কমরেড শেখ রওশন আলীর জীবন ও সংগ্রাম

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
একতা ফিচার : রাজনীতিতে সততা, দেশপ্রেম, নিঃস্বার্থ এবং ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত এক ব্যক্তিত্ব কমরেড শেখ রওশন আলী। যিনি সাধারণ একজন শ্রমিক থেকে জাতীয় নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। ১৭ সেপ্টেম্বর তাঁর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতেই এ লেখার চেষ্টা। কমরেড শেখ রওশন আলী ছিলেন সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের দীক্ষায় দীক্ষিত একজন বিপ্লবী। বহু শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও নেতা। কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটির এক সময়ের সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক মোহিনী মিলের নেতা ছিলেন শেখ রওশন আলী। ১৯০৫ সালের ১৮ জুলাই, কুষ্টিয়া শহরের আড়ুয়াপাড়ায় শেখ রওশন আলীর জন্ম। বাবা শেখ এলাহী বক্স এবং মাতা মতিজান নেছা। বাবা ছিলেন দরিদ্র এবং সাধারণ কসাই। ছোটবেলা থেকেই অভাব অনটনের ভেতর দিয়ে তিনি মানুষ হন। ৫ বছর বয়সে স্থানীয় খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। দ্বিতীয় শ্রেণি শেষ করার আগেই অর্থাভাবে স্কুল ত্যাগ করেন। পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে ১০/১১ বছর বয়সে একটি রুটির দোকানে কাজ শুরু করেন। বাবা এলাহী বক্স কসাইয়ের পেশার মাধ্যমে অর্জিত অর্থে সংসার চালাতে ব্যর্থ হয়ে পেশা পরিবর্তন করে ঘোড়ার গাড়ি চালানো শুরু করেন। অন্যদিকে শেখ রওশন আলী রুটির দোকানে কাজের পাশাপাশি রাতের বেলায় বাড়িতে পড়াশোনা অব্যাহত রাখেন। অবসর সময় পাড়ার ছেলেদের নিয়ে হাডুডু খেলতেন, তিনি ছিলেন ওই হাডুডু খেলার দলের দলপতি। পরে তাঁর ওই খেলার সাথীদের নিয়ে সার্কাসের দল গঠন করেন। ১৯৩২ সালে ২৭ বছর বয়সে কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের শ্রমিক হিসেবে যোগদানের পর ১৯৩৪ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিন ছেলে ও এক মেয়ে জন্ম নেওয়ার পর ১৯৪২ সালে তার স্ত্রী মারা যান। স্ত্রীর মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন কারাগারে। ১৯৪৩ সালে তার ১ ছেলে এবং ১৩ দিন পর তার বাবা শেখ এলাহী বক্স মারা যান। সামান্য দিনের ব্যবধাদনে ছেলে ও বাবার মৃত্যু হলেও তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েননি। চাকরির শুরুতেই শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৩৭ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। এর আগে ১৯৪৩ সালে তার প্রচেষ্টায় মোহিনী মিল মজদুর ইউনিয়ন গঠিত হয়। শ্রমিকদের নির্যাতন থেকে মুক্তি এবং কাজের নিশ্চয়তার জন্য এই সংগঠনটি গড়ে তোলা হয়েছিল। ১৯৩৬ সালে মালিক পক্ষ শেখ রওশন আলীর বিরুদ্ধে মামলা করলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে আসে। শ্রমিকদের প্রতিরোধে পুলিশ ফিরে যেতে বাধ্য হয়। মোহিনী মিলে একটানা ২ মাস ১০ দিন ধর্মঘট চলার পর মালিক শ্রমিকদের দাবি দাওয়া মেনে নেয়। ১৯৩৭ সালের এই আন্দোলনের পর কমরেড রওশন আলী শ্রমিকদের কাছে কিংবদন্তি নায়কে পরিণত হন। ১৯৩৮ সালে অপর এক আন্দোলনের অজুহাত তুলে তাকেসহ ৮ শত শ্রমিককে মিল থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়। আন্দোলনকে সচল রাখতে তিনি মিল এলাকায় তাঁর ছোট ভাইয়ের সাথে পান-বিড়ির দোকান দেন এবং আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। পরে সফল হোন এবং চাকরিচ্যুত সকল শ্রমিকসহ চাকরিতে পুনর্বহাল হন। এরপর মোহিনী মিল শ্রমিক ইউনিটি ছাড়াও পার্টির বিভিন্ন গণসংগঠনে কাজ শুরু করেন। ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটি গঠিত হয়, তিনি হোন ওই কমিটির সদস্য। পার্টি কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু হলে ১৯৪৮ সালেই তিনি আত্মগোপনে থেকে পার্টির কাজ চালাতে থাকেন। ১৯৪৯ সালে পার্টির প্রাদেশিক কমিটিতে তিনি সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ঐ বছরই আত্মগোপন অবস্থায় চুয়াডাঙ্গা থেকে গ্রেফতার হন। সাত বছর জেল খাটার পর মুক্তি পান। মুক্তির ১ বছর পর ১৯৫৭ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। মুক্তি পাওয়ার পর পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় তিনি ন্যাপের সাথে থেকে কাজ শুরু করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তিনি ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা বাহিনীর তত্ত্বাধায়কের কাজ করেন। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর বাহিনী পাক সেনাদের অবস্থান কুষ্টিয়া থানা ও টেলিফোন ভবনে আক্রমণ চালায়। এপ্রিল মাসে সীমান্ত অতিক্রম করে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন। আনন্দ পল্লীতে বামপন্থীদের অপর একটি রিক্রুটমেন্ট কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করেন ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা কমিটির সভাপতি জাহেদ রুমী। রওশন আলী ওই ক্যাম্পেরও খোঁজ-খবর রাখতেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নিকট সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সামরিক সরকার জিয়ার আমলে শেখ রওশন আলী গ্রেফতার হন। জীবনের শেষ লগ্নে তিনি জটিল চর্মরোগে আক্রান্ত হন। এ সময় শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও মানসিকভাবে তিনি ভেঙে পড়েননি। দেশ-বিদেশে চিকিৎসা নিলেও তিনি রোগমুক্ত হননি। তিনি ১৯৮৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের ট্রেড ইউনিয়নের আমন্ত্রণে তিনি বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। আজকের ভারতের স্বনামধন্য নেতা জ্যোতি বসু, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবসহ অনেক নেতার সংস্পর্শ পেয়েছেন। কুষ্টিয়া অঞ্চলের মানুষের নিকট শেখ রওশন একজন আদর্শ মানুষ ও রাজনীতিক। ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করেছিল, যা কমরেড রওশন আলীকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সহায়তা করবে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..