ভয়ের রাজনীতি গণতন্ত্রকে জিম্মি করে রেখেছে

মোহাম্মদ হেকমত

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
দেশে ভয়ের রাজনীতি চলছে বহুদিন ধরে। নির্বাচন নিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ, হরতাল-অবরোধ, জ্বালা-পোড়াও, হামলা-মামলা, পুলিশি নির্যাতন, মানবাধিকারের ক্রমাগত অবনতি চলছে। আমেরিকার ভিসানীতি ও নানা নিষেধাজ্ঞার হুমকি রয়েছে। এরই মধ্যে গত ১৫ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। ঘোষিত তফসিলকে বিএনপিসহ নিবন্ধিত অনেক দল প্রত্যাখ্যান করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। বিপরীত দিকে তফসিলের পরই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রস্তুতির তৎপরতা, নিজ দলের প্রার্থীদের কাছে নমিনেশন পেপার বিক্রি শুরু হয়। সেখানে দেখা গেছে ব্লু-প্রিন্টের নির্বাচনে এমপি হওয়ার বাসনায় আমলা-ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের তারকাদের অনেকে সরকারি দলের নমিনেশন পেপার কিনেছেন। নির্বাচনের এই তোড়জোড়ের মধ্যেই আমাদের দেশকে নিয়ে ভূরাজনৈতিক তৎপরতায় বিদেশি শক্তিগুলির মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা। ভেতরে-বাহিরে নানামুখি তৎপরতা-অপতৎপরতা, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চলছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির প্রভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রির্জাভের অধোগতি অব্যাহত। জনজীবনে আতঙ্ক, ভয়ভীতি, নিরাপত্তাহীনতা। গার্মেন্ট শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির লড়াই-সংগ্রাম, পুলিশি হামলা-মামলা-মৃত্যু চলছেই। নানামুখি অস্থিরতায় দেশ। ডেঙ্গুতে মানুষ মরছে, ঘূর্ণিঝড় ফসল ও জীবনের ক্ষতির প্রতি মানুষের দৃষ্টি নেই। সবকিছু চাপিয়ে গেছে রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে ভাবনা ও আলোচনায়। এই হলো দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির হালহকিকত। জোটের রাজনীতি চলছে। জোটের রাজনীতি আগেও হয়েছে। ১৯৫৪-এ যুক্তফ্রন্ট করে হক-ভাসানী-সোহরাওয়াদী নির্বাচনে নেমেছিলেন-নির্বাচন করেছিলেন। জোটের রাজনীতি ও নির্বাচন হয়েছে ১৫, ৭, ৫ দলের। আসন ভাগাভাগি হয়েছে, প্রার্থীরা আসন ভাগ করে মানুষের কাছে গিয়েছে। প্রার্থীরা মানুষের ভোটে কেউ জিতেছে কেউ হেরেছে। জোটের মধ্যে যে দলের প্রার্থীই হোক না কেন মানুষের রায়-ই হয়েছে প্রধান। এটা ইতিহাস। এখন জোট হলেও আসন দেওয়ার মালিক দলের হোক, জোটের হোক এক ব্যক্তি। এখন মানুষের ভোটে নির্বাচিত হতে হয় না বলে নমিনেশন পেলেই জিতে যাওয়া, এমপি হওয়া নিশ্চিত। এটা আমরা দেখেছি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে। গত দুই নির্বাচনে বিনা ভোটে জয়ী এমপিরা এটাতে আসক্ত হয়ে উঠেছে। শত সংগ্রামে ঐতিহ্যবাহী দেশ ও জাতিকে পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের লড়াই করতে গিয়ে Arms struggle করতে হয়েছে এবং এই লড়াই করতে গিয়ে গড়ে উঠেছিলো লক্ষ লক্ষ দেশপ্রেমিক জীবন নিবেদিত রাজনৈতিক কর্মী, সেই দেশ ও জাতির আজ এ-কি দশা। কিন্তু সময় বসে থাকে না, সময় কথা বলে। আজকে এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? কারা এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে? আজকের এই সংকট সৃষ্টি করেছে লুটেরা শাসকশ্রেণি। জনগণ এর জন্য দায়ী নয়। জনগণ গণতন্ত্রের জন্য, তাদের অধিকারের জন্য বারবার রক্ত দিয়েছে। কিন্তু গণবিরোধী শক্তি, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে তা নস্যাৎ হয়েছে। বর্তমানের সুনির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত ও পরিস্থিতির দিকে যদি থাকাই, তাহলে দেখতে পাই ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশার সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ-বিএনপি গত ৩২ বছরে বারবার ক্ষমতায় এসেছে-গিয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্র আসেনি, গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি, মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়নি। