জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাধা রুখে নির্বাচনে সরকার
ঐশ্বর্য সৌরভ
সব বাধা উপেক্ষা করে যে কোনো উপায়ে সংবিধান নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নির্বচনের কঠোর অবস্থান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। তফসিল ঘোষণার পর এই প্রক্রিয়ায় আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলো সরকার। তবে চলমান সংকটের সমাধান না করে একতরফা নির্বাচন সহিংস পরিস্থিতি আরও তীব্র হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাপও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি আরও বড় ধরণের ধ্বংসাত্বক পথ বেছে নিতে পারে এমন পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। একের পর এক অবরোধ দিয়ে চলেছে বিএনপি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হরতালও। প্রতিদিনই গণপরিবহনে আগুন দেওয়া হচ্ছে, ১০-১২টি করে যানবাহন পুড়ছে। যদিও সরকার এটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। উল্টো ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন– ‘তেমন কিছুই করতে পারছে না বিএনপি’। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর গত ১৭ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচনের তারিখ যদি ঘোষণা হয় বাংলাদেশে মহাপ্লাবন হয়ে যাবে, এমনই তো শুনেছি। কই কোনো প্লাবন তো দেখলাম না। একটা দুইটা গাড়ি পুড়ালেন, একটা দুইটা বাস পুড়ানো হলো।’’
তবে সরকারের মন্ত্রী আওয়ামী লীগের নেতারা প্রকাশ্যে যাই বলুক নির্বাচন ঠেকানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে বিএনপি বড় ধরণের ধ্বংসাত্বক পথ বেছে নিতে পারে এমন আশঙ্কা তারাও করছেন সংশ্লিষ্টগুলো বলছে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতসহ যে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো আছে তারাও তৎপর রয়েছে। সরকারের আইনশঙ্খলা রক্ষাবাহিনীগুলো এদেরকে চাপে রাখার চেষ্টা করছে এবং আপাতদৃষ্টিতে অনেকটা চাপেও রয়েছে। কিন্তু এভাবে কতটুকু দমিয়ে রাখতে পারবে সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্র্রণে আনতে সরকারও সর্বোচ্চ পদক্ষেপগুলোই নেবে। কারণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃৃঙ্খললা বাহিনীগুলোর সক্ষমতা অনেক বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এর পাশাপাশি সরকারি দলের নেতাকর্মীরাও মাঠে আছে এবং তাদের অবস্থান আরও জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্রগুলো থেকে জানা যায়।
তবে তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলেও সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের সমাধান না করে সরকার নির্বাচনের দিকে আগালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকেও বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলোর চাপ আরও বাড়তে পারে। কূটনৈতিক সুত্রগুলোর ভিত্তিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে এ আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র সংলাপের আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়েছে। তবে এর কোনো প্রভাব নেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। আওয়ামী লীগ সরাসরি সেটি নাকচ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন করলে যুক্তরাষ্ট্র আরও কঠোর অবস্থান নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারমন্যান জিএম কাদেরের সাথে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাতের পর দলের সভায় জিএম কাদের বলেছেন– নির্বাচনে গেলে স্যাংশন আসতে পারে। গত কিছু দিন ধরে যে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কথা শোনা যাচ্ছিলো জিএম কাদেরের সাথে মার্কিন রাষ্ট্র্রদূতের সাক্ষাতের পর সেটা এখন প্রকাশ্য আলোচনায় চলে আসছে।
আওয়ামী লীগের একটি সুত্র থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে ঠেকানো বা নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিএনপির চেয়েও বেশি কঠোর অবস্থান নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র এ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সাম্প্রতিক তৎপরতা এবং এটা আরও বাড়তে পারে এ সব কিছু জেনেই সরকার তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। গত ২২ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে বিএনপিকে বসাবে এমন নয়। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় একটি মহল চায় পুতুল সরকার।
