একুশে ফেব্রুয়ারি

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
বাঙালি জাতির ভাষার অধিকার আদায়ের মাস ফেব্রুয়ারি। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ফেব্রুয়ারি ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দুর্বার আন্দোলনে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত, রফিকসহ নাম না জানা অনেকের রক্তের বিনিময়ে বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। তারই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং একাত্তরে ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত পথ ধরেই এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। মাতৃভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির একটি গৌরবময় অধ্যায়, তেমনি মুক্তিযুদ্ধও বাঙালি জাতিসত্তার মূলমন্ত্র। একমাত্র বাঙালি জাতি ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দেয়নি, এত প্রাণ যায়নি অন্য কোনো দেশের স্বাধীনতার জন্যও। একুশ বাঙালির নিজের স্বকীয়তা নিয়ে জেগে ওঠার প্রথম বিদ্রোহ, যেখানে জাতি একটি চেতনাগত দিক-নির্দেশনা পেয়েছিলো। সেই চেতনা নিয়েই বাঙালি জাতি প্রথম ‘মুক্ত’ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। সমস্ত শৃঙ্খল ভেঙে জেগে ওঠার স্বপ্ন এই অমর একুশে। একুশের স্বপ্ন আর একুশের চেতনার মধ্য দিয়েই বাঙালি পেয়েছিলো মুক্তি সংগ্রামের দিশা। একুশ আমাদের ‘কোনোদিন মাথা নত না করতে’ শিখিয়েছে। একুশ কোনো বিমূর্ত ব্যাপার নয়, এটা একটা বাস্তব দর্শন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ভারত বিভক্তি এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের এক বছরের মাথায় বাঙালি অনুধাবন করতে পারে, একটি বিজাতীয় ভাষাকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদের নামই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। দুঃখজনক হলো, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত এবং স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ শতাব্দীতেও ভাষার নৈরাজ্য বা ভাষা-বিশৃঙ্খলা রোধ করা যায়নি। বাংলা ভাষা যদি সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে যেত; পুরোপুরি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেত-তাহলে ভাষা নিয়ে এ আক্ষেপের অবকাশ থাকত না বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাঙালি হলেও আমাদের দেশে ইংরেজি ভাষার আধিপত্য ও আগ্রাসন এতই তীব্র যে, বাংলা নয়, ইংরেজিই যেন বাংলাদেশের প্রধান ভাষা। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি বলে প্রতীয়মান হয়। বাঙালি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, বাংলা বর্ণমালা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে স্বীকৃতি পেয়েছে– এসব বাঙালির অনন্য অর্জন। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল বাঙালির এই অনন্য আয়োজন নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র করবে, জাতিসত্তা ও জাতিরাষ্ট্র বিপন্ন করে তোলার অপচেষ্টা করবে-তা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। তাছাড়া ভাষার মাস ও একুশের কথা বলতে গেলে মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা, উপেক্ষা এবং নৈরাজ্যের বিষয়টি বারংবার সামনে আসে। প্রতিবছরই আমরা বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের মনে করিয়ে দিতে চাই। ভাষা আন্দোলন যেমন গৌরবের তেমনিভাবে বইমেলাও বাঙালির ঐতিহ্য। ভাষার এই মাসে আমরা প্রত্যাশা করব, রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে। পাশাপাশি আদিবাসী গোষ্ঠীর কয়েকটি ভাষা বিলুপ্তির পথে-এমন খবর প্রায়ই শোনা যায়, যা পরিতাপের। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলো সংরক্ষণেরও উদ্যোগ নেয়া অপরিহার্য। বস্তুত ফেব্রুয়ারি মাস একদিকে শোকাবহ হলেও অন্যদিকে আছে এর গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। কারণ পৃথিবীর একমাত্র জাতি বাঙালি ভাষার জন্য এ মাসে জীবন দিয়েছিল। আর তাই দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও স্বীকৃত। একুশের চেতনায় আছে জাতীয়তাবোধ, সর্বজনীন বিশ্ব মানবিকতা, গণতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও শোষণ মুক্তির প্রেরণা। বাঙালি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ার আধার একুশ। হাজার বছরের লালিত সংস্কৃতি একে সমৃদ্ধ করেছে। একুশে আমাদের রাজনীতির নিশানা, মুক্তি-সংগ্রামের অনন্ত প্রেরণা। বাঙালি জাতি যে সাংস্কৃতিক মহাবিপ্লবের কাছে নিজেকে নিয়ে যাবে, একুশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনা তার বিনির্মাণে অন্যতম মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। এটাই একুশের প্রধান ও প্রথম অর্জন।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..