চিলি : নয়া উদারবাদের পরীক্ষাগার

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
[২০০৮ সালে যে বিশ্বায়িত আর্থিক সংকট গ্রাস করেছিল তামাম বিশ্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে, আজ তার প্রায় দেড় দশক পরেও, বিশ্বায়িত পুঁজিবাদী অর্থনীতি সেই সংকট থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। এমনকি, সুড়ঙ্গের শেষে দেখা যাচ্ছে না তেমন কোনো আলোর রেখাও। বরং, সম্প্রতি দুনিয়া দেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক এবং সিগনেচার ব্যাংকের পতন। ক্রেডিট সুইসের মত বহুল পরিচিত ব্যাংকেরও শেয়ারের দামে ধস। শুধু তাই নয়, দেখছে তাদেরই ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ ইউনিয়ন ব্যাংক অফ সুইৎজারল্যান্ডের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া। নয়া উদারবাদের জন্ম চিলিতে, হবে মৃত্যুও।] পঞ্চাশ বছর আগে সেদিন সান্তিয়াগোতে ঘটেছিল আরেক ৯/১১। সেদিন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বলি হয়েছিলেন চিলির সোস্যালিস্ট রাষ্ট্রপতি সালভাদোর আলেন্দে। ওয়াশিংটনে যমজ বহুতলে আগ্রাসী বিমান হানার মতোই সেদিন সান্তিয়াগোর রাষ্ট্রপতি ভবনের দিকে তাক করেছিল মার্কিন বোমারু বিমান। ছুড়েছিল মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা। রাষ্ট্রপতি ভবনে আলেন্দে তখন একা। একদমই একা। তবু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক ইঞ্চিও পিছু হটেননি। বেরিয়ে এসেছিলেন প্রিয় বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রোর দেওয়া অ্যাসল্ট রাইফেল একে-৪৭ নিয়ে। জীবন দিয়েছিলেন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আলেন্দে সরকারকে হটিয়ে যেদিন জেনারেল অগাস্তো পিনোচেত জমানার শুরু, প্রবল রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে সেদিনই জন্ম নিয়েছিল এই বিশ্বের প্রথম নিও লিবারেল সরকার। পরের দেড় দশক। পিনোচেতের বর্বর শাসন। পিনোচেতের সামরিক জমানায় চিলি সেদিন আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিল উদারনীতির পরীক্ষাগার। মার্কিন অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রিডম্যান ও শিকাগো স্কুল অব ইকনমিক্স-এ তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা মিলে গড়েছিলেন এই গ্রহের ‘নিও লিবারেল রাষ্ট্রের’ প্রথম প্রতিমা। বিপরীতে এই দেড় দশক চিলি দেখেছিল ‘মানব সুনামি’। রাষ্ট্রের বিনির্মাণ, ভাঙন। অন্তত মানুষের পক্ষে যতটা সম্ভব। দেখেছিল জনকল্যাণ ও সামাজিক কর্মসূচির বেপরোয়া বেসরকারিকরণ। বাজারের বিনিয়ন্ত্রণ। বাণিজ্যের উদারিকরণ-সহ ট্রেড ইউনিয়নের নিকেষযজ্ঞ। আমলাতন্ত্রের অসাড় হাত, কর-জমানাসহ ইউনিয়নের জঙ্গিপনা-মুক্তবাজার অর্থনীতি ছুটেছিল মারাত্মক গতিতে। তবে তা বিকাশের রাস্তায় নয়, দেউলিয়ার পথে। মুক্তবাজার নীতিতে চিলি দেখেছিল বীভৎস মন্দা। একবার নয়। একদশকে দু’বার। প্রথমে ১৯৭৪-৭৫ সালে। দ্বিতীয়বার ১৯৮২-৮৩ সালে। শুধু কী তাই? ১৯৭৪-৮৯, ফ্রিডম্যান-পিনোচেত জমানায় গড়পড়তা বিকাশের হার ছিল মাত্র ২.