
একতা বিদেশ ডেস্ক :
মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েলের নেতৃত্বে নিরব গণহত্যা সংগঠিত হচ্ছে গাজা উপত্যকায়। ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে গাজার সবচেয়ে বড় তিন হাসপাতাল। বাকি হাসপাতাল গুলোতেও কোন চিকিৎসা উপকরণ নেই। মৃত্যু উপত্যকায় পরিনত হয়েছে গাজা। অসম লড়াই জেনেও গাজাবাসী লড়ছে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের প্রত্যক্ষ মদদপুষ্ট ইসরায়েল, অন্যদিকে স্বল্প সামর্থ্যের হামাস ও নিরস্ত্র গাজাবাসী।
ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অপবাদ দিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি কিছু গণমাধ্যম। কোনো কোনো মুসলিম দেশের সরকারও তাদের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যারা নিজের মাতৃভূমিকে দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করে তারা কখনোই সন্ত্রাসী হতে পারে না, তারা মুক্তিকামী। এই লড়াই তাদের ন্যায্য অধিকার।
পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার ফিলিস্তিনের হামাসকে সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির বিরুদ্ধে যেসব ফরাসি, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তাদেরকে তারা বীর বলে মনে করে। এখানেও তাদের দ্বিমুখী আচরণ স্পষ্ট।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে যখন জার্মান বাহিনী ফ্রান্সের দখল নেয় তখন দেশটির মানুষের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। মার্শাল পিটেইনের নেতৃত্বে একটা অংশ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে আপোষ করে এবং দখলদার বাহিনীর কৃপায় একটা পুতুল সরকারের নেতৃত্ব দিতে থাকে, যাদের কোনো ক্ষমতাই ছিল না। কিন্তু ফরাসিদের অন্য অংশ অপমান মেনে নেয়নি, তারা প্রতিরোধের পথেই এগোতে থাকে। এই প্রতিরোধে ফ্রান্সের হাজার হাজার নারী ও পুরুষ অংশ নেয়। তারা দখলদার নাৎসি বাহিনীর দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে সংগ্রাম করেন, অবশ্য এর জন্য তাদেরকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।
আগ্রাসী ও দখলদার বাহিনীর হুমকিপূর্ণ একটি বার্তা ছিল এরকম: “যেকোনো সন্ত্রাসী তৎপরতার পর অপরাধের ধরণের ওপর ভিত্তি করে কিছু লোককে হত্যা করা হবে।”
বলা হয়ে থাকে, ফ্রান্সে দখলদারির সময় হিটলারের বাহিনী, ফ্রান্সের ৩০ হাজার সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছিল, এর কয়েক গুণ মানুষকে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও দেশছাড়া করেছিল।
কেবল ফরাসিরাই প্রতিরোধ করেছে এমন নয়। রাশিয়া, হাঙ্গেরি, লুক্সেমবার্গ, স্পেন, ইতালি, পোল্যান্ড, আমেরিকা এমনকি ফ্যাসিজম-বিরোধী কিছু জার্মান এই প্রতিরোধ ফ্রন্টের সঙ্গে কাজ করত ও তাদেরকে সহযোগিতা দিত। ফ্রান্সের প্রতিরোধ ফ্রন্ট, ডি-ডে’র বিজয় এবং ৫০ মাসের দখলদারিত্ব থেকে ফ্রান্সকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ফ্রান্সের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বীরের সম্মান দিলেও নিজ ভূখন্ডের অস্তিত্ব রক্ষার্থে যুদ্ধ করা হামাস পশ্চিমাদের কাছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। প্রতিদিন শতশত নিরীহ নিরাপরাধ শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। তবুও যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের চোখে ইসরায়েলি বাহিনীর কোন দোষ নেই, সব দোষ হামাস ও গাজাবাসীর।
সারাবিশ্বের শান্তিকামী ও বিবেকবান মানুষ অবিলম্বে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে, নিজ নিজ সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। খোদ ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ পৃথিবীর অনেক দেশে যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছে লাখ লাখ মানুষ।
