প্রমিথিউস অ্যানাক্সাগোরাস

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

একতা বিজ্ঞান ডেস্ক : মাঝে মাঝে দু-একজন মানুষ পৃথিবীতে জন্মান যারা গতানুগতিক কায়েমি গোষ্ঠীর সাথে নিজেদের না মিশিয়ে সত্যানুসন্ধানের চেষ্টায় সুস্পষ্ট বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও মননশীল মতবাদের জন্য স্বার্থান্বেষী কায়েমি গোষ্ঠীর রোষানলের শিকার হন। ঠিক যেন গ্রিক দেবতা টাইটানের ছেলে মানবদরদি প্রমিথিউসের মতো। অ্যানাক্সাগোরাস সেরকমই একজন। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৫০০ অব্দে অ্যানাক্সাগোরাস জন্মেছিলেন এশিয়া মাইনরের স্মার্ণার নিকটবর্তী ক্লাজমেনে নামক স্থানে। তার শৈশব বা কৈশোর সম্পর্কে কিছুই বিশেষ জানা যায় না। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬২ অব্দে গ্রিক দেশের শাসনকর্তা ছিলেন পেরিক্লিস এবং এই পেরিক্লিস ছিলেন প্রকৃতই জ্ঞানপিপাসু। তিনি অ্যানাক্সাগোরাসকে নিয়ে আসেন এথেন্সে। এই সময় এথেন্স নগরী ছিল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। নানা দেশের মনীষীরা বিভিন্ন সময়ে সেই নগরীতে এসেছেন শিক্ষার জন্য। এথেন্সে এসে অ্যানাক্সাগোরাস অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন (খ্রিষ্টপূর্ব (ঝ২-৮০৩) পেরিক্লিসের সহায়তায়। জ্যোতির্বিদ্যা এবং অঙ্ক শাস্ত্রে অ্যানাক্সাগোরাসের গভীর জ্ঞান ছিল এবং অধ্যাপনার সাথে সাথে তিনি গাণিতিক জ্যোতিষ সম্পর্কিত গবেষণাও শুরু করেন। জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত গবেষণায় অ্যানাক্সাগোরাস বেশ কয়েকটি মূল্যবান এবং বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছিলেন এবং এইসব সিদ্ধান্তগুলি তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন এথেন্সবাসীদের উত্তেজিত করার পক্ষে যথেষ্টই ছিল। তথাকথিত সনাতনী ধর্মজীবীরা সে সুযোগ নিয়েছিলেন। কী ছিল তার সেই সিদ্ধান্ত? চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কিত গবেষণায় অ্যানাক্সাগোরাসের সিদ্ধান্ত ছিল : চন্দ্র বা সূর্য কোনো স্বর্গীয় বস্তু নয়। চন্দ্রের নিজস্ব কোনো আলো নেই। কেন্দ্রীয় অগ্নির আলোকের প্রতিফলন মাত্র। পৃথিবী বা কখনও কখনও অন্যান্য বস্তু চন্দ্রের নিচে এসে আমাদের দৃষ্টিপথ অবরোধ করে এবং এ জন্মই চন্দ্রগ্রহণ হয়। তবে এইসব বস্তু অদৃশ্য। নক্ষত্রমন্ডলের নিচে এদের অবস্থিতি এবং সূর্য ও চন্দ্রের সাথে একই সঙ্গে এরা আবর্তিত হয়। এখানেই থেমে থাকলেন না তিনি। আরও নিরীক্ষণের পর তিনি বলেন, চন্দ্র সূর্যের পথ অনুসরণ করে এবং সূর্য ও চক্রের মধ্যে পৃথিবী এসে পড়ায় যে ছায়ার সৃষ্টি হয়, সেই ছায়ার মধ্যে পড়ে চন্দ্র প্রতিমাসে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়। শুধু চন্দ্র সম্পর্কিত সিদ্ধান্তই নয়, অ্যানাক্সাগোরাস ছায়াপথ এবং ব্রহ্মান্ড সম্পর্কেও কতকগুলি সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলেন। ছায়াপথ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, রাত্রিকালে সূর্য পৃথিবীর অপরদিকে আত্মগোপন করলে নক্ষত্রখচিত আকাশে পৃথিবীর যে ছায়া পরে তাই ছায়াপথ। পৃথিবী সম্পর্কে অ্যানাক্সাগোরাসের বক্তব্য ছিল এই