শত প্রতিকূলতা আর ঝড়-ঝঞ্ঝার মাঝেও বেঁচে ছিলেন বোয়া সিনিয়র। আন্দামান নিকোবরের গ্রেট আন্দামানিজ গোত্রের প্রায় লক্ষাধিক বছরের প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠীর শেষ বংশধর ওই ব্যক্তিটি ২০১০ সালে মারা গেছেন। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই যেমন বিলুপ্তি ঘটে ‘বো’ ভাষার; তেমনই কালের গহ্বরে হারিয়ে যায় একটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সমাজ-সংস্কৃতির ইহিতাস। দুনিয়াজুড়ে এমনই ঘটনা পূর্বেও দেখা গেছে। দুঃখজনক ও বেদনাতুর এমনই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশেও। এদেশে ৪৫টি আদিবাসী গোষ্ঠীর নিজস্ব শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাষা আজ হুমকির সম্মুখীন। এ কথা বললে বোধ করি অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসনের ফলে কোনো কোনো আদিবাসী ভাষা, বর্ণ ও সংস্কৃতি হুমকি তথা বিলুপ্তির পথে। বিশেষ করে উল্লেখ করার বিষয় হলো, যে সংবিধানে সরকার আবার ফিরে যেতে চাচ্ছে, সেখানেও আদিবাসী মানুষের ভাষা, শিল্প ও সংস্কৃতি তথা সমধিকার সম্বন্ধে স্পষ্ট তেমন কোনো কথা নেই। অন্যদিকে এদেশের সুধীসমাজ, বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাশীল কর্তাব্যক্তিরা- যারা শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্য নিয়ে কাজ করেন তথা বাণী কপচান তারা যতটা আগ্রহী স্প্যানিশ, ফরাসি, লাতিন, গ্রিক, ইতালিয়ান, ইংরেজি আর আরবি’র শিল্প ও সংস্কৃতির সমকালীন ও ঐতিহ্যগত খোঁজখবর নিয়ে– ঠিক ততটাই উদাসীন বাড়ির কাছের পড়শীর শিল্প ও সংস্কৃতির বিষয়ে। মাঝে মাঝে অবশ্য সভা-সেমিনারে তারা বক্তব্য রাখেন। তৃপ্তির ঢেকুর বলতে এতটুকুই। আমাদের দেশে– ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এসব জাতিগোষ্ঠীর আছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, যা সমৃদ্ধ করতে পারে আমাদের সাংস্কৃতিক রুচিকে। সারাদেশে বসবাসরত ৪৫টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ হলেও, আমাদের সংবিধানে তাদের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই বা স্বীকৃতি নেই। বিশ্বের মোট ভাষার অর্ধেক আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রতি বছর সারা পৃথিবীতে হারিয়ে যাচ্ছে ১২টি ভাষা।
সময়ের বন্দি কলরবের মাঝে কখনো কখনো খরা, বন্যা, গোকি, সুনামি, ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, গণহত্যাজনিত দুর্ভোগ এবং অন্যান্য দুর্গতির জন্য হঠাৎ একটি ভাষাগোষ্ঠী লোপ পেতে পারে। ব্যাপক দেশত্যাগ কিংবা অন্যদেশ থেকে শরণার্থী বা অভিবাসীদের সংস্কৃতির বিড়ম্বনা বৃদ্ধি পেতে পারে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আগমনে স্থানীয় সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। ইউরোপ উপনিবেশ পূর্ব অস্ট্রেলিয়ায় প্রধান ভাষা ছিল ২৫০টি। শত শত আঞ্চলিক ভাষার মাঝে বর্তমানে সেখানে ১৭টি আদিবাসী গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি বেঁচে রয়েছে। মানুষ সাধারণত তার ধর্ম ও ভাষার সঙ্গে নিজের স্বরূপ নির্ণয় করে থাকে। একটি ভাষার মৃত্যু হলে একটি সংস্কৃতিরও মৃত্যু ঘটে। সংস্কৃতির বাহক হচ্ছে ভাষা। ভাষার মৃত্যু হলে সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় সেই ভাষায় রচিত কাহিনি, গল্প, রূপকথা, কিংবদন্তি, ছড়া, কবিতা, গান, ইতিহাস, ঐতিহ্যসহ সবকিছু। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘বাংলাদেশে’ বসবাসকারী অন্য কোনো সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করা হয়নি। অথচ বাংলা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামেই রয়েছে ১১টি জাতিগোষ্ঠীর ভাষা। অন্যদিকে কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও বরগুনায় বসবাস করে “রাখাইন” সম্প্রদায়। তাদের রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা ‘বর্মী’। সাওতাল, ওঁরাও, মান্দিদের নিজস্ব ভাষা আছে। একই ভূখন্ডে বসবাস করলেও নিজস্ব সংস্কৃৃতিকে তারা সঠিকভাবে উদযাপন করতে পারছে না। অথচ ওইসব আদিবাসী জাতিসত্তার রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ভাষা। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আদিবাসীদের মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। সংবিধানের ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদে “জাতীয় সংস্কৃতি” শীর্ষক শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, যাতে সর্বস্তরের জনগণ সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবস্থান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।’
