শ্রমিকের রক্তের রং তো লালই! যারা ঝরায়, তাদের?

রুহুল আমিন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
রাসেল হাওলাদার, ইমরান হোসেন, আঞ্জুয়ারা বেগম ও জালাল উদ্দিন শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে; নির্বাচনী হাওয়ায় বিলীন হতে চলেছে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন। দীর্ঘদিন ধরে চলমান পোশাক শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি বৃদ্ধির দাবি তীব্র আন্দোলনে রূপ নেয় মালিকপক্ষের ১০ হাজার ৪০০ টাকা নিম্নতম মজুরি প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে। একে একে রাজপথে নেমে আসতে থাকে মিরপুর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভারসহ সারাদেশের পোশাক শ্রমিকরা। আন্দোলন দমনে সক্রিয় হয়ে ওঠে পুলিশ-প্রশাসন ও মালিকদের পেটোয়া বাহিনী। শ্রমিকদের ভাষ্য অনুযায়ী পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ৩ জন, একজন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। বাধ্য হয়ে সরকার ও মালিকপক্ষ নতুন নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করে ১২ হাজার ৫০০ টাকা। শ্রমিকরা এ প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে তাদের ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে নিম্নতম মজুরির দাবিতে অনড়। মূল্যস্ফীতি ও বাজার সিন্ডিকেটের এই সময়ে কবি রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র চিবিয়ে খাবো’ চরণের মতো হাহাকার ও হুঙ্কার আর সুকান্তের ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ কবিতার মতো অভাব ও বেদনা নিয়ে গড়ে ওঠা পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন পুঁজি ও ক্ষমতার কাছে অসহায়। শহীদ হওয়া একেকজন শ্রমিক বোধহয় রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে কেবলই সংখ্যা, এ নিয়ে কোন প্রদক্ষেপ নেই যে! এদেশের মানুষের কাছে নিহত শ্রমিকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ আর রহমানের গান, হিরো আলম, বিরাট কোহলির রেকর্ড ও এতে তার স্ত্রীর অবদান, মেসি-রোনালদোর গোলের সংখ্যা। সামনে নির্বাচন। ইতিমধ্যে তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ নবগঠিত কতিপয় রাজনৈতিক দল ও ইসলামী দলসমূহ নির্বাচন নিয়ে মহাব্যস্ত। কতিপয় শ্রমিক সংগঠন ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ কয়েকটি বাম সংগঠন তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবির সাথে সাথে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ ও শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবিতে লাগাতার বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও বাকিদের যেন কোন দায় নেই। দেশের অন্যান্য পেশাজীবী মানুষ, কবি-সাহিত্যিক, লেখক-বুদ্ধিজীবী, নায়ক-গায়ক শ্রমিকের মৃত্যুতে কারও কিছু যায় আসে না! অথচ, এই রাসেল, ইমরান, জালালউদ্দিন, আঞ্জুয়ারাদের আধপেট খাওয়া অপুষ্টিজনিত শরীরের শ্রমে ও ঘামেই দেশের তথাকথিত উন্নয়ন। জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় এসে পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেছিলেন রাসেল হাওলাদার। ঝালকাঠি সদরের বিনয়কাঠি ইউনিয়নের খাগুটিয়া গ্রামের ছেলে রাসেল গাজীপুরের পোশাক কারখানা ডিজাইন এক্সপ্রেস লিমিটেডের ইলেকট্রিশিয়ান পদে চাকরি করতেন। পোশাক শ্রমিকেরা নিম্নতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে, রাসেলও আন্দোলনে যোগ দেন। হয়তো রাসেলের মনে হয়েছিল অভাবের সংসার, যদি কিছু বেতন বৃদ্ধি হয় তাহলে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকা যাবে! ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে গিয়ে জীবনটাই হারিয়ে ফেললো সে। রাসেলের মা রাশেদা বেগম কোনোভাবেই মানতে পারছেন না ছেলের মৃত্যু। বারবারই মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। রাসেলের শোকে কাতর তার পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব। কিভাবেই বা এমন মৃত্যুর শোক সামাল দেবে পরিবার! রাসেলকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সহকর্মী ও রুমমেট মো. আবু সুফিয়ান জানান, আন্দোলন চলাকালীন সময় কারখানার সামনে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি করে। এতে রাসেল বুকের ডান পাশে এবং ডান হাতে গুলিবিদ্ধ হন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে নেওয়া হয় শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেলে। অবস্থার অবনতি দেখে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। একই দিন একটি কারখানায় দেওয়া আগুনে দগ্ধ হয়ে ইমরান হোসেন নামের আরেক কর্মীরও মৃত্যু হয়। গাজীপুরে আন্দোলন চলাকালীন পোশাক