কমরেড শামছুজ্জামান সেলিমের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৭ অক্টোবর, পাবনার ঈশ্বরদীর সাধুপাড়ায়। আমি তাঁকে যখন প্রথম দেখি, আমার কাছে তাঁকে সাধুর মতোই এক নিবিষ্ট এবং নিবেদিত মানুষ মনে হয়েছিলো। সে সময় তাঁর সেই ধীর অথচ দৃঢ় ব্যক্তিত্ব আমার মতো ২০ বছর বয়সী তরুণকে মুহূর্তের জন্য থামিয়ে দিয়েছিলো। আমি তাঁকে খুঁজে পেয়েছিলাম সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়কালীন সময়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ভেঙে পড়া সাংগঠনিক কাঠামোতে প্রাণ সঞ্চারের চ্যালেঞ্জিং কাজে। আমার মতো সে সময়কার অনেক তরুণ নিজের চোখে দেখেছে, কী অসাধারণ প্রাণশক্তি নিয়ে কমরেড শামছুজ্জামান সেলিম পার্টির কেন্দ্রীয় সংগঠন বিভাগের মূল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সে অভিজ্ঞতা থেকে তিনি পার্টি সংগঠন বিষয়ক একটি দরকারি পুস্তিকাও রচনা করেছিলেন। আসলেই তিনি ছিলেন মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শে চরম আসক্ত এক সাধু প্রকৃতির মানব। অধ্যয়নে, মননে এবং জীবনাচরণেও তিনি ছিলেন সাধু প্রকৃতির। তবে তিনি প্রাচীনপন্থি কিংবা গোঁড়া ছিলেন না। ছিলেন আধুনিক। তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল খুবই উন্নততর। তিনি অপরের করুণা ভিক্ষাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা প্রকাশ করতে খুবই কুণ্ঠা বোধ করতেন। আমরা যারা তাঁকে কাছে থেকে দেখেছি, তাঁর এসব বৈশিষ্ট্য, সাদাসিধে, ত্যাগী জীবনধারা সহজেই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। যদিও এসব গুণের বড়াই তিনি কখনোই করতেন না। তিনি ঘৃণা করতেন প্রদর্শনবাদী এবং আত্মপ্রচারমগ্ন নেতাদের। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে সম্মুখসারির গেরিলা ছিলেন। ১৯৭১ এর এপ্রিলেই অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাবনার রণাঙ্গনে। কিন্তু কখনোই যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের বাহাদুরির গল্প করতে শুনিনি। তবে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনামের গেরিলা কৌশল, কিংবদন্তির গেরিলা জেনারেল গিয়াপের সমর কৌশল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট ইউনিয়ন, ভারতের সহযোগিতার নানা অজানা ঘটনা, পাবনার রণাঙ্গনে তৎকালীন মাওবাদীরা কিভাবে পাক হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে প্রকাশ্যে কাজ করেছে। সেসব ইতিহাস কাজের অবসরে সুযোগ পেলেই তিনি তরুণ কমরেডদের সামনে তুলে ধরতেন। একদিকে তিনি যেমন সুন্দর কথা বলতে পারতেন। ছিলেন মনোযোগী শ্রোতাও। নতুন বিষয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির চলতি ঘটনাবলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। ইন্টারনেট ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে ছিলো তাঁর বিরাট আগ্রহ। যে কারণে পরিণত বয়সে পার্টির কাজের সুবিধার্থে একান্তই নিজের প্রচেষ্টায় শিখে নিয়েছিলেন কম্পিউটার চালনা এবং তথ্যপ্রযুক্তি। নিঃসন্তান এই বিপ্লবীর সাধনসঙ্গী ছিলেন তাঁর প্রিয়াতমা স্ত্রী, আমাদের সুলতানা ভাবি। যিনি কমরেড সেলিমের মৃত্যুর কয়েক বছর আগেই প্রয়াত হয়েছিলেন। জীবন সায়াহ্নে তাঁর পরম ভালোবাসার এই মানুষটির মৃত্যু তাঁকে বেশ দূর্বল করে দিয়েছিলো। আজ পার্টি যখন নানা দিক থেকে আক্রান্ত, তখন বিলোপবাদ বিরোধী লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান কমান্ডার শামছুজ্জামান সেলিম এই পার্টিকে রক্ষা করতে আবারো দুর্বলতা কাটিয়ে নবউদ্যমে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। আগুনের ভেতর থেকে ফিনিক্স পাখির মতো। কিন্তু মৃত্যু তাঁকে কাজ করার সুযোগ দিলো না। সিপিবি এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন হারালো অসামান্য এক মার্ক্সবাদী বিপ্লবীকে।
