বিপ্লবী পরিবারে জন্ম
আজ থেকে একশত বছর আগে ১৯২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সিলেট শহরের পুরান লেনের পৈতৃক বাড়িতে কমরেড হেনা দাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পিতা আইনজীবী সতীশ চন্দ্র দত্ত। মাতা মনোরমা দত্ত। সতীশ চন্দ্র দত্তের আদি বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই। মনোরমা দত্তের আদিবাড়ি ছিল হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার নরপতি গ্রামে। সতীশ দত্ত ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। স্নাতকোত্তর পাস করার পর আইনে স্নাতক করে সিলেট বারে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। তিনি সিলেট পৌরসভার নির্বাচিত কাউন্সিলর ছিলেন। ১৯৩০ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন।
সতীশ ও মনোরমা দম্পতির আট সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন হেনা দাস। ছয় পুত্র, দুই কন্যার প্রথম তিনজনের একজন অকাল প্রয়াত এবং অন্য দুজন রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হননি। শেষের পাঁচজন বিংশ শতাব্দির ত্রিশের দশক থেকে বাংলা, আসাম, সুরমা উপত্যকা ও সিলেট জেলায় স্বদেশি আন্দোলন, কমিউনিস্ট ও বামপন্থি আন্দোলনের অগ্রগণ্য সংগঠক ছিলেন।
সতীশ ও মনোরমা দম্পতির চতুর্থ সন্তান বারীন দত্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন সশস্ত্র জাতীয় বিপ্লবী হিসেবে। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত জেলে থাকা অবস্থায় কমিউনিস্ট মতাদর্শ গ্রহণ করেন। জেল থেকে বের হয়ে পার্টির নির্দেশে চা শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলেন। সিলেট জেলা পার্টির নেতৃত্ব দেন। নানকার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়ার যুগে নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি আব্দুস সালাম নামে খ্যাত।
পঞ্চম জন রবীন্দ্র কুমার দত্ত সশস্ত্র জাতীয় বিপ্লবী ছিলেন। তিনিও কমিউনিস্ট মতাদর্শ গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে কলকাতায় গিয়ে শ্রমিক আন্দোলনের ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ষষ্ঠ জন ছিলেন সুরমা উপত্যকা ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সত্যব্রত দত্ত। ৪৭ এর পর তিনি ভারতে চলে যান। সেখানে সাংবাদিকতা করেন। ষাটের দশকের শেষে মাওবাদী সিপিআই (এম-এল) প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সুব্রত দত্ত শংকু সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন এর চারু মজুমদারের পর দ্বিতীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৯ নভেম্বর পুলিশের সাথে লড়াইয়ে সুব্রত দত্ত শংকু শহীদ হন। সপ্তম জন দেবব্রত দত্ত সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াডের সদস্য এবং ছাত্র ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। অষ্টম জন হেনা দত্ত।
রাজনীতিতে হাতেখড়ি
হেনা দাস তাঁর ভাইদের অনুসরণ করে স্কুলজীবনেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রবেশ করেন। ১৯৩৬ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় টিফিন পিরিয়ডে সমমনা সহপাঠীদের নিয়ে আলোচনা করতেন কিভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা যায়। সেই চিন্তা থেকেই সে বছরই কংগ্রেসের মহিলা সংঘের স্বেচ্ছাসেবিকা হিসেবে নাম লেখান। হেনা দাস তাঁর আত্মজীবনী ‘চারপুরুষের কাহিনী’তে লিখেছেন-
“যখন ৮ম শ্রেণিতে পড়ছি তখন আমরা আট-দশজনের একটা দল ছাত্রীদের মাঝে কাজ করার জন্য নিজেদের তৈরি করতে শুরু করেছি সক্রিয়ভাবে। প্রায় প্রতিদিন টিফিন পিরিয়ডে মাঠের এক কোণে আমরা গোল হয়ে বসে যেতাম নানা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায়। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য আমাদের কী কী বিষয় কিভাবে বলতে হবে, ছাত্রীদের সমস্যা কী কী, তা নিয়ে কিভাবে ছাত্রীদের সংগঠিত করবো, কিভাবে বক্তৃতা দেব, কী কী বই আমরা পড়ব ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হত।”
