‘গ্রামবাংলার মেলা’ হারিয়ে যাওয়া যাত্রাপালা
শুভ চন্দ্র শীল
গ্রামবাংলার লোকসংস্কৃতির ধারার বাহক হচ্ছে মেলা। কালি মেলা থেকে কাজির মেলা, ওরশ মেলা থেকে রাস মেলা, চেরাডাঙ্গী থেকে বৈশাখী মেলা। এরকম বহু নামে খ্যাত উত্তরের জনপদের শীতকালীন উৎসবীয় মেলাগুলো। গানবাজনা থেকে ধর্মীয় উপাসনা, ব্যবসা বাণিজ্য থেকে খানাপিনা। উৎসবে আমেজে সেজে উঠতো গ্রাম। নবান্নের নতুন চালে পায়েসের গন্ধে জুড়িয়ে আসতো মন, সাথে খেজুরের গুড়ের ভাপাপিঠা। জামাই আদর থেকে পাড়া প্রতিবেশীদের সমাদর বাদ ছিলো না কোনো কিছুই। কালক্রমে হারিয়েছে নবান্ন উৎসবের আমেজ। বন্ধ হয়েছে মেলাগুলো। কর্পোরেট দাসত্বে ব্যস্ত মানুষ, চলন্ত ট্রেনের মতো ছুটে যাচ্ছে এপার থেকে ওপার।
‘ছোটবেলার মেলাগুলো জীবনে আর ফিরে পাবো না, এখন ইচ্ছে থাকলেও হয়ে উঠে না সময়। চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে সময় যে কখন চলে যায় বোঝা মুশকিল। তাছাড়া সেই আগের দিনগুলোও তো নেই। এখন আর আগের মতো মেলাও হয় না, আর মেলা হলেও সেই মেলার সামাজিকতাও থাকে না। আগে দিনাজপুরের সবচেয়ে বড় মন্দির কান্তজী মন্দিরে বিশাল রাসমেলা হতো। প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটতো। দিনাজপুর জেলার মানুষসহ আশপাশের জেলার মানুষ আসতো। শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বী না, সব ধর্মের মানুষের আসা-যাওয়া ছিলো এই অঞ্চলে। মেলা শুরু হলে পুরো মাসজুড়ে কাহারোল জমজমাট হয়ে থাকতো। এখনো মেলা হয়– তবে আগের মতো না’–হালকা স্বরে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার বাসিন্দা অনিমেষ।
হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান খ্যাত দিনাজপুরের পুরনো কান্তজী মন্দির। রাজাদের আমল থেকে মেলা হয়ে আসছে সেই মন্দিরে। মূলত সওদা বাড়ানো ও ক্রেতাসমাগম ঘটানোকে কেন্দ্র করে পূজা পরবর্তী সময়ে এই মেলা হতো। ধর্মীয় উৎসব থেকে মেলা হয়ে থাকলেও সকল ধর্মের সকল মানুষের সমাগম ঘটতো। যাত্রাপালা থেকে হাউজি, সার্কাস থেকে মটরখেলা, নাগরদোলা থেকে জাদুখেলা, পালাগান সব থাকতো এই মেলায়। দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আসতো। সেই মেলা হারিয়ে যেতে বসেছে। মানুষ হয়ে যাচ্ছে কর্পোরেট সমাজের কাঠামোতে ব্যস্ত।
ঠাকুরগাঁও জেলার নেকমরদ ইউনিয়নের হাজার বছরের পুরনো বিখ্যাত উরশ মেলা। নাম শুনলেই মনে হতে পারে না ধর্মীয় মেলা। কথিত আছে বিট্রিশ বা তারও আগে এই এলাকায় বড় বড় সাহেব-রা আসতেন সওদা করতে, তখন নেক সাহেবের নগর হিসেবে নেকমরদকে বেছে নিতেন, তারপর আবার অনেক রাজার যাতায়াত এই অঞ্চলে। মুসলিম সম্প্রদায়ের উরশ উৎসবের নামানুসারে এই মেলায় নাম।