এখানে শুধুমাত্র জাতীয় ভাষা, সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যান্য জাতিসত্তার ভাষা, শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্য সম্বন্ধে কিছু বলা হয়নি। ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকারের প্রণীত চুক্তির ২৭ ধারায় বলা হয়েছে, “যদি কোনো দেশে আঞ্চলিক, ভাষাভিত্তিক বা ধর্মীয় এমন জনগোষ্ঠী থাকে, যারা সেই দেশে সংখ্যালঘিষ্ঠ, তবে তাদের ক্ষেত্রে এ অধিকার অস্বীকার করা যাবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি উপভোগ, নিজস্ব ধর্ম অবলম্বন ও প্রচার এবং নিজস্ব ভাষা ব্যবহারের অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা যাবে না।” ১৯৯৫ সালের আদিবাসীদের অধিকারসমূহের খসড়া ঘোষণায় বলা হয় যে, “সংস্কৃতি ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধিতে বিভিন্ন জাতি যে অবদান রাখে তা মানবজাতির– এক যৌথ অধিকার।”
২০০১ সালের ইউনেস্কো জেনারেল কনফারেন্সের ৩১তম অধিবেশনে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ওপর একটি সার্বজনীন ঘোষণা গৃহীত হয়। আবার ২০০২ সালের এর ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৫৬/১৬২ নম্বর প্রস্তাবটি পাস করিয়ে ভরসা দেয় যে–“জাতিসংঘ লক্ষণ ও সংরক্ষণের উপায় হিসেবে বহুভাষিতা অনুসরণ করবে।” এতোকিছুর পরও শুধুই হোঁচট খাচ্ছে জাতিগোষ্ঠীর ভাষা, শিল্প ও সংস্কৃতি। ইতিহাসের বিবর্তনে নানা সম্প্রদায় ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সম্মিলন ঘটেছে বাংলাদেশের অধীন ১৪৪৫ বর্গকিলোমিটার অধ্যুষিত সুন্দর বনাঞ্চলে। দূর অতীতে পুন্ড্র, পৌন্ড্র, ক্ষত্রীয় শ্রেণিভুক্ত কৌম জীবনযাত্রার মানুষের সংখ্যাধিক্য ছিল এখানে। ক্রমে খাদ্যান্বেষণে, বসবাসের সন্ধানে, লুটপাটের লোভে, ধর্ম প্রচারের অজুহাতে এবং শাসন-শোষণের নিমিত্তে এখানে বসতি গড়ে তোলে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, মগ-ফিরিঙ্গি ও নানা শ্রেণির তফসিলি জাতি। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো বেদে-বাউল, যগবানিয়া, বুনোরা। পাশাপাশি সমাজে বিন্যাস ঘটে উচ্চ ও নিম্ন বর্ণের হিন্দু-মুসলমান, রাজন্য, জোতদার, মহাজন, প্রান্তিক চাষি ও নানা পেশাভিত্তিক শ্রেণির মানুষের। তারই ধারাবাহিকতায় সুন্দরবনের বিচিত্র সার্বভৌম পরিকাঠামোর ওপর গড়ে ওঠে মিশ্র লোকজীবনের সংস্কৃতি। আদি যে ভাষা ধর্ম-বিশ্বাস ও সংস্কারের সংস্কৃতি বয়ে এনেছিল, আজকের সম্প্রদায়ের মাঝে তার ছিটেফোঁটা রয়েছে।
আর হারিয়েছে তাদের আদিম স্বভাব ভাষা, ধর্ম, পূজা-পার্বণ। কালে কালে গ্রহণ করেছে হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতি। সুন্দরবনে মুন্ডারা আজ পরিণত হয়েছে অপজাতে। তারা যে সংস্কৃতি বয়ে এনেছিল, আজকের মুন্ডা সম্প্রদায়ের মাঝে তার ছিটেফোঁটা রয়েছে। তাদের দেখভাল করার যেমন কেউ নেই তেমনই সমাজেও তাদের অধিকার নেই। এক ভগবান তাদের উপাস্য হলেও হিন্দুদের পূজা অর্চনা তাদের করতে হয়। শুধু শীতকালে ‘শারোপ’ পূজাই একমাত্র নিজস্ব কৃষ্টি হয়ে আজ বেঁচে রয়েছে মুন্ডাদের মাঝে।
আমরা কখনোই চাই না গ্রেট–আন্দামানিজ গোত্রের ভাষা বো’র ন্যায় কিংবা প্রতি বছর হারিয়ে যেতে বসা ১১টি আদি জাতিগোষ্ঠীর ভাষার মতো আমাদের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভাষা তথা শিল্প ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাক। শাশ্বত এক সত্য হয়ে এই সরল জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি আরো বিকশিত হোক, বাঙালি সংস্কৃতির রুচিতে তারা আনুক নতুনত্ব–এটাই প্রত্যাশা।