কমরেড শামছুজ্জামান সেলিম ছিলেন এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিশেষ করে, সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ব্লকের দুঃখজনক বিপর্যয়ের পর কমরেড শামছুজ্জামান সেলিম এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে নক্ষত্র হিসেবে আরো দীপ্তিময় হয়ে ওঠেন। গত ১৭ আগস্ট ২০২৩ রাতে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। সিপিবির জন্য তাঁর এই অকস্মাৎ চলে যাওয়া ছিল খুবই বেদনার, শোক এবং পরিতাপের। কারণ, তিনি ছিলেন পার্টির এমন একটি প্রজন্মের নেতা যারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়কে সমাজতন্ত্রের চিরবিদায় হিসেবে যুক্তিসংগত কারণেই মেনে নেয়নি। তিনি ছিলেন এমন একজন মার্ক্সবাদী যিনি মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষাকে দেশীয় বাস্তবতার আলোকে সৃজনশীলভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম ছিলেন। এদেশের জন্য উপযুক্ত মার্ক্সীয় তত্ত্ব বিনির্মাণে সক্ষম ছিলেন। এই সৃজনশীলতার আলোচনা এবং প্রয়োগে তিনি একেবারেই দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন না। বরং ছিলেন অনেকে বেশি সাহসী এবং আমি মনে করি কোন কোন ক্ষেত্রে অনেক দুঃসাহসী। অবশ্য এরজন্য কমরেড শামছুজ্জামান সেলিমকে অনেক মূল্যও দিতে হয়েছে। পার্টি জীবনে এবং ব্যক্তি জীবনে। সেসব কাহিনি তাঁর নিজের মুখ থেকে শোনার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। আমি অবাক হয়ে সেসব জীবন থেকে নেয়া গল্প শুনতাম। শুনতাম বিপ্লবী অমূল্য লাহীড়ির কথা, জীবনের রেলগাড়ি খ্যাত কমরেড জসিম মন্ডল আর খাপড়া ওয়ার্ডের গুলিবিদ্ধ বিপ্লবী কমরেড প্রসাদ রায়ের কথা। কমরেড শামছুজ্জামান সেলিমের কাছ থেকে সেসব শ্রদ্ধাভাজন বিপ্লবীদের জীবন ও সংগ্রামের কথা শুনে তার সাথে আমাদের আজকের বাম রাজনীতির নেতাদের জীবন ধারার তুলমূলক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করতাম। এই বিশ্লেষণের ভেতরে জন্ম নেয়া নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতাম। কোন সময় উত্তর পেতাম। আবার কোন সময় পেতাম না। আমার না পাওয়া উত্তরসমূহের অন্যতম এক সমৃদ্ধ ভান্ডার ছিলেন কমরেড শামছুজ্জামান সেলিম। পার্টিতে পেশাদার বিপ্লবী অথবা সার্বক্ষণিক কর্মীর মডেল কি হবে? পার্টি তহবিলের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা, পার্টির হয়ে বিদেশ সফর, পার্টির ভেতরকার গণতন্ত্র, নেতাদের জবাবদিহি, নারী কমরেডগণের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি, স্থানীয় এবং জাতীয় নির্বাচনে পার্টির অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে তিনি গভীরভাবে পড়াশোনা করতেন, বিভিন্ন দেশের পার্টির অভিজ্ঞতাসমূহ জানা এবং বুঝার চেষ্টা করতেন। সমাজতান্ত্রিক বুলগেরিয়ার সমাজবিজ্ঞান একাডেমিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ তাঁকে এক্ষেত্রে শাণিত করেছে। ফলে এসব ব্যাপারে তাঁর সময়োপযোগী ভাবনাও ছিলো। তিনি এসব নিয়ে নির্মোহ খোলামেলা মতামত দিতেন। যার ফলে পার্টিতে অনেকের সাথে তাঁর বিস্তর মতান্তরও হয়েছে। সে সব হয়তো অন্য পরিসরে লেখা যাবে। তিনি বরাবরই পার্টির শ্রেণিভিত্তির তথা প্রলেতারীয় শ্রেণিচরিত্রের আধিপত্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতেন। আবার একইসঙ্গে পার্টির ভেতরে সুবিধাবাদ, অতিবিপ্লবী বাগাড়ম্বরের বিরুদ্ধে আন্তঃপার্টি সংগ্রামের ওপরও বেশ জোর দিতেন। তাঁর সেই সংগ্রাম ছিলো খুবই উন্নত সাংস্কৃতিক মানের। তিনি লেখার জবাব লেখা দিয়ে, তত্ত্বের জবাব তত্ত্ব দিয়ে এবং ইতিহাসের জবাব ইতিহাস দিয়েই দিতেন। ফলে জ্ঞান-বুদ্ধিতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে কেউ কেউ তাঁকে ব্যাক্তিগত আক্রমন করেছে। অসাধারণ কমিউনিস্ট গুণাবলি এবং নেতৃত্বের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যে বয়সে তাঁর শারীরিক সক্ষমতা ছিলো, সে বয়সে তাঁকে পার্টিতে প্রাপ্য দায়িত্ব ও মর্যাদা দেয়া হয়নি। বরং তাঁকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার সংঘবদ্ধ চক্রান্ত হয়েছে। যে বিলোপবাদের বিরুদ্ধে তিনি সর্বস্ব দিয়ে লড়াই করলেন। সেই তাঁকেই পার্টির একটি মহল বিলোপবাদের এজেন্ট বলে গালি দিলো। অথচ, সেই মহলের পক্ষ থেকেই তাঁর মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে প্রকৃত কমিউনিস্ট বলে প্রশংসিত করা হলো! যেহেতু তিনি শেষ জীবনে শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ ছিলেন। তাই আমি প্রায়ই সুযোগ পেলে তাঁকে তাঁর রায়েরবাজারের বাসার রাস্তার মুখ অবধি পৌঁছে দিতাম। চলতি পথে মোবাইলে প্রণব রায়ের লেখা এই আধুনিক বাংলা গানটি প্রায়ই তাঁকে শোনাতাম। ‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল? মুখপানে যার কভু চাওনি ফিরে, কেন তারি লাগি আঁখি অশ্রু আকুল।’ আসলেই এমনটাই ঘটেছে বিপ্লবী নেতা শামছুজ্জামান সেলিমের বেলায়। এ গান শুনে তিনি আমাকে মৃদু তিরস্কার করে বলতেন, এসব মধ্যবিত্তসূলভ আবেগ থেকে বেরিয়ে আসো। শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামকে তীব্রভাবে আঁকড়ে ধরো।
কমরেড শামছুজ্জামান সেলিম ইতিহাসকে খুবই সচেতনভাবে ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করতেন। রুশ বিপ্লবের ইতিহাসের মূল সড়ক থেকে শুরু করে এর নানা অলিগলির তথ্য ছিলো তাঁর নখদর্পণে। প্রাকৃতিক ভূগোল থেকে শুরু করে রাজনীতির ভূগোল উভয় বিষয়ের প্রতি ছিল তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ। ফলে চলতি দুনিয়ার খবরও রাখতেন বেশ। শহুরে সুবিধাপ্রাপ্ত পরিবেশে তিনি বেড়ে ওঠেন নি বটে। তা সত্ত্বেও আধুনিক জীবনধারা ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গ্রহনের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বেশ সপ্রতিভ একজন মানুষ। তিনি যেমন ছিলেন সপ্রতিভ। আবার তেমনি ছিলেন বিপ্লবী সাহসিকতায় ভরপুর। চামচাগিরি তাঁর স্বভাবের মধ্যে ছিলোনা। কেউ তাঁর চমচাগিরি করুক সেটিও খুব অপছন্দ করতেন। তিনি তাঁর এই বিপ্লবী সাহসিকতার জোরে মাত্র ১৮ বছর বয়সে তৎকালীন নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন। যুক্ত হবার পরের বছরই পার্টির নির্দেশে পাকশী পেপার মিলে শ্রমিকের চাকরি নেন। অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার জোরে পরবর্তীকালে সে পেপার মিল সিবিএর সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার সামরিক প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তাঁকে টানা দুই বছর জেলখানায় আটকে রাখে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ৮০’র দশকের শেষে পার্টির পাবনা জেলার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কিন্তু ৯০ এর দশকে সোভিয়েত ভাঙনের পর তিনি পার্টি রক্ষার জন্য বিলোপবাদের বিরুদ্ধে অসমসাহসিকতার সাথে সংগ্রামে লিপ্ত হন। পার্টি রক্ষার সে সংগ্রাম জয়যুক্ত হয়। সেই ইতিহাসে অন্যান্য কমরেডগনের সাথে কমরেড শামছুজ্জামান সেলিমের অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি স্বভাবজাত মতাদর্শিক দৃঢ়তা এবং সাহসের জোরে ৯০ এর সেই কঠিন সময়ে গ্রামীণ মজুরদের সংগঠন বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দুদফায় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে নিয়মিত লিখেছেন দেশের খ্যাতনামা প্রগতিশীল পত্রিকা ‘দৈনিক সংবাদ’-এ। তাঁর সেসব লেখা ‘উৎসের সন্ধানে’ নামে একটি সুলিখিত গ্রন্থ আকারে প্রকাশিতও হয়েছে। তিনি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। সকল আক্রমণের ঊর্ধ্বে তিনি চলে গিয়েছেন। মুক্তি ভবনের কোণার টেবিলের পুরনো কাঠের চেয়ারে শুভ্র কেশের, বিশাল হৃদয় আর অগ্নিগর্ভ চোখের এই প্রাণোচ্ছল মানুষটিকে আর হয়তো আমরা দেখতে পাবো না। তাঁর মতো অনুকরণীয় সৎ এবং ত্যাগী রাজনীতিবিদও হয়তো খুব বেশি আমরা পাবো না। কিন্তু তাঁর লড়াই এবং জীবনধারার মধ্যে তিনি যে শিক্ষা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন। সেটি যদি কেউ কাজে লাগাতে পারে, তাহলে তা হবে সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য এক বিরাট সার্থকতা। কমরেড শামছুজ্জামান সেলিমের অসামান্য বিপ্লবী জীবনের তরে এই আমার বিন¤্র প্রণতি।
লেখক : সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান