াং এর মতে এ অঞ্চলের লোকেরা স্পষ্টচারী, গুনবান এবং শিক্ষা সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবান। পুন্ড্রুবর্ধনের লোকেরাও জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগী, কামরূপের লোকেরা সদাচারী হওয়া সত্ত্বেও হিংস্র প্রকৃতির। তা¤্রলিপির লোকদের ব্যবহার রূঢ় হলেও তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনুরাগী, কর্মঠ ও সাহসী। সমতটের লোকেরা কর্মঠ। কর্ণসুবর্ণের লোকেরা ভদ্র, সচ্চরিত্র এবং তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের পোষকতা করতো। বিদ্যাচর্চায়ও বাঙালির অনুরাগের কথা অনেক প্রাচীন পুঁথিতেই পাওয়া যায়। বাঙালিরা ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে ভরতবর্ষে নানা জায়গায় এবং ভারতবর্ষের বাইরেও যাতায়াত করত। যদিও বাঙালির বদমেজাজ এবং কুঁদুলে স্বভাবের কথা কোন কোন প্রাচীন লেখক উল্লেখ করেছেন। স্বভাব মানুষের যেমনই হোক, সেটা বদ, কুঁদুলে অথবা শান্ত যাই হোক, সকল মানুষের ক্ষেত্রেই তার নিজের অস্তিত্বের সাথে ভাষার সংযোগকে কেহ আলাদা করতে পারে না। ভাষা শুধু নিজের সাথেই সংযোগ রক্ষা করে না বরং অন্য মানুষের সাথেও নিবিড় সম্পর্ক ¯’াপন করে একটি সামাজিক সত্তা নির্মাণ করে। যা ক্রমে ক্রমে একটি জাতি সত্তায় রূপ নেয়। এই জাতিসত্তাই বিকশিত হয়ে জাতীয়তার বোধ জাগ্রত করে। তাই যখন কোন জাতির ভাষা আক্রান্ত হয় তখন শুধু ভাষাই আক্রান্ত হয় না, আক্রান্ত হয় পুরো জাতির বিকাশমান জাতিসত্তা ও জাতীয়তাবোধ। ফলে জাগ্রত হয় জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চেতনা। ১৯৫২ সালে আমাদের ভাষার ওপর আঘাতকে মোকাবিলা করতে গিয়ে সমগ্র জাতিকে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে হয়েছে। যদিও সমগ্র জাতির মুক্তির আন্দোলন এখনও চলছে। বাঙালির জীবন ও মননকে বুঝতে হলে, বাঙলার প্রচলিত ইতিহাসের স্বরূপ জানা জরুরি। বহুকালব্যাপী এদেশে বিদেশি শাসকদের স্বার্থে তাদের যেসব ভাষা, শাস্ত্র ও সংস্কৃতি বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে তা বাঙালির প্রকৃত ইতিহাস এবং বাঙালির জীবন ও মনন সম্পৃক্ত নয়। প্রকৃতপক্ষে বাঙালি তাদের শাস্ত্রে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে, কারু ও চারুশিল্পে, পটে, ভাস্কর্যে ও তত্ত্বচিন্তায় স্বরূপে যেভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং তাদের স্বতন্ত্র জীবন ভাবনায় ও জীবন যাত্রায় যে মাহাত্ম্য ও মহিমার পরিচয় দিয়েছে তা শাসকগোষ্ঠী কখনই ইতিহাসের অংশ বলে মনে করেনি। অথচ বাঙালির ইতিহাস লোকধর্মের, লোকায়ত দর্শনের, লোকসাহিত্য, লোকশিল্পের, লোকসংগীতের, লোকবিশ্বাস ও লোকবিদ্রোহের ইতিকথারই অন্য নাম। যেথায় সকল বাঙালির মানস চিত্তে মানুষের মাহাত্ম্য-মহিমা ও মানবতাবোধকে ধারণ করেছে। বাঙালির এ ধরনের সমৃদ্ধ মনন সমাজের বিভেদ-বিভক্তি ও শ্রেণিভেদ বিলোপ করে একটি নির্বিশেষ বাঙালি সমাজ গড়ায় সহায়ক হতে পারে। লেখক: সভাপতি, বরিশাল জেলা কমিটি, সিপিবি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..