মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বন্দ্ব এবং পশ্চিমী বামদের চীন বিরোধিতা
প্রভাত পট্টনায়েক
বামপন্থি, কিন্তু কমিউনিস্ট নয়- পশ্চিমী দুনিয়ার এমন শিবিরের গুরুত্বপূর্ণ অংশই মনে করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে ক্রমশ বেড়ে ওঠা দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যকার প্রতিযোগিতারই প্রতিফলন। এদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের এমন চরিত্রায়ন তিনটি সুনির্দিষ্ট তাত্ত্বিক অবস্থানকে স্পষ্ট করে। প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ক্রমাগত বেড়ে চলেছে ও তীব্র হচ্ছে, এদের অবস্থান তার একটা ব্যাখ্যা হাজির করে। দ্বিতীয়ত, লেনিনবাদী ধারণার ভিত্তিতে এবং লেনিনবাদী ভাবনা-কাঠামোকে কাজে লাগিয়েই এই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এবং তৃতীয়ত, এদের অবস্থান থেকে একটি উঠতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে চীনের ভূমিকার সমালোচনা করা হয়। অতএব সেই অবস্থানে অনুমান করেই নেওয়া হয় যে, চীনের অর্থনীতি হল পুঁজিবাদী অর্থনীতি। এই সমালোচনার সঙ্গে অতিবামদের চীন সম্পর্কে সমালোচনা মিলে যায়।
এ ধরনের চরিত্রায়ন বামেদের এই অংশগুলিকে, কখনও স্পষ্টত কখনওবা কিছুটা রেখে ঢেকে, চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তের সহযোগী করে তোলে। একদিকে, এই চরিত্রায়ন এমন একটা অবস্থানে পৌঁছে দেয় যেখানে ধরে নেওয়া হয় দুটো দেশই সাম্রাজ্যবাদী, তাই একের বিরুদ্ধে অন্যকে সমর্থনের প্রয়োজন নেই। এর সবচেয়ে জঘন্য দিকটা হল, এই অবস্থান চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই সমর্থন করতে বলে। কারণ, দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সংঘাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই তারা ‘কম বিপজ্জনক’ (‘lesser evil’) মনে করে। দুটি ক্ষেত্রেই চীনের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে আক্রমণাত্মক অবস্থান, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জায়গাটি মুছে যায়। যেহেতু চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুটি দেশই এখন বেশিরভাগ সাম্প্রতিক ইস্যুগুলি নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে, তাই দুটি দেশকেই সাম্রাজ্যবাদী মনে করা হলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা সম্পর্কে সাধারণ নীরবতা বজায় রাখার সুবিধা হয়।
বেশ কিছুদিন ধরেই, পশ্চিমী বামেদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এমনকী যারা সাধারণভাবে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার কথা বলে তারাও, নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের কাজকর্মের সমর্থন করে আসছে। সার্বিয়ায় যখন স্লোবোদান মিলোসেভিচ ক্ষমতায় ছিলেন, তখন সেখানে ন্যাটোর বোমাবর্ষণকে সমর্থন করেছিল পশ্চিমী বামেদের এই অংশগুলি। ইউক্রেন যুদ্ধে এরা যখন ন্যাটোর পক্ষে দাঁড়িয়ে পড়েছে, তখনও এদের অবস্থানটা স্পষ্ট ধরা পড়েছে। এখন যখন পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের সক্রিয় সমর্থনে ইজরায়েল গাজায় ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে তখনও এরা তার কোনও শক্তিশালী বিরোধিতা করছে না, যা সত্যিই স্তম্ভিত করার মতো। চীনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী অবস্থান সম্পর্কে পশ্চিমী বামেদের কিছু অংশের নীরবতা অথবা সমর্থন, ওপরের অবস্থানগুলোর মতো হুবহু একই ধরনের নয় নিশ্চয়ই, তবে এই দুটি অবস্থানের মধ্যে মিল রয়েছে তো বটেই।