শ্রমিকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন আঞ্জুয়ারা বেগম। আঞ্জুয়ারা সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার চরগিরিশ ইউনিয়নের চর নাটিপাড়া গ্রামের মাজেদা খাতুন ও মৃত মন্টু মিয়া দম্পতির মেয়ে। তার আরিফ নামে সাত বছরের একটি ছেলে ও জয়া নামে ছয় বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে। কোনাবাড়ীর ইসলাম গার্মেন্টসে সেলাই মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন আঞ্জুয়ারা বেগম। আঞ্জুয়ারার মৃত্যুর খবর শুনে তার মা মাজেদা খাতুন যেন বাকরুদ্ধ। ছোট মেয়ের এমন মৃত্যুতে কিছুতেই থামছে না তার আহাজারি। খবর পেয়ে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন তাদের বাড়ি। কেউ দেন সান্ত¡না, কেউ ফেলেন চোখের পানি। কাঁদতে কাঁদতে পাগলপ্রায় আঞ্জুয়ারার দুই সন্তান। গাজীপুরের কোনাবাড়ীর জরুল এলাকায় শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে জালাল উদ্দিনের শরীরে ‘ছররা গুলি’ লাগে। আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি হন পোশাক শ্রমিক জালাল উদ্দিন। চিকিৎসাধীন বাবাকে দেখতে মায়ের সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এসেছিল শিশু জান্নাতুল ফেরদৌস বাকিয়া। কিন্তু সেখানে এসে দেখতে পায়, বাবা আর বেঁচে নেই। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, বাবাহারা মেয়েটি হাসপাতালের মর্গের সামনে তাকিয়ে আছে। তার নিষ্পলক চোখে ভয়াবহ শূন্যতা। যেন এ সমাজের মানুষকে কটাক্ষ করে বলছে, তোমরা এভাবে আমার বাবাকে মেরে ফেলতে পারলে! মায়ের বুকফাটা কান্নার মাঝেই ৯ বছর বয়সী বাকিয়া বারবার প্রশ্ন করেছিল, ‘বাবা কোথায়? আমি বাবার কাছে যাব।’ কিন্তু তার আর বাবার কাছে ফিরে যাওয়া হয়নি। বাবার লাশ নিয়েই তাকে ঘরে ফিরতে হয়েছে। প্রাণহানি এড়ানোর জন্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছররা গুলি ব্যবহার করে। কিন্তু এখানে সেই ছররা গুলিতেই জীবন দিতে হলো জালাল উদ্দিনকে। দেশের সকল উপার্জনকারী খাত যখন নিম্নমুখী, ঠিক সেই সময়ে ক্রমাগত রপ্তানি বাড়ছে পোশাক খাতের। গত এক দশকে পোশাক খাতে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১২০ শতাংশ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত তিন দশকে পোশাক খাতে রপ্তানি বেড়েছে ২৪ গুণ, কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে মাত্র ১৩ গুণ। দেশের সর্বোচ্চ উপার্জনকারী খাতে শ্রম নিয়োগ করার পরেও পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে দেশের প্রয়োজনীয় সবকিছুর মূল্য, কিন্তু শ্রমের মূল্য বাড়ছে না। বাড়ছে না শ্রমিকের যথাযথ মজুরি। এভাবে চললে শ্রমিকরা কিভাবে বাঁচবে, প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট সবার। একে একে বন্ধ কারখানা খুলছে। বাধ্য হয়ে কাজে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। নিহত শ্রমিকদের কিছু নগদ অর্থ প্রদান করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়, এমনকি শ্রমিক হত্যার বিচারিক প্রদক্ষেপও নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ শ্রমিক নেতাদের। তাদের দাবি, প্রহসনের বেতন কাঠামো পুনরায় সংস্কার করে অবিলম্বে নিম্নতম মজুরি বৃদ্ধি করতে হবে; সেইসাথে নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার দুই বিঘা জমি কবিতায় লিখেছেন, “আমি কহিলাম, শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়! বাবু কহে হেসে বেটা সাধু বেশে চোর অতিশয়/ আমি শুনে হাসি, আঁখি জলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে-তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।” পোশাক শ্রমিকদের অবস্থা অনেকটা এমনই। ন্যায্য মজুরির দাবিতে আন্দোলন করলেন, আহত হলেন-শহীদ হলেন কিন্তু দাবি আদায় হলো আংশিক। এদিকে মালিকপক্ষের ক্রোধের অনলে জ¦লছে আন্দোলনরত শ্রমিকরা। কেউ ছাঁটাই হচ্ছে, কেউ গ্রেফতার হয়ে জেল খাটছে, কেউ মামলা কাঁধে নিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে, কেউ আবার মালিকপক্ষের নিয়োগকৃত গুণ্ডাপান্ডার ভয়ে কারখানায় যেতে ভয় পাচ্ছে– এমনই অবস্থা। এক বুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শব্দ শ্রমিক বলে ওঠে, “আহত হলাম আমি, ঘাতকের বুলেটে বুকের রক্ত ঢেলে আমিই নিহত হলাম; অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই আমিই আজ অপরাধী। আমার শরীরের জীর্ণ পোশাকে লেগে আছে ঘামের গন্ধ, মুখে নেই কোনো শ্রী। আমি খুব সাধারণ, কঙ্কালসার দেহ আমার। বারবার মরে যাই আমি। কখনো ভবন ধসে, কখনো আগুনে পুড়ে, কখনো গুলিবিদ্ধ হয়ে আমারই রক্ত ঝরে। আমার রক্তের রং তো লালই! আর যারা ঝরায়, তাদের? লেখক : সাহিত্যিক

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..