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভোটারবিহীন একটি একতরফা সংসদ নির্বাচন করে বিএনপি। আন্দোলনের মুখে ঐ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় ১৯৯৬ সালের জুন মাসের সংসদের আরেকটি নির্বাচন হয়, ওই নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০০১ সালে নিয়মমাফিক ক্ষমতা হস্তান্তর করে আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালে বিএনপি সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসে। ২০০১ সালে তারেক জিয়া রাজনীতিতে প্রবেশ করে, জন্ম হয় হাওয়া ভবনের, সৃষ্টি হয় ক্ষমতার দ্বৈত কেন্দ্র। রাজনীতি ও প্রশাসনে সৃষ্টি হয় অস্থিরতা, সৃষ্টি হয় স্বেচ্ছাচারিতা। পরবর্তীকালে ক্ষমতায় থাকার জন্য নানা পরিকল্পনা ও অপকৌশলের কারণে বির্তকিত করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন সাহেব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়ে বসেন। শুরু হয় রাজনীতিতে নতুন মাত্রার সংকট। ২২ জানুয়ারি ২০০৭ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান থেকে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে এবং ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে, একই সঙ্গে ২২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষিত তারিখ বাতিল করে। দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। দুই নেত্রীকে অন্তরীণ করা হয়। ফখরুদ্দীন-জেনারেল মঈনুদ্দীনের নেতৃত্বে দেশে দুই বছর জরুরি অবস্থা চলে। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০১১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে। গণতন্ত্রের সংকট গভীরত হয়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার নির্বাসনে পাঠানো হয়। যা এখনো চলছে। রাজনীতি ‘রাজনীতিশূন্য’ হয়ে পড়ে। বর্তমানে রাজনীতি মানুষের হাতে নেই। নেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির হাতে। এরা ভারত-আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল। রাজনীতির decision maker হয়ে গেছে ভারত ও আমেরিকা। যা দেশ জাতির জন্য অপমানজনক। এই দুই দলের পক্ষে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং মানুষের ভোটাধিকার, গণতন্ত্র, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া সম্ভব নয়। যার জন্য প্রয়োজন জনগণের বিকল্প শক্তি সমাবেশ। জনগণও আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে বিকল্প শক্তি দেখতে চায়। কিন্তু তাদের সামনে তা অনুপস্থিত। গত ১৫ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার দ্বাদশ সংসদের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছেন। আগামী ৩০ নভেম্বর নমিনেশন পেপার জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। ভোটগ্রহণ হবে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি। ইতোমধ্যে জোটবদ্ধ নির্বাচন, কিংস পার্টির তৎপরতা, সিট ভাগাভাগি, দরকষাকষি, জাতীয় পার্টিতে টানাপোড়ন শুরু হয়েছে। চাপে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোটে অস্থিরতা বেড়েছে। যদিও নির্বাচনের সিডিউল পরিবর্তনের গুঞ্জন ও গুজব বাজারে আছে, যা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। এই হলো বর্তমানের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি। আগেই উল্লেখিত হয়েছে, গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক সংকটের জন্য দায়ী লুটেরা শাসকশ্রেণি। তাদের শ্রেণিস্বার্থ মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্রের স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক। লুটেরা শাসকশ্রেণির দল আওয়ামী লীগ-বিএনপি Power Game এর রাজনীতি বারবার এটা প্রমাণ করছে। এই বিষয়টি গণতন্ত্র ও প্রগতির লড়াইতে কর্মসূচি প্রণয়ন ও বক্তব্য দেওয়ার সময় বামপন্থিদের মনে রাখা প্রয়োজন বলে মনে হয়। তাহলে বিকল্পের রাজনীতিটা জনগণের সামনে আনা সহজ হবে। বামপন্থিরা প্রান্তিক অবস্থান থেকে রাজনীতিতে দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। দুই বড় দলের গণবিরোধী অপরাজনীতি, বিশেষ করে বর্তমান সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী, পুলিশ, আমলা-ব্যবসায়ীনির্ভর রাজনীতিকে উন্মোচিত করা বামপন্থিদের কর্তব্য। দুঃশাসন হটানো, ব্যবস্থা বদল, বিকল্প গড়ার আন্দোলনের পথ পরিষ্কার করার জন্য বর্তমানের সুনির্দিষ্ট বাস্তবতায় দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে জোরদার করা জরুরি।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..