বিপ্লবী কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ

একতা ডেস্ক

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

পাকিস্তানি এক সাংবাদিক কবি ফয়েজ আহমেদকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কি কমিউনিস্ট?’ ফয়েজ ভাবলেন কিছুক্ষণ, তারপর উত্তর দিলেন, ‘না, আমি কমিউনিস্ট নই। কমিউনিস্টের বড় পরিচয়, সে একজন কমরেড; যে কমরেড পার্টির বৈধ পরিচয়পত্র বহন করে; একইসাথে তার বিপ্লবী দায়িত্বও পালন করে। এখন পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিপি) পাকিস্তানে নিষিদ্ধ, তাহলে আমি কিভাবে কমিউনিস্ট?’ বিংশ শতাব্দির শুরুতে উপমহাদেশে গড়ে ওঠা সাম্যবাদী সাহিত্য আন্দোলনের প্রভাব মৌলবাদী পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়ে। খুব কম সংখ্যক পাকিস্তানি কবি সাম্যবাদী চিন্তা-চেতনার অধিকারী ছিলেন, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ তাদের মধ্যে অন্যতম। উপমহাদেশে প্রগতিশীল সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম অগ্রনায়ক হিসেবেও তাকে গণ্য করা হয়। পাকিস্তানে সাম্যবাদী সাহিত্যের বার্তাবাহক এই কবির জন্ম ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯১১, পাকিস্তানের শিয়ালকোটে। মৃত্যু ২০ নভেম্বর, ১৯৮৪। ফয়েজের বাবার নাম সুলতান মুহম্মদ খাঁন, মা ফাতেমা সুলতান ছিলেন বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। ফয়েজের পরিচয় শুধু মার্কসবাদী কবি হিসেবে নয়; সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক, রাজনীতিক, দার্শনিক, চলচ্চিত্রকার, অনুবাদক একইসাথে একজন সাচ্চা বিপ্লবী হিসেবেও তার সমান পরিচিতি বিদ্যমান। সাম্যবাদী কবি ফয়েজকে তার মুসলিম পারিবারিক ঐতিহ্যানুযায়ী মাত্র চার বছর বয়সে স্থানীয় মক্তবে ভর্তি করানো হয়। শিক্ষাগুরু মৌলভী মুহাম্মদ ইব্রাহিম মীরের নিকটে ধর্মীয় দীক্ষালাভের উদ্দেশ্যে তাকে প্রেরণ করা হয়। এখানেই তিনি উর্দু, ফার্সি, আরবি শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করেন। স্কচ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করে কিছুদিন পর ভর্তি হন শিয়ালকোটের বিখ্যাত ম্যারি কলেজে। এই কলেজ থেকেই তিনি উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক সম্পন্ন করেন। ফয়েজ লাহোর সরকারি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন, একইসাথে তিনি লাহোর ওরিয়েন্টাল কলেজ থেকে আরবি সাহিত্যেও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। সামাজিক, রাজনৈতিক দর্শন তাঁর কবিতায় উঠে আসে তারুণ্যের ওপর ভিত্তি করে। জীবদ্দশায় প্রগতিশীল বাঙালি কবি-সাহিত্যিক-চলচ্চিত্রকারদের সাথে তার গভীর এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ফয়েজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন নাট্যকার মুনীর চৌধুরী। বিশিষ্ট উর্দুভাষী কবি আহমেদ ইলিয়াস তার ‘ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ অ্যান্ড বাংলাদেশ’ স্মৃতিচারণমূলক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের বন্ধুদের নিজস্ব একটি বৃত্ত ছিল। সেই বন্ধুদের তালিকায় দৈনিক সংবাদ-এর আহমদুল কবির এবং জহুর হোসেন চৌধুরী, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্ত, সমাজসেবক লায়লা কবির, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, শওকত ওসমান এবং অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ ছিলেন।’ ফয়েজ আহমেদের কবিতায় যেমন প্রেম আছে, আছে প্রতিবাদও; একইসাথে মানবতাবাদী চিন্তা চেতনার প্রকাশও স্পষ্ট। তার লিখিত ‘ইয়ে দাগ দাগ উজালে ইয়ে সবগুয়িতা শাহ’ (এই দাগ দাগ ভোরের আলো, রাতের খাপে ঢাকা এই ভোর) কবিতার জন্য ১৯৫১ সালে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়, এই মামলা ‘রাওয়ালপিণ্ডি ষড়যন্ত্র মামলা’ হিসেবে পরিচিত। এই মামলার বিচারে তাকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ধিক্কার জানিয়ে উর্দুভাষী ফয়েজ আহমেদ কবিতা লিখেছেন। তার কবিতায় আছে পাকবাহিনীর প্রতি তীব্রতর নিন্দার বহিঃপ্রকাশ। যা মুক্তমনা, স্বাধীনচেতা না হলে কোনো মানুষের মধ্যে থাকে না। যেমনটা ছিল না আমাদের স্বজাতীয় স্বাধীনতাবিরোধী পশুগুলোর মধ্যে। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে টিক্কা খাঁনের নির্দেশে ঢাকায় নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। এ ঘটনা জানতে পেরে ফয়েজ লিখিত আকারে তীব্র ধিক্কার জানিয়েছিলেন পাকিস্তান সরকারের প্রতি। গণহত্যার কথা স্মরণ করে তার ‘হাজার কারো মেরে তান সে’ (আমার শরীর থেকে দূরে থাক) কবিতায় লিখেছেন, ‘আমার শরীর থেকে দূরে থাক/সাজাবো তবে কিভাবে গণহত্যার শোভাযাত্রা/আমার রক্তের চিৎকারে কাকে আকর্ষিত করবো/আমার দুর্বল দেহে কতটুকু রক্ত আছে?/এতে জ্বলবে না প্রদীপ/আর ভরবে না মদের গ্লাস।’ ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ গণমানুষের কবি ছিলেন। নিপীড়িত ও শোষিতের পক্ষে তিনি প্রবলভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন। মানুষের প্রতি ছিল তাঁর গভীর ভালবাসা। ভাষা ও ভূগোলের সীমানা ভেদ করে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ হয়ে উঠেছেন সকল দেশ ও মানুষের কবি। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে তাঁর কবিতা রুশ ভাষায় অনূদিত হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবাদপত্রে প্রকাশ পায়। পরে ফয়েজের কবিতা সমগ্র রুশ ভাষায় অনূদিত এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দু বিভাগের পাঠ্যসূচিতে ফয়েজের কবিতা এখনও অন্তর্ভুক্ত। সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন সরকার কর্তৃক ১৯৬২ সালে কবি ফয়েজকে লেনিন শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। লেলিন পুরস্কার লাভের পর যৌথভাবে বাংলা ও উর্দু প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন তার সম্মানে ঢাকায় এক বড় রকমের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। উক্ত অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৩৫ সালে অমৃতস্বরের এম.এ.ও. কলেজে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন ফয়েজ। পরে লাহোরের হ্যালি কলেজ চলে যান। এরপর শিক্ষকতা ছেড়ে ১৯৪২ সালে দিল্লিতে ব্রিটিশ আর্মির পাবলিক রিলেশন বিভাগে ক্যাপ্টেন পদে সৈনিক জীবন শুরু করেন। ১৯৪৩ সালে মেজর, ১৯৪৪ সালে লেফটোন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পান। কিন্তু গৎবাঁধা সৈনিক জীবনে ক্রমাগত হতাশা বোধ করতে শুরু করেন কবি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে লাহোর ফিরে আসেন। পাকিস্তান টাইমসের প্রধান সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলের সম্পাদক নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন আগে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘ঢাকায় এই সময় ফয়েজ ভাই আমাকে বললেন, তিনি লাহোর আর্ট কাউন্সিলের সেক্রেটারির পদ গ্রহণ করতে যাচ্ছেন এবং ডিসেম্বরের শেষে সেখানে তিনি আমার প্রদর্শনীর আয়োজন করবেন। আমি যেন প্রস্তুত থাকি।’ ফয়েজ বাংলাকে ভালবাসতেন, বাঙালিকে ভালবাসতেন। পাকিস্তান আমলে নিয়মিত ঢাকায় আসতেন বিভিন্ন সাহিত্য আসরে যোগ দিতে। বিশেষ করে বাংলা একাডেমী ছিল তার অন্যতম প্রিয় স্থান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে তিনি সর্বশেষ ঢাকায় আসেন। ব্যক্তিজীবনে নন্দিত এই কবি মাত্র ১৯ বছর বয়সে ব্রিটিশ নারী এলিসকে বিয়ে করেন। এলিসের গর্ভে জন্ম নেয়া দুই কন্যার নাম মনিজা ও সেলিমা। ১৯৬৪ সালে লন্ডন থেকে ফিরে কবি করাচিতে আব্দুল্লাহ হারুন কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। একইসাথে সাংবাদিকতায় আত্মনিয়োগ করেন। পাকিস্তান টাইমস ছাড়াও ‘লায়ল ই নাহার’, ‘ইমরোজ’ নামের দুটি পত্রিকা সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের তথ্য অধিদপ্তরে কাজ করতেন। এসময় লোটাস নামক একটি পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে কিছুকাল দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সাংবাদিকতা ছাড়াও ফয়েজের খ্যাতি ছিল চলচ্চিত্রকার ও সুফি দর্শনের একজন কট্টর অনুরাগী হিসেবে। কবি আহমেদ ইলিয়াস তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৫৮ সালে যখন পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয় ঠিক তখনই ফয়েজ চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ করেন। তার প্রথম ছবি ‘জাগো হুয়া সাওয়েরা’ (জেগে ওঠো ভোর হয়েছে)। উক্ত চলচ্চিত্রটি পূর্ব পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক বিষয় নিয়ে চিত্রায়িত করা হয়েছিল। ছবিটিতে এদেশের একজন দরিদ্র মৎসজীবীর জীবন সংগ্রামের কাহিনী চিত্রায়িত করা হয়েছিল। সেই চলচ্চিত্রটির পান্ডুলিপি এবং গান ফয়েজ নিজেই রচনা করেছিলেন।’ ছবিটি পাকিস্তানের মৌলবাদী সরকার নিষিদ্ধ করলেও পরবর্তীকালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে স্বর্ণপদক লাভ করে। ২০০৭ সালে প্যারিস চলচ্চিত্র উৎসবেও এটি প্রদর্শিত হয়। সুফি দর্শনের দারুন ভক্ত এই কবির সাথে পাকিস্তানের বড় বড় সুফি গায়কের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বিখ্যাত বাবা মালাঙ সাহেব, ওয়াসিফ আলি ওয়াসিফ, আসফাক আহমেদ, সৈয়দ ফখরুদ্দিন ছাড়াও নামকরা সুফিদের সাথে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এক লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘দে (সুফি) আর রিয়াল কমরেডস’। ১৯৭৭ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ভুট্টো সরকারের পতন ঘটলে পাকিস্তানে সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। তার ওপর পুলিশি নজরদারি রাখা হয়। এমন অবস্থা ছিল যে, যে কোনো সময় তিনি গ্রেফতার হতে পারেন। কারণ তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৪ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফিলিস্তিনের সংগ্রামী নায়ক ইয়াসির আরাফাত এবং তাঁর কাছের মানুষদের অনুরোধে তিনি পুরস্কারের মনোনয়ন থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ফয়েজ তাঁর জন্মের শত বছর পার করেছেন ২০১১ সালে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাঁর স্মরণে জন্মশতবর্ষ পূর্তি উদযাপিত হয়েছে। মৃত্যুর পরও পাকিস্তানের প্রগতিশীল মানুষের কাছে তিনি সাহসের প্রতীক হয়ে আছেন। তাঁর দর্শন, তাঁর কবিতা মানুষকে প্রতিবাদের ভাষা শিখিয়েছে। তাঁর জীবনকর্ম মানুষকে সাম্যবাদের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে- ভবিষ্যতেও করবে সন্দেহ নেই।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..