মেলা কমিটির সদস্য রাফসান উদ্দিন বলেন, আমাদের অঞ্চলে ঈদ আর পূজা লাগতো শীতকালে। উরশ মেলা মানে হামার ঈদ ওমার পূজা। এখনও মেলা হয়, এবছরও হবে। তবে এখন আর ঈদ লাগে না, পূজাও লাগে না। নেকমরদের মেলা মানে সারামাস ঘুম হারাম। রাতভোর গান চলবে, কি বড় বড় অপেরা আসবে, সারারাত যাত্রা চলবে। দেশবিখ্যাত সার্কাস আসবে, বড় বড় নায়ক-গায়ক আসবে। মরণফাঁদ মটরসাইকেল-মাইক্রো খেলা দেখাবে। জাদুকর বসবে, ভারত, নেপাল থেকে জাদুকর আসবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা থেকে বড় বড় ভাল্লুক, অজগর, হরিণসহ কত প্রাণী আনা হবে। গুড়ের জিলাপি, মোড়ার নাড়ু, রংবেরংয়ের বাহারি খাবার। বৈচিত্র্যময় দোকানের পসরা বসবে। সন্ধ্যায় হলেই হাট বসবে। কি লাগিবে সব ছে। এখন আর এই মেলার বৈচিত্র্য নেই। জৌলুস হারিয়ে গেছে।
মানুষ এখন সোস্যাল মিডিয়া থেকে ইন্টারনেটে ব্যস্ত। কর্মজীবনের ক্লান্তিতে হারিয়ে ফেলেছে সময়। সাম্প্রদায়িকতা বীজ চেপে বসেছে। ভাগ হয়েছে মেলাগুলো। সাম্প্রদায়িক বিভেদের বেড়াজালের অন্তরালে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এসব সামাজিক উৎসবগুলো।
যাত্রাপালা গানগুলো ছিলো সামাজিক, নানি থেকে মামি, মা থেকে বোন সবাই মিলে কাঁথা কিংবা চাঁদর মুড়ি দিয়ে সারারাত পার করে দিত গান আর অভিনয় দেখে। যাত্রাপালার শিল্পীরাও পেশা বদলেছে। নিত্যপণ্যের টানাপোড়নে বাধ্য হচ্ছে পেশা বদল করতে হয়েছে তাদের। যখনই মানুষ অনলাইন বিনোদনমুখী হলো সামাজিক অনুষ্ঠান বিমুখতা তৈরি হলো তখনই যাত্রাপালার শিল্পীরা পেটের তাগিদে বিভিন্ন ভঙ্গি১মায় উপস্থাপন করতে লাগলো পরিবেশনা। শুরু হলো সংকট। ভাঙলো যাত্রাপালা, বন্ধ হলো মেলা, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে তালা দেওয়া হলো অপেরা দলগুলোতে।
অথচ যাত্রাপালা আমাদের প্রাচীন শিল্প, লোকশিল্পের বড় একটি খাত। বড় বড় অপেরা দল ছিলো যারা বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে গান পরিবেশন করতো। মানুষকে বিনোদন দিতো। সেইসব নাটকের মধ্যে ফুটে উঠতো সমাজের অসঙ্গতি, সমাজের নানা দিক। বাল্যবিয়ে, যৌতুক, যক্ষা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ধর্মীয় আচার, সৃজনশীলতা, নারীর অধিকার, রাজনীতি, শিক্ষা, সামাজিকতা-সচেতনতা ফুটে উঠতো।
সমাজের চিত্র তুলে ধরার আগেও যাত্রাপালা ভাষা আন্দোলনে প্রতিবাদ করেছিলো গানের মধ্য দিয়ে, যাত্রাপালা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতো নাটকের মধ্য দিয়ে। গ্রামীণ এই সংস্কৃতি রক্ষায় সরকারিভাবে নেই কোনো উদ্যোগ, নেই কোনো পরিকল্পনা। অপসংস্কৃতির করাল গ্রাসে বন্ধ হয়ে গেল যাত্রাপালার আসরগুলো। নিভে গেলো তিলে তিলে গড়ে উঠা অপেরা দলগুলো। অথচ সঠিক পরিকল্পনা ও নির্দেশনার মাধ্যমে জাগিয়ে তোলা সম্ভব এই বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের লোকসংস্কৃতিকে। বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব গ্রামবাংলার মেলাগুলোকে।
লেখক : সাংবাদিক
Login to comment..