এদিকে নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার বিপরীতে ভারতের প্রকাশ্যে বক্তব্যে ভারসাম্য তৈরি হয়েছে বলে আওয়ামী লীগ মনে করছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সরাসরি বিরোধীতা শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষে অবস্থান স্পষ্ট করেছে রাশিয়া। ঢাকায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত, মস্কোতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র দফতর এবং ঢাকায় সফরে এসে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বক্তব্য বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের এক ধরনের প্রতিবাদ হিসেবেও মনে করা হয়। এছাড়া আগামী নির্বাচন নিয়ে চীনের রাষ্ট্রদূতও যে বক্তব্য দিয়েছেন তার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে চীনের অবস্থানও স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু এরপরও ভারতের প্রকাশ্য অবস্থানটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে আওয়ামী লীগ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটসহ বিভিন্ন দিকে থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতে চায় রাশিয়া। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পর যে সম্পর্ক তৈরি হয় ৭৫ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেই সম্পর্কে তার ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। রাশিয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও একটা বিশাল পরিবর্তন আসে। তবে শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের সময় সেই সম্পর্ক পুনরায় প্রতিষ্ঠা হয়। পাশাপাশি বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়টি রয়েছে। স্বাধীনতার পর এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে রাশিয়া। ১ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাস্তবায়ন হচ্ছে যার ৯০ ভাগেরও বেশি ঋণ সহায়তা দিচ্ছে রাশিয়া। তাছাড়া রাশিয়ান নিজস্ব প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞদের দ্বারাই এটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের একটি সুত্র থেকে জানা যায়, রাশিয়ার সহযোগিতায় এতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে যেটা যুক্তরাষ্ট্রের চাইনি। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকার সমস্যায় পড়ুক বা সরকারের ধারাবাহিকতা নষ্ট হোক এটা রাশিয়াও চায় না। বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক তৎপরতার প্রেক্ষাপটে গত ৫ অক্টোবর রাশিয়া থেকে আমদানি করা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লালাদিমির পুতিনের অংশগ্রহণ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। পাশাপাশি নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দুই দিক থেকেই বাংলাদেশের এই নির্বাচনকে ভারত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ভারতের উত্তর পূর্বের ৭টি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা নিয়ে এক সময় দেশটির পক্ষ থেকে অভিযোগ ছিলো বাংলাদেশের ভেতরে সীমান্ত এলাকা বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ব্যবহার করে, কিন্তু শেখ হাসিনা আসার পর এই অবস্থার পরির্তন হয় এবং ওই রাজ্যগুলোতে এই তৎপরতা কমে আসতে থাকে। বাংলাদেশের আইন-আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সীমান্ত এলাকার (হবিগঞ্জ) গভীর জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ভারী অস্ত্র ও গোলা বারুদও উদ্ধার করে।
অভিযোগ আছে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে মাত্রায় তৎপর হয়ে উঠেছে এর পেছনের প্রধান কারণ তাদের অনুগত সরকার বসানো। সেটা নির্বাচিত অনির্বাচিত যেটাই হোক, এর মাধ্যমে এখানে শক্ত অবস্থান করে নিতে। আর সেটা হলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ চাইবে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে আরও হস্তক্ষেপের সুযোগ পাবে যেটা ভারতের জন্যও হুমকী হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে দেশটি মনে করে। আর এ কারণেই নির্বাচন নিয়ে মার্কিনীদের এই তৎপরতাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না ভারত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাতে বেশি মাথা না ঘামায় সেটা ভারত স্পষ্ট করে তুলে ধরছে বলে ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
গত ১০ নভেম্বর দিল্লিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের ‘টু প্লাস টু’ বৈঠকের পরে সংবাদ সম্মেলনে দেশটির পররাষ্ট্র সচিব ভিনয় কোয়াত্রা সাংবাদিকদের উত্তরে বলেন, ‘একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে সেদেশের মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, সেই ‘ভিশন’ কে ভারত কঠোরভাবে সমর্থন করে। বাংলাদেশের নির্বাচন সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং সেদেশের মানুষই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই স্পষ্ট করে তুলে ধরেছি আমরা। এক বন্ধু এবং সঙ্গী দেশ হিসাবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সম্মান জানাই আমরা।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ওই দেশটি সহযোগি দেশগুলোর অবস্থানের বিপরীতে ভারত, চীন ও রাশিয়ার অবস্থানকে অনেক বড় সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ।
প্রথম পাতা
ভয়ের রাজনীতি গণতন্ত্রকে জিম্মি করে রেখেছে
আওয়ামী লীগের পাতানো নির্বাচনে পা দিবে না সিপিবি
নির্বাচনের ডামাডোলে বৈদেশিক ঋণ ছাড়িয়েছে ১০ হাজার কোটি ডলার
আমানত সংকটে ব্যাংক খাত বাড়ছে সুদের হার
নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গণের জটিলতা আরও বাড়তে পারে
তফসিল বাতিল করে নির্দলীয় তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে
জামালপুরে গণমুক্তি ইউনিয়নের মিছিলে হামলার প্রতিবাদ
সিপিবি’র সদস্যপদ স্ক্রুটিনি ও নবায়ন সম্পর্কিত নির্দেশাবলি
‘বেচাকেনা’
ঢাকা ওয়াসার ৩৩২ কোটি টাকা আত্মসাতে ৪৬ কর্মকর্তা-কর্মচারী
Login to comment..