১৯৩৭ সালেই হেনা দাস আরো কয়েকজন বন্ধুসহ ‘গার্লস্ গাইড’-এ যোগ দেন। কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘নিবন্ধন উৎসব’-এ ব্রিটিশ পতাকা ইউনিয়ন জ্যাককে অভিবাদন ও ব্রিটিশ রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়ে সাহসিকতার সাথে গার্লস্ গাইড পরিত্যাগ করেন। ১৯৩৮ সালে সুরমা উপত্যকা ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হলে তাঁর স্কুল গ্রুপের সকলকে নিয়ে তাতে যোগ দেন। এসময় কালে শরৎচন্দ্রের নিষিদ্ধ ঘোষিত উপন্যাস ‘পথের দাবী’ তাঁর হাত আসে। বিপ্লবী দলের কর্মকাণ্ড ও বিপ্লবী নেতা সব্যসাচী তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। ম্যাক্সিম গোর্কীর ‘মা’, হ্যারিয়েট বিচের ‘আংকল টমস্ কেবিন’ পাঠ করে তিনি নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রেরণা পান।
নবম শ্রেণিতে পড়াকালে তাঁদের স্কুলের পুরো গ্রুপটিকেই কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে ‘পাঠচক্রে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সপ্তাহে দু’দিন পাঠচক্র বসতো এবং তা পরিচালনা করতেন প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতির্ময় নন্দী। ১৯৩৯ সালে দশম শ্রেণিতে পড়াকালে স্কুল ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ লিখেন- ‘ছাত্রসমাজ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে’।
১৯৪০ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন উত্তীর্ণ হন। তাঁদের পাঠচক্রের অন্যতম সদস্য কনক পুরকায়স্থ সে বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা-বিহার-আসামের মধ্যে যৌথ মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৩৯ সালে ছাত্রীদের রাজনীতিতে অধিক অংশগ্রহণ উৎসাহিত করার জন্য শুধুমাত্র ছাত্রীদের জন্য ‘গার্ল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করা হয়। জিএসএ’র শাখা গঠনের জন্য হেনা দাস আসাম ও সুরমা উপত্যকায় ব্যাপক সফর করেন। সিলেটের ছাত্রী কর্মীদের পাশাপাশি তিনি এসময় সাথে পান শিলচরের অপর্ণা ধর (পালচৌধুরী) এবং শিলংয়ের অঞ্জলি দাস (লাহিড়ী)। ১৯৪২ সালে তিনি সিলেট মহিলা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ
ও সার্বক্ষণিক কর্মীজীবন গ্রহণ
সিলেট জেলা কমিউনিস্ট পার্টিতে প্রথম নারী সদস্য ছিলেন শশীপ্রভা দেব। ১৯৪২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে পার্টি জেলা কমিটির নেতা চঞ্চল শর্মা শপথবাক্য পাঠ করিয়ে ডা. কল্যানী দাস, হেনা দত্ত (দাস) ও মায়া গুপ্তা (দাস)’কে পার্টির সদস্যপদ প্রদান করেন এবং চারজনকে নিয়ে নারী শাখা (তখন সেল বলা হতো) গঠন করেন। এর পরেই হেনা দাস পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে সার্বক্ষণিক কর্মীজীবন বেছে নেন।
৪০-এর দশকে হেনা দাস একই সাথে সর্ব ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশন, গার্ল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, নবগঠিত নিখিল বঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি এবং পাশাপাশি সুরমা ভ্যালী কালচারাল স্কোয়াডের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। তবে নিখিল বঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির কাজকে প্রাধান্য দেন। তিনি লিখেছেন-
“যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, ফ্যাসিবাদের বিপদ ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট-কাছাড়েও মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গড়ার প্রয়োজনীয়তা ও জরুরি তাগিদ আমরা অনুভব করেছি।”
ছাত্রী কর্মীরা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গঠনকে প্রধান কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৪৩ এ মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে বাংলায় একুশ লক্ষের অধিক মানুষ মারা যায়। অসংখ্য নারী পরিবারচ্যুত হয়ে বারবণিতায় পরিণত হয়। দুর্ভিক্ষের সময় সারা দেশের ন্যায় সিলেট শহরে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির উদ্যোগে লঙ্গরখানা পরিচালিত হতো। দুর্ভিক্ষপীড়িত শিশুদের মায়েদের প্রতিদিন দুধ বিতরণের জন্য দুগ্ধ-বিতরণকেন্দ্র খোলা হয়েছিল।
