কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

শান্তা মারিয়া

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর নাম শুনে অনেকেই ভাবতে পারেন উনি কে? এমন ভাবা অন্যায় নয়। কারণ, তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানে না এই নিভৃতচারী গুণী মানুষটির নাম। মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর পুরো নাম আবুল জামাল মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ। এদেশের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি, বহুভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পুত্র তিনি। তকীয়ূল্লাহর জন্ম ১৯২৬ সালের ৪ নভেম্বর, ঢাকায়। কিশোর বয়সেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যখন বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন সেসময় তকীয়ূল্লাহও বাবার কাছে ছিলেন। তখন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে বগুড়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে কাজ করেন কিশোর তকীয়ূল্লাহ। ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন মেধাবী। কিন্তু তার কাছে চিরদিনই নিজের ক্যারিয়ার বা উন্নতির চেয়ে মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করাটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টির একজন ছাত্র-কর্মী হিসেবে ভাষা আন্দোলনে জড়িত হন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। অন্যদিকে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ পান। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েও তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেননি। কারণ, তার কাছে মনে হয়েছিল সেনাবাহিনীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চেয়ে সমাজের শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করাটা অনেক বেশি জরুরি। তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। গণমানুষের মুক্তির জন্য মাতৃভাষার অধিকার আদায় তার কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হতো। কারণ, পূর্ব বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মানুষ যদি নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার, শিক্ষার, বিচার চাওয়ার অধিকার না পায় তাহলে তারা সবদিক থেকে বঞ্চিত হবে। তারা শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে, চাকরি ক্ষেত্রে ভীষণভাবে পিছিয়ে পড়বে। তারা আদালতে বিচারটুকুও চাইতে পারবে না। ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও অন্যান্য জায়গায় জনসচেতনতা গড়ে তোলার কাজ করেছেন তকীয়ূল্লাহ। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা অন্দোলনের আলোকচিত্রগুলো তারই তোলা। সেদিন প্রথম গ্রেফতারকৃতদের মধ্যেও তিনি ছিলেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। সেসময় শুরু হয় তার পলাতক জীবন। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে বিভিন্ন শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫০ সালে কমরেড সরদার ফজলুল করিম গ্রেফতার হওয়ার পর ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি হন তকীয়ূল্লাহ। তকীয়ূল্লাহর নামে তখন পুলিশের হুলিয়া বের হয়। তাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য মোটা অংকের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। সেই অবস্থাতেও পার্টির কাজ চালিয়ে যান। তার ছদ্মনাম ছিল ইয়ুসুফ আনোয়ার। ১৯৫০ সালে ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে তকীয়ূল্লাহ জোরালো ভূমিকা রাখেন। বিশেষ করে পুরান ঢাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে রক্ষার জন্য চকবাজারে তিনি প্রতিরোধের কাজ চালিয়ে যান স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে। পাশাপাশি শ্রমিকদের অধিকার আদায়েও কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৫১ সালে গ্রেফতার হন তকীয়ূল্লাহ। তার ওপর নির্মম পুলিশি নির্যাতন চলে। তার কাছ থেকে সহযোদ্ধা কমরেডদের নাম-ঠিকানা আদায়ের জন্য চলে জেরা এবং শারীরিক মানসিক নির্যাতন। কিন্তু শত নির্যাতনেও তিনি তার সহযোদ্ধা কমরেডদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। তার কাছ থেকে কোনো রকম তথ্য আদায় করতে না পেরে তাকে জেলখানা সংলগ্ন পাগলাগারদে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। কিন্তু তিনি শুরু করেন অনশন। অবশেষে সরকার বাধ্য হয় তাকে রাজবন্দীর মর্যাদা দিতে। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী হিসেবে ছিলেন। তাকে অনেক সময় কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। তাকে ফাঁসির ভয় দেখিয়ে বলা হয়েছে মুচলেকা দিতে। কিন্তু তিনি রাজি হননি। এখানে তকীয়ূল্লাহর একটি উক্তি উল্লেখ করছি। গ্রেফতার করার পর পুলিশ তাকে সারারাত নির্যাতন করে বলে, ‘তুমি শুধু একটা বিবৃতি দাও, বলো যে ভুল করেছো। বলো কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরা ভারতের গুপ্তচর। তোমরা নাস্তিক। বলো যে, সমাজতন্ত্র একটা ভুল পথ। এই বিবৃতি দিলে তোমাকে ছেড়ে দেবো। তোমার কোনো শাস্তি হবে না। না হলে কিন্তু তোমাকে দেশদ্রোহী বলে ফাঁসি দেয়া হবে।’ জবাবে তকীয়ূল্লাহ বলেন, ‘সমাজতন্ত্রকে আমি ভুল বললেই তো আর সেটা ভুল হয়ে যাবে না। আমি যদি বলি কাল ভোরে সূর্য উঠবে না তাহলে কি সূর্যের উদয় বন্ধ থাকবে? সমাজতন্ত্র কোনো ভুল আদর্শ না। এটাই একমাত্র সঠিক পথ। আর আমি এই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করছি। আমি দেশদ্রোহী না। আমি দেশপ্রেমিক।’ জেলে বন্দী অবস্থাতেও তিনি বিভিন্ন সময়ে দাবি দাওয়া নিয়ে অনশন করেছেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর কবর নাটক যখন প্রথমবার ঢাকা জেলের ভেতরে অভিনীত হয় তাতে অভিনয় করেন তকীয়ূল্লাহ। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’ এটাই ছিল তাদের স্লোগান। তকীয়ূল্লাহ তাঁর স্মৃতিকথা ‘পলাতক জীবনের বাঁকে বাঁকে’ বইতে জেলজীবনের কথা লিখেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন কিভাবে তারা জেলের ভেতরেও বিপ্লবী চেতনা ধরে রেখেছেন। মিটিং করেছেন। তারা কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল, ‘অনশন বন্দী ওঠ রে জাগো’, ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ ইত্যাদি গান গাইতেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা আবৃত্তি করতেন। তকীয়ূল্লাহ নিজেও কবিতা লিখতেন। ১৯৫৩ সালে কমরেড স্ট্যালিনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তিনি শোকগ্রস্ত হন। আত্মগোপনে থাকার সময় তার সহযোদ্ধা ও বন্ধু কমরেড শহীদুল্লা কায়সারকে লেনিন এবং তাকে স্ট্যালিন বলে যে ডাকা হতো সেই স্মৃতিচারণও করেছেন তিনি। জেলের ভেতরে ৮ মার্চ বন্দী কমরেডরা জোসেফ স্ট্যালিনের জন্য শোকসভা করেন। সেসময় তকীয়ূল্লাহ নিজের লেখা কবিতা পাঠ করেছিলেন। জেলজীবনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখনও তাকে মুচলেকা দিয়ে মুক্তির প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু তিনি রাজি হননি। তার বাবা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে যখন বলা হয় মুচলেকা দিলে ছেলেকে ছেড়ে দেয়া হবে তখন তিনিও কড়া জবাব দেন। শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমার ছেলে দেশদ্রোহী নয়। সেটা হলে তাকে আমি নিজ হাতে গুলি করতাম। আমার ছেলে দেশপ্রেমিক। সে মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করে। তাকে আমি নতি স্বীকারের কথা বলতে পারবো না।’ ১৯৫৫ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তকীয়ূল্লাহ আবার কমিউনিস্ট পার্টির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি জেল পুলিশ ইউনিয়ন, নিউমার্কেট কর্মচারী ইউনিয়নসহ বিভিন্ন কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৬২ সালে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের আমলে তকীয়ূল্লাহ আবার গ্রেফতার হন। এই সময়ও ছয়-সাত মাস জেলে বন্দী থাকতে হয় তাকে। মুক্তি পেয়ে তিনি জামালপুরের বন্যাদুর্গত মানুষের ত্রাণ কার্যে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন। ষাটের দশকেও তকীয়ূল্লাহ কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তবে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যখন পিকিংপন্থি ও মস্কোপন্থির বিভাজন দেখা দেয় তখন তিনি নিজেকে ‘আজীবন মার্ক্সপন্থি’ বলে অভিহিত করে তাত্ত্বিক গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। কারণ, তার কাছে মনে হয়েছিল সমাজতন্ত্র বিষয়ক তাত্ত্বিক গবেষণা এবং এর পাঠ অত্যন্ত জরুরি। সেটাই যাবতীয় মতভেদ ও বিভ্রান্তি দূর করতে পারে। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তিনি অংশ নেন। সত্তর সালে ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত জনপদে ত্রাণকাজে অংশ নেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তকীয়ূল্লাহ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন। বুদ্ধিজীবী হত্যার সময় ঘাতক বাহিনী তার সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায়। তবে নিতান্ত ভাগ্যবলে তিনি বেঁচে যান। তকীয়ূল্লাহ বাংলাদেশের বর্ষপঞ্জি নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং একে সর্বসাধারণের জন্য সহজ করে তোলার কাজটি করে গেছেন। তিনি বাংলা বর্ষপঞ্জির অন্যতম সংস্কারক। তিনি নিজের বাড়িতে বয়স্ক শিক্ষা প্রদানের কাজ করতেন এবং আরও নানা রকম সমাজসেবামূলক কাজ করে গেছেন। তকীয়ূল্লাহ আজীবন সমাজতন্ত্রে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। তিনি যখন হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় তখনও কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তাকে দেখতে গিয়ে যখন বলেন ‘কমরেড তকীয়ূল্লাহ কেমন আছেন?’ তখন সেই মুমূর্ষু অবস্থাতেও তিনি চোখ মেলে তাকান। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বাসের জন্য তিনি ব্যক্তিগত জীবনের সুখ সুবিধা, ক্যারিয়ার সবই ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু এজন্য তার কোনো আফসোস ছিল না। তিনি বলতেন, ‘আমার মানবজন্ম আমি বৃথা ব্যয় করিনি। বিশ্বের মহত্তম আদর্শ হলো সাম্যবাদ। আমি আমার তারুণ্য উৎসর্গ করেছি এই আদর্শের জন্য।’ ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর কমরেড মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। তার বন্ধু কমরেডরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন যে মহত্তম আদর্শে, যে সাম্যবাদী বিশ্ব গড়ার যুদ্ধে, সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে, তিনি আজীবন তাতে আস্থা রেখে গেছেন। তিনি আমৃত্যু বিশ্বাস করেছেন বিশ্বে সাম্যবাদ একদিন প্রতিষ্ঠিত হবেই, সকল মানুষের মুক্তি নিশ্চিত হবে, প্রতিষ্ঠিত হবে শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন মানবসমাজ।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..