এই ধরনের অবস্থান যা সামনাসামনি পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করে না, তা মেট্রোপলিটান দেশগুলির শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গির পুরোপুরি বিরোধী। এ কথা বলা যায় যে, ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণি ইউক্রেনে ন্যাটোর ছায়াযুদ্ধের দারুণভাবে বিরোধী। এটা স্পষ্ট হয় যখন বহু ক্ষেত্রে ইউক্রেনের জন্য পাঠানো ইউরোপের অস্ত্র জাহাজে বা বিমানে তুলতে শ্রমিকেরা অস্বীকার করেন। এটা খুব আশ্চর্য করার মতো ঘটনাও নয়। কারণ, এই যুদ্ধ মূল্যবৃদ্ধিকে বাড়িয়ে তুলে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে শ্রমিকদের জীবনযাপনে। কিন্তু বামেরা যুদ্ধের অবিচল বিরোধিতার অবস্থান না নেওয়ায় অনেক শ্রমিকই ঝুঁকে পড়ছেন দক্ষিণপন্থি দলগুলির দিকে। দক্ষিণপন্থি এই দলগুলি যদিও ক্ষমতায় বসার পরেই সাম্রাজ্যবাদীদের দোসরের ভূমিকা পালন করে। ঠিক ইতালিতে যেমনটা করেছেন মেলোনি। আবার বিরোধীপক্ষে থাকলে তারা মুখেও অন্তত যুদ্ধ সরবরাহ পাঠানোর বিরোধিতা করে। কিন্তু পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের নিরিখে পশ্চিমী বামেদের এই নীরবতার কারণে বেশিরভাগ মেট্রোপলিটান দেশগুলির সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র সরে যাচ্ছে দক্ষিণপন্থার দিকে। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বকে সাম্রাজ্যাবাদীদের মধ্যকার প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখার বিষয়টাও এই ন্যারেটিভে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে।
চীন একটি পুঁজিবাদী দেশ এবং সেকারণে সারা বিশ্বজুড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে এই দেশটি সাম্রাজ্যবাদী কাজকর্ম করে চলেছে- যারা এই মতের সমর্থক, তারা বড়জোর একটা নীতিবাদী অবস্থান নিচ্ছেন এবং মনে করছেন ‘পুঁজিবাদ’ মানেই ‘খারাপ’ এবং ‘সমাজতন্ত্র’ মানেই ‘ভালো’। কার্যত তাঁদের বক্তব্যটা দাঁড়ায় এরকম: সমাজতান্ত্রিক সমাজের কী ধরনের আচরণ হওয়া উচিত সে বিষয়ে আমার নিজস্ব ধারণা আছে (যেটা আসলে একটা মনগড়া ধারণা), এবং যদি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার ধারণার সঙ্গে চীনের আচরণের পার্থক্য ধরা পড়ে, তাহলে কার্যত চীন আর সমাজতান্ত্রিক দেশ থাকতে পারে না, অতএব চীন অবশ্যই পুঁজিবাদী দেশ। মনে রাখা দরকার পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক- এই দুটি শব্দের সুনির্দিষ্ট মানে আছে। এর তাৎপর্য হল, খুবই নির্দিষ্ট ও ভিন্ন ধরনের সামাজিক গতিশীলতার সঙ্গে এই দুটি শব্দবন্ধের সম্পর্ক রয়েছে। এবং প্রতিটি ধরনের গতিশীলতার শিকড় রয়েছে এক ধরনের মৌলিক সম্পত্তি সম্পর্কের মধ্যে। এটা সত্যি যে, চীনে একটা উল্লেখযোগ্য পুঁজিবাদী ক্ষেত্র রয়েছে, যার চরিত্রায়ন করা যায় পুঁজিবাদী সম্পত্তি সম্পর্কের নিরিখেই। কিন্তু চীনের অর্থনীতির প্রধান বা বেশিরভাগ অংশই এখনও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এবং তার বৈশিষ্ট্যই হল কেন্দ্রীভূত পরিচালনা, যা অর্থনীতিকে স্বতশ্চালিত (বা স্বতঃস্ফূর্ত’) হওয়া থেকে আটকায়। এখানে মনে রাখা দরকার যে, অর্থনীতি স্বতশ্চালিত (বা ‘স্বতঃস্ফূর্ত’) হওয়াটাই পুঁজিবাদের অভিজ্ঞান। চীনের অর্থনীতি ও চৈনিক সমাজের নানা দিক সম্পর্কে কারোর সমালোচনা থাকতেই পারে। কিন্তু এই দেশটিকে ‘পুঁজিবাদী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া এবং সেকারণে চীন পশ্চিমী মেট্রোপলিটান অর্থনীতিগুলির মতো সমান তালে সাম্রাজ্যবাদী কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করাটা আসলে পুরোপুরি হাস্যকর। এটা শুধুমাত্র বিশ্লেষণগতভাবেই ভুল নয়, এতে শেষ পর্যন্ত যে জায়গায় পৌঁছে যেতে হয় তা স্পষ্টতই মেট্রোপলিটান দেশগুলির শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থের
বিরুদ্ধে তো বটেই, এমনকি সমগ্র দক্ষিণ গোলার্ধের শ্রমিক স্বার্থেরও বিরুদ্ধে।
লেখক : মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও সাবেক অধ্যাপক, জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়
Login to comment..