সমিতির উদ্যোগে মহিলা কো-অপারেটিভ দোকান খোলা হয়েছিল। যার ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই নারী। মহিলা কো-অপারেটিভের দশ টাকার শেয়ার কিনে লভ্যাংশ থেকে আর্থিকভাবে উপকৃত হয়েছিলেন অনেকেই। নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য তাঁতকেন্দ্রসহ কুটির শিল্পকেন্দ্র খোলা হয়। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গড়ার জন্য হেনা দাস সুরমা ভ্যালীর শহরগুলোর বাইরে গ্রামাঞ্চলে মাসের পর মাস অবস্থান করেন। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গঠন করতে বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুবিলে মণিপুরী এলাকায় দুই মাস অবস্থান করেন। গ্রামীণ নারীদের সাথে কাজের অভিজ্ঞতার সারসংক্ষেপ করতে গিয়ে হেনা দাস লিখেছেন-
“গ্রামের মণিপুরী মানুষ বিশেষভাবে মেয়েদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য এবং তাদের জীবনের সাথে একাত্ম হওয়ার জন্য আমাদের বহু সাধনা করতে হয়েছে। পায়ের স্যান্ডেল পোঁটলা করে ঝোলা ব্যাগেই রেখে দিতে হয়েছে। তাদের মত করে কাপড়চোপড় পরতে হয়েছে। আমরা এগিয়ে গিয়ে মেয়েদের গৃহস্থালি কাজে বিশেষভাবে রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছি, প্রয়োজনে পুকুর থেকে কলসি করে জলও এনেছি, ছোট বাচ্চাদের আগলেছি, আদর করেছি, বাচ্চার নাকের সর্দি মুছিয়ে দিতেও দ্বিধা করিনি। এমনিভাবে ওদের সাথে মিশে সুখ-দুঃখের আলাপের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক দূরত্ব ঘুচে গিয়েছিল। আমরা পরস্পরকে আপন করে নিতে পেরেছিলাম।”
৪০-এর দশকে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আর দুর্ভিক্ষের অস্থির সময়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নেতৃত্বে গড়ে উঠে সুরমা ভ্যালী কালচারাল স্কোয়াড। আসাম ও সুরমা উপত্যকার বিভিন্ন শহরে দর্শনীর বিনিময়ে এ স্কোয়াড প্রদর্শনী করত। হেনা দাস ছিলেন স্কোয়াডের অন্যতম সদস্য। ১৯৪৫ সালের ৫-১০ মে নেত্রকোনা শহরে সর্বভারতীয় কৃষক সভার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষাধিক কৃষকের সমাবেশে বাইদ্যার গানের সুরে হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচিত একটি দুর্ভিক্ষের গান পরিবেশন করা হয়েছিল। সেই গানে কৃষাণের ভূমিকায় গান করেছিলেন উপমহাদেশের বিখ্যাত গায়ক নির্মলেন্দু চৌধুরী এবং কিষাণীর ভূমিকায় গান গেয়েছিলেন হেনা দাস।
৪০-এর দশকে হেনা দাস মুম্বাইয়ের পার্টি হেডকোয়ার্টারে ছাত্র কমরেডদের ২০ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেন। এসময় তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশীর সান্নিধ্য লাভ করেন। সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের আসাম রাজ্যের প্রতিনিধি হিসেবে নাগপুর ছাত্র কনভেনশনে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে দিল্লীতে এবং ডিসেম্বর মাসে মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের দশম ও একাদশ সম্মেলনে আসাম রাজ্য ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিনিধিত্ব করেন।
পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র ফেডারেশনের সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালে ময়মনসিংহ শহরে। সর্বভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের তৎকালিন সাধারণ সম্পাদক অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য আত্মগোপন করে সে সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। পুলিশি বাঁধায় সম্মেলন ভেঙে যাওয়ার আগে ঘোষিত কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন যথাক্রমে মুনীর চৌধুরী ও শহীদুল্লাহ কায়সার। হেনা দাস যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৩ ও ১৯৪৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির তৃতীয় ও চতুর্থ সম্মেলনে সিলেট জেলা পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে হেনা দাস যোগ দেন। এত রাজনৈতিক কর্মব্যস্ততার মাঝেও হেনা দাস ১৯৪৭ সালে স্নাতক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
বিয়ে ও কমিউন জীবন
হেনা দাস তাঁর স্বামী রোহিণী দাসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন- “রোহিণী দাসকে আমি প্রথম কবে দেখেছিলাম তা আজ আর মনে পড়ে না। তবে এটুকু মনে পড়ে ১৯৪৮-এ আমাদের বিয়ের পাঁচ বছর আগে থেকেই আমি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম এবং তাকে জীবনসাথী হিসেবে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, আমার বয়স তখন উনিশ।” ১৯৪৮ সালের ২৮ জুন হেনা দত্ত ও রোহিণী দাসের বিয়ে কলকাতায় সম্পন্ন হয়। হেনা-রোহিণী দাস দম্পতির প্রথম সন্তান জন্মের কয়েক ঘণ্টা পরেই মৃত্যুবরণ করে। পরবর্তীতে তাঁরা দুই কন্যা ডা. দীপা ইসলাম ও চম্পা আক্তারের জনক-জননী হন।
