মন্দের ভালোর জন্য নয় ভালোর জন্য সংগ্রাম
দেশে যথেষ্ট অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে গণতন্ত্র কিছুটা কম হলেও ক্ষতি নেই–এমন একটি ধারণার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। এই ধারণার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে তারা ও তাদের মিত্ররা চীনের দৃষ্টান্তও হাজির করছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তারা আইয়ুব খানের উন্নয়ন দশক পূর্তির পরই পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার দৃষ্টান্তটি আড়াল করে রাখেন। অথচ কে না জানে যে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি আর সীমাহীন বৈষম্যের কারণেই আইয়ুবের গণতন্ত্রহীন ও বৈষম্যমূলক উন্নয়ন-দর্শন তাকে রক্ষা করতে পারেনি।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আওয়ামী লীগের টানা শাসনামলে দেশের অবকাঠামোসহ অর্থনীতির নানা সূচকে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে বৈষম্যও বেড়েছে। আর গণতন্ত্র ও সুশাসন রীতিমতো পাতালে চলে গেছে। প্যারিসের ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাব প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট-২০২২’ অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬.৭ শতাংশ মাত্র ১ শতাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত ছিল। বিপরীতে নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল মোট আয়ের ১৭.১ শতাংশ। অথচ ১৯৮১ সালেও দেশে জাতীয় আয়ের ১১.৮ শতাংশ ছিল ১ শতাংশ মানুষের হাতে, আর নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে ছিল সম্পদের ২০ শতাংশ। সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) একখানা জরিপের ফল প্রকাশ করে জানিয়েছে, দেশে গত চার বছরে ধনী-গরিব সবার আয় বাড়লেও সে তুলনায় আয় বাড়ার হার সবচেয়ে কম নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তবে সব শ্রেণির মানুষেরই খরচ বেড়েছে এবং আয়বৈষম্যও বেড়েছে। এখন মধ্যবিত্তও শান্তিতে নেই।
পাকিস্তানি শাসনামলে গণতন্ত্রহীনতা ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি ছিল সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সরকারি প্রচারমাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম প্রচার নিষিদ্ধ করেই শুধু থেমে ছিল না। তারা কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা প্রচারের ওপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিল, তবে তাঁর কবিতার অনেক শব্দ উর্দুতে পরিবর্তন করে নতুনভাবে প্রকাশ করা হয়। নজরুলের কবিতার অনেক বাংলা শব্দকে হিন্দুয়ানি আখ্যা দিয়ে সংশোধন করার অপচেষ্টাও চালিয়েছিল পাকিস্তানি শাসকেরা; যেমন ‘নব নবীনের গাহিয়া গান, সজীব করিব মহাশ্মশান’ সংশোধন করে লেখা হয়েছিল ‘নব নবীনের গাহিয়া গান, সজীব করিব গোরস্তান’। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরে এসেও কি আমরা ভাষা-সংস্কৃতির ওপর নানা আঘাত লক্ষ্য করছি না! উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর দাবির মুখে ২০১৭ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আনা হয় সম্পাদক ও সংকলকদের কিছু না জানিয়েই। এর বাইরেও নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ঘটছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ বাউল, সুফীসাধক অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন মাঝেমধ্যেই। যাত্রা, পালা গান, বাউল গানের আসর তো বন্ধ হওয়ার পথে। আগামী একতরফা নির্বাচন নিয়েও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা আক্রমনের আশংকায় আতংকিত বোধ করছেন। এসব প্রবণতা পশ্চাৎমুখী রাজনীতিরই পরিচায়ক। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের চাপ দ্রুত লয়ে বাড়ছে সরকারের ওপর। সেই সবাদে কিছুদিন আগেই বিএনপির ডাকে রাজপথ আবার উত্তপ্ত হতে শুরু করে। দীর্ঘ বিরতির পর সরকারের কৌশলগত প্রশ্রয়ে মাঠে নামতে শুরু করে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতও। এই দৃশ্যপটে বামপন্থিদের বিশেষ অবস্থানটি তুলে ধরা প্রয়োজন মনে করি।
বাংলাদেশের বামপন্থি শক্তি ষাট-সত্তর-আশির দশকে এ দেশের সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামে একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। সম্প্রতি মনে হচ্ছে, তা তারা পারছে না। কেন? তাদের একটি অংশের অবস্থান ক্ষমতাসীনদের নেতৃত্বাধীন জোটে। তাদের আশা, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে প্রভাবিত করে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করা যাবে। বেশ কয়েক বছর আগে তাঁদের একজনকে বলেছিলাম, ছাগলের লেজ ছাগলকে নাড়াতে পারে না বরং ছাগলই ইচ্ছেমতো লেজকে নাড়ায়। তিনি পরে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। তাঁকে যদি এখন পুনরায় জিজ্ঞেস করি, ঐক্য করে ‘কতটুকু কী পারলেন?’ তিনি হয়তো বলবেন, ‘তবু তো এটাই “মন্দের ভালো” নয় কি? না হলে তো দেশটা জামায়াত-বিএনপি জোটের হাতে চলে যেত।’ তারপরও যদি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ঘোরতর মন্দকে কি মন্দের ভালোকে আশ্রয় করে শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যাবে? ব্যর্থ হলে তখন কি ‘উত্তপ্ত কড়াই’ থেকে ‘জ্বলন্ত উনুনে’ গিয়ে পড়ব না? তখন কি আবার ‘উত্তপ্ত কড়াইয়েই’ ফিরে আসার জন্য ফের একসঙ্গে সংগ্রাম করতে হবে? এর আর কোনো উত্তর নেই, হতাশ উপসংহার হচ্ছে, হ্যাঁ, ঘুরেফিরে একই চক্করে আমরা থেকে যাচ্ছি। সেটাই নাকি ভবিতব্য।
এভাবে মন্দের ভালো ও মন্দের যে দ্বিদলীয় চক্রে আমরা আটকে আছি এবং ট্র্যাজেডি ও ফার্সের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি, তা থেকে বেরোনোর কি উপায় আছে? সঠিক উত্তর হচ্ছে কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হলেও আছে। শুধু আরও ‘মন্দের’ উত্থানের বিরুদ্ধে সজাগ থাকা নয়, পাশাপাশি তথাকথিত ‘মন্দের ভালোর’ মন্দ দিকগুলোর বিরুদ্ধেও কার্যকর সংগ্রাম অব্যাহত রাখা এবং সে জন্যই দরকার দুইয়ের বাইরে নিজেদের ও অন্যান্য ভালো শক্তির ঐক্যবদ্ধ ক্ষমতা বাড়িয়ে ধীরে ধীরে প্রকৃত সৎ বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিসমাবেশ গড়ে তোলা। এটা হতে হবে সাবস্টিটিউট নয়, অল্টারনেটিভ রাজনৈতিক শক্তি। বামদের তাই একটি স্বতন্ত্র অবস্থান ও ভূমিকা খুবই জরুরি।
Login to comment..