৬ শতাংশ। যেখানে ১৯৫১-৭১, চিলির বার্ষিক বিকাশের হার ছিল ৪ শতাংশ। ফ্রিডম্যান-পিনোচেত জমানা শুধু দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেনি, ছাঁটাই করেছিল শ্রমিকের দর-কষাকষির অধিকার। অবসান ঘটিয়েছিল শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরির। পাশাপাশি সরকারি পেনশন ব্যবস্থাকে করেছিল বেসরকারিকরণ। বেমালুম তুলে দিয়েছিল সম্পত্তি ও ব্যবসার মুনাফা-সংক্রান্ত যাবতীয় কর। দেশের ২১২টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে তুলে দিয়েছিল বেসরকারি হাতে। বন্ধ করেছিল সরকারি চাকরিতে নিয়োগ। খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ লাতিন আমেরিকার দেশটিতে শুধুমাত্র তামা রপ্তানি থেকে আয় হতো ৩০-৭০ শতাংশ। ক্ষমতা দখলের পর পিনোচেত দেশের ৯০ শতাংশ খনি তুলে দেন অ্যানাকোন্ডা ও কেনকেট নামে দ্’ুটি দাপুটে মার্কিন সংস্থার হাতে। ফ্রিডম্যানের ভাষায়, যা ছিল ‘চিলির বিস্ময়!’ ১৯৭৩ সালের চিলির বেকারের হার ছিল ৪.৩ শতাংশ। মুক্তবাজার অর্থনীতির দশবছর পর, ১৯৮৩-তে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২২ শতাংশ। প্রকৃত মজুরি কমে ৪০ শতাংশ। ১৯৭০-এ চিলিতে দরিদ্র মানুষের হার ছিল ২০ শতাংশ। ১৯৯০, যেবছর ‘রাষ্ট্রপতি’ পিনোচেতের বিদায়, সেবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় দ্বিগুণ, ৪০ শতাংশ। দেশের ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৫২ লক্ষই তখন দরিদ্র। শিরোধার্য মুক্তবাজার অর্থনীতি! ‘বিস্ময়করই বটে! তবু মিলটন ফ্রিডম্যান নোবেল পান। ১৯৭৬ সালে। অর্থনীতিতে ‘বিশেষ অবদানের’ জন্য! স্বাভাবিক। কারণ তিনি রেগান-থ্যাচারের পছন্দের অর্থনীতিবিদ। দ্য ইকনমিস্ট পত্রিকার মতে, ‘বিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধের সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ’। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ভাষায়, মুক্তবাজার অর্থনীতির ‘গ্র্যান্ড মাস্টার’। এ-ও স্বাভাবিক। কারণ, নিজের বই ‘পুঁজিবাদ ও স্বাধীনতা’তে ফ্রিডম্যান ‘স্বাধীনতা’র নামে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে ন্যূনতম করার পক্ষে সওয়াল করেন। চিলি ছাড়িয়ে উদারনীতি তামাম দুনিয়ায়। রেগান-থ্যাচাররা সেদিন বলেছিলেন, বাজারের হাতে সব ছেড়ে দাও। বাজারকে নিজের মতো চলতে দাও। নিজের যত্ন নিজেকে নিতে দাও। বাজারকে দাও স্বাধীনতা। ব্যবসা-বাণিজ্যকে নিজেদেরটা নিজেদের বুঝে নিতে দাও। উদারীকরণ করো। বাজারকে খুলে দাও। উন্মুক্ত করো। দেখবে মুদ্রাস্ফীতি বাগে আসবে। নেমে আসবে তলানিতে। সরকারের ভূমিকাকে যতটা সম্ভব কাঁট-ছাট করো। ন্যূনতম ভূমিকা থাকুক সরকারের। দেখবে বিকাশ লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়ছে। ঢালাও বেসরকারিকরণ করো। দেখবে অপচয় কমছে। সরকারের লাভই কমছে। কমছে দারিদ্র। কমছে বেকারি। সমৃদ্ধি আসছে অর্থনীতিতে। সেই লক্ষ্যেই ওয়াশিংটন সহমত। দশদফা প্যাকেজ। ২০০৮ সালে যে বিশ্বায়িত আর্থিক সংকট গ্রাস করেছিল তামাম বিশ্বের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে, আজ তার প্রায় দেড় দশক পরেও, বিশ্বায়িত পুঁজিবাদী অর্থনীতি সেই সংকট থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। এমনকী, সুড়ঙ্গের শেষে দেখা যাচ্ছে না তেমন কোনও আলোর রেখাও। বরং, সম্প্রতি দুনিয়া দেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক এবং সিগনেচার ব্যাঙ্কের পতন। ক্রেডিট সুইসের মত বহুল পরিচিত ব্যাঙ্কেরও শেয়ারের দামে ধ্বস। শুধু তাই নয়, তাদেরই ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ সুইৎজারল্যান্ডের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া। অক্সফামের প্রতিবেদনে আর্তনাদ: ধনীশ্রেষ্ঠ ১ শতাংশের সম্পদের পরিমাণ বাকি ৯৯ শতাংশের চেয়ে বেশি। আজকের পুঁজিবাদকে জোশেফ স্টিগলিৎজ বর্ণনা করেছেন, ‘অব দি ওয়ান পার্সেন্ট, বাই দি ওয়ান পার্সেন্ট, ফর দি ওয়ান পার্সেন্ট’, এক শতাংশের, এক শতাংশের দ্বারা, এক শতাংশের জন্য। ১ শতাংশ বনাম ৯৯ শতাংশের কথা বলেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। (ভ্যানিটি ফেয়ার, ৩১ মার্চ, ২০১১)। সেভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা ঘোষণা করেন, মার্কসবাদ মৃত। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ঘোষণা করেছিলেন, ‘ইতিহাসের অবসান।’ জিতেছে পশ্চিমের পুঁজিবাদ। ধনতন্ত্রই ‘সার-সত্য’, এর কোনও বিকল্প নেই। সমাজতন্ত্রের অবসান মানে দ্বন্দ্বের অবসান। সংকটের স্থায়ী অবসান। আরও সুনির্দিষ্ট করে পরে টমাস ফ্রিডম্যান ঘোষণা করেছিলেন, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফ্ল্যাট’। বিশ্ব সমতল। ঠান্ডা যুদ্ধের বিজয়ী হিসেবে এই বিশ্বে উঠে এসেছে মুক্তবাজার। এবং যেখানে ভবিষ্যৎ মানে- অর্থনীতিতে ন্যূনতম সরকারি হস্তক্ষেপ। জয়ী হবে সেই সমতল অর্থনীতি, যারা বাজারের সঙ্গে নিজেদের পুরোপুরি জুড়তে পারবে। আর হারবে তারা, যারা নিজেদের এই মুক্তবাজারের থেকে বাইরে রাখবে। পুঁজিবাদের উত্থান ও বার্লিনের পতন প্রমান করেছে মার্কস ভুল। নিও-লিবারেল মিডিয়া শুনিয়েছিল, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ইতিহাসের ‘একটি দুর্ঘটনা।’ পুঁজিবাদেরই একটি ‘অস্থায়ী উত্তরণ পর্ব’ মাত্র। ঘোষণা করা হয়েছিল ‘সমাজতন্ত্র হচ্ছে পুঁজিবাদ থেকে পুঁজিবাদে রূপান্তরের দীর্ঘতম উত্তরণ পর্ব।’ নিও-লিবারেল অর্থনীতিবিদরা আমাদের শুনিয়েছিলেন, ‘বাজার’, ‘ব্যক্তি মালিকানা’ ঈশ্বরের মতো পবিত্র। কোনও অর্থনীতি ও সমাজকে সীমাহীন বিকাশের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য এদের হাতে রয়েছে সর্বময় ক্ষমতা। বলা হয়েছিল, ‘নো লাঞ্চ ইজ ফ্রি।’ অর্থনীতি কখনোই বিনামূল্যে