পৃথিবী কোন স্বর্গীয় দেবতার সৃষ্টি নয়। আদি অবস্থায় পৃথিবী ছিল এক জড় পদার্থ এবং কালক্রমে এই জড়ের ভিতর এক অতি ক্ষুদ্র ঘূর্ণি বা আবর্তের সৃষ্টি হয়। এই ঘূর্ণি ক্রমশ স্ফীত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে এমন প্রবল হয়ে ওঠে যে ব্রহ্মান্ডের সমগ্র জড় পদার্থ দুটো বৃহৎ অংশে ভাগ হয়ে যায়। প্রথম অংশটা হলো উত্তপ্ত, হালকা শুষ্ক ‘ঈশ্বর’; দ্বিতীয়টা বিপরীত গুণসম্পন্ন ‘বাবু’। তার- পর বায়ু অধিকার করল ব্রহ্মান্ডের কেন্দ্রস্থল এবং বায়ুকে আচ্ছাদন করে রইল উষ্ণ উপর। সৃষ্টির পরের ধাপে বায়ু থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন পর্যায়ে উৎপন্ন হয়েছে মেঘ, জল, মৃত্তিকা ও প্রস্তর। এইসব নিয়েই পৃথিবী তৈরি হয়। শুরু থেকেই পৃথিবী ছিল দ্রুত আবর্তনশীল। এই ভীষণ আবর্তন বেগ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত ক্ষুদ্র বৃহৎ অসংখ্য পাথরের খণ্ড পৃথিবী থেকে ছিটকে পড়ল এবং জলন্ত ঈশ্বরের সংস্পর্শে এসে ভাস্বর নক্ষত্রে পরিণত হলো। অ্যানাক্সাগোরাসের এই গবেষণা ছিল মূলত অগ্নিকেন্দ্রিক অর্থাৎ মূল অগ্নি এবং তাকে কেন্দ্র করে সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্রাদি ঘোরে। আজ আমরা জানি অ্যানাক্সাগোরাসের এই তত্ত্ব অনেক অসম্পূর্ণ এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভুলও বটে, কিন্তু আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানই ছিল এক বৈপ্লবিক কাজ। কিন্তু এইসব সিদ্ধান্ত ও পরীক্ষালব্ধ মতামতগুলি এথেন্সের তথাকথিত গোড়া ধর্মীয় সম্প্রদায়কে তীব্রভাবে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, তিনি চন্দ্র-সূর্যের বা ব্রহ্মান্ডের ব্যাখ্যায় বলেছিলেন চন্দ্র বা সূর্য কোনো স্বর্গীয় বস্তু বা দেবতাদের সৃষ্ট কিছু নয়। অর্থাৎ ঈশ্বরকে অস্বীকার করে পৃথিবীর কথা ব্যাখ্যা করা, এই অভিযোগের ভিত্তিতে, ধর্মীয় সম্প্রদায় কুসংস্কারাছন্ন এথেন্সবাসীকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। ঐ ঈশ্বর-বিদ্বেষী ও বৈজ্ঞানিক মতবাদের জন্য অ্যানাক্সাগোরাসকে বলা হয়েছিল মানুষের শত্রু। বারবার অ্যানাক্সাগোরাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাকে বন্দি করা হয়েছিল। তারপর ধর্মীয় কর্তারা তার ওপর নির্যাতন শুরু করেছিলেন, তবুও অ্যানাক্সাগোরাসকে তার মতবাদ থেকে টলানো যায়নি। অবশেষে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, কিন্তু ঘটনাক্রমে ধর্মীয় কর্তারা অ্যানাক্সাগোরাসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারেননি। তাকে এথেন্স থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল নিষ্ঠুরভাবে। এই নির্যাতন সহ্য করা তার পক্ষে তখন আর সম্ভব ছিল না, বাধ্য হয়ে তাকে ফিরে যেতে হয়েছিল এশিয়া মাইনরে এবং সেখানে ল্যাম্বকাস নামে এক জায়গায় খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৮ অব্দে তার মৃত্যু হয়। প্রমিথিউস যদি পুরাণ কথার নায়ক হন তবে পৃথিবীর লিখিত ইতিহাসে বৈজ্ঞানিক মতবাদ পোষণ এবং প্রচারের অপরাধে নির্যাতিত অন্যতম প্রমিথিউসের পথগামী হলেন অ্যানাক্সাগোরাস।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..