আত্মগোপন জীবন
১৯৫৮ সালে আত্মপরিচয়ে কাজ করতে শুরু করার আগ পর্যন্ত তিনি দশ বছর আত্মগোপনে কাটান। আত্মগোপন থাকা অবস্থায় তিনি নানকার এলাকায় অবস্থান করে নানকার নারীদের সংগঠিত করার দায়িত্ব নেন। এ সময়কালে তিনি অন্যান্য কমরেডদের নিয়ে চা বাগানে শ্রমিকের বেশে শ্রমিক বস্তিতে অবস্থান করে চা শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজ করেন। ১৯৫২ সালে জ্যেষ্ঠ কন্যার জন্মের পর তিনি বিভিন্ন জায়গায় পার্টির গোপন ডেনে অবস্থান করে পার্টির কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। ডেনের কঠিন জীবন সম্পর্কে তিনি লিখেছেন-
“টাকা-পয়সার খুবই সংকট চলছে, ঠিকমত দুবেলা খাওয়ার ব্যবস্থাও করা যাচ্ছে না, শাড়ি-কাপড়-সায়া সবই একে একে ছিঁড়ে যাচ্ছে। সায়ার অভাবে শাড়ি দু’প্যাচ করে পরছি। দুটো শাড়ি সম্বল, তাই রিপু করে তালি দিয়ে পরছি।” আত্মগোপনকালে তিনি মুসলমান এলাকায় আমেনা এবং হিন্দু এলাকায় উষা নামে পরিচিত ছিলেন।
শিক্ষক আন্দোলন
১৯৫৮ সালে পার্টির পরিকল্পনা অনুসারেই তিনি আত্মগোপন জীবন থেকে বেরিয়ে আসেন। মনিজা রহমান স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেন তিনি। ১৯৮৯ সালে অবসরে যাওয়ার আগে দীর্ঘদিন নারায়ণগঞ্জ গার্লস স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন। টানা চৌদ্দ বছর বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শিক্ষক আন্দোলন করতে গিয়ে জিয়া আমলে ১৯৭৭ সালে একবার এবং এরশাদ আমলে ১৯৮৬ সালে আরেকবার কারাবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চাশটি শরণার্থী শিবিরে শিশুদের জন্য শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে স্কুল খোলা হয়েছিল, তার প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলেন হেনা দাস। ১৯৭৩ সালে গঠিত কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন। হেনা দাস শিক্ষক সমিতির মুখপত্র ‘গণশিক্ষা’র সম্পাদক ছিলেন।
মহিলা পরিষদের কাজ
১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠাকালে হেনা দাস অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। শুরুতে তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভানেত্রী এবং ২০০০ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
বিলোপবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে
গত শতাব্দির ৯০-এর দশকের শুরুতে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বির্পযয়ে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যখন পার্টি বিলোপ করতে উদ্যত হন তখন হেনা দাস পার্টির বয়োজ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। ১৯৯৩ সালের ১৫ জুনের বিশেষ সম্মেলনে তিনি পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু সে পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি সারা দেশে সফর করে জেলায় জেলায় বিলোপবাদকে পরাজিত করে পার্টিকে নবশক্তিতে জাগিয়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন।
হেনা দাস তাঁর লড়াকু জীবনের ইতিহাস লিখে রেখে গেছেন তাঁর বইগুলোতে। তাঁর লেখা বইগুলোর অন্যতম হচ্ছে চারপুরুষের কাহিনী, উজ্জ্বল স্মৃতি, স্মৃতিময়-৭১, স্মৃতিময় দিনগুলো, নারী-আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা, শিক্ষা ও শিক্ষকতা জীবন। ২০০১ সালে হেনা দাস ‘রোকেয়া পদক’-এ ভূষিত হন।
হেনা দাস একজন আপাদমস্তক বিপ্লবী ছিলেন। তিনি ছাত্র আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, নারী আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন এবং সর্বোপরি পার্টি নেতা হিসেবে সর্বক্ষেত্রেই তাঁর যোগ্যতার ছাপ রেখে গেছেন। ১৯৩৬ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালে দেশকে বিদেশি শাসক এবং দেশের মানুষকে শোষণমুক্ত করার রাজনীতির যে পাঠ তিনি গ্রহণ করেছিলেন আমৃত্যু সে ঝাণ্ডা তিনি উড্ডীন রেখেছিলেন। হেনা দাস ২০০৯ সালের ২০ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।
জন্মশতবার্ষিকীতে বিপ্লবের অন্তহীন প্রেরণা কমরেড হেনা দাসকে- লাল সালাম!