প্রথম থেকেই ইউরোপীয় দেশগুলোর কর্তৃপক্ষ ইসরাইলকে সমর্থন করার সময় ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইহুদিবাদী শাসক গোষ্ঠীর দমন ও হত্যার নীতিকে ইসরায়েলের অধিকার বলে মনে করে আসছে এবং তারা তেল আবিবকে সমর্থন করার সাথে সাথে তারা ফিলিস্তিনের সমর্থকদের নানাভাবে হুমকি ও শাস্তি দেয়ার কথা বলছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যুদ্ধে নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হচ্ছে। গাজার পরিস্থিতি প্রকৃতপক্ষে ইউরোপ এবং আমেরিকার অনেক লোককে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর নীতির নিন্দা করতে এবং ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষার দাবিতে বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বড় আকারের বিক্ষোভের আয়োজন করছে।
ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় কর্তৃপক্ষের কঠোর অবস্থানের ধারাবাহিকতা এবং ফিলিস্তিনিদের সমর্থকদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা সমাজের সমস্ত স্বাধীনতাবাদী স্লোগানের বিপরীতে দ্বিগুণ অবস্থান গ্রহণ প্রকৃতপক্ষে বিশ্বে জাতিগত ও ধর্মীয় বৈষম্যের বিস্তার ঘটিয়েছে। প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ৭ অক্টোবর থেকে ফ্রান্সে ১১০০ টিরও বেশি ইহুদি-বিরোধী কর্মকাণ্ড রেকর্ড করা হয়েছে, যা ম্যাক্রোঁর মতে, পুরো বছরের তুলনায় গত কয়েক সপ্তাহে ফ্রান্সে বসবাসকারী ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক কর্মকাণ্ড তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত অসংখ্য ইহুদি গাজায় ইসরায়েলি কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করছেন। ইসরায়েলের কট্টরপন্থী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর অন্যায়ের দায় তাদের সম্প্রদায়ের উপর পড়ুক, তা ইহুদিরা চান না।
প্রকৃতপক্ষে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের প্রতি তাদের নীতি এবং সমর্থনেরে ক্ষেত্রে বিশ্বের জনগণকে দেখিয়েছে যে তারা স্বাধীনতার ইস্যুতে তাদের নিজস্ব স্লোগান মেনে চলে না। তাই তারা ফিলিস্তিনি সমর্থকদের পাশাপাশি ফিলিস্তিনকে রক্ষা করা লেখক ও সাংবাদিকদেরও তারা নানাভাবে হয়রানি এবং কোনঠাসা করার চেষ্টা করছে। পশ্চিমাদের এই দ্বিমুখী নীতি খোদ পশ্চিমা সমাজে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। ফ্রান্সসহ ইউরোপের অধিকাংশ দেশের আইন অনুযায়ী, গায়ের রং, জাতি, ধর্ম, বয়স ও অক্ষমতার কারণে কারো অধিকার নেই; মানুষকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলির বর্তমান বাস্তবতা দেখায় যে এই আইনগুলি বেশিরভাগই কাগজে-কলমে রয়ে গেছে এবং এখন পরিসংখ্যান দেখায় যে শুধুমাত্র ফ্রান্সে নয়, সমগ্র ইউরোপে জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে।” এফবিআই পরিচালক ক্রিস্টোফার রে এই বিষয়ে সতর্ক করেছেন: ইহুদি বিরোধীতা ঐতিহাসিক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
ইউরোপীয় দেশগুলো যখন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে ইসরাইলের হত্যা নীতিকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তখন মনে হচ্ছে বিশ্বের জনমত কেবল এই বিষয়টিকে মেনে নিচ্ছে না বরং এখন সব স্লোগানের বিপরীতে জনগণের ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানবতাবাদ, ধর্ম এবং বর্ণের মধ্যে ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি এমন একটি সমস্যা যা এর তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে প্রকৃতপক্ষে জননিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে। মানবাধিকার এবং স্বাধীনতার ইস্যুতে পশ্চিমা সমাজের স্লোগানের শূন্যতা আরও বেশি করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
এক সাক্ষাৎকারের ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন পরিষ্কার করে বলেছেন, “এইসব শিশু, নারী এবং বৃদ্ধদের বোমা মেরে হত্যা করছে ইসরাইল। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের কোনো বৈধতা নেই। ফলে আমরা শিগগিরই এই যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানাই।”
প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রনের এই বক্তব্যের মধ্যদিয়ে মূলত ইহুদিবাদী ইসরাইলের ওপর পশ্চিমা চাপ প্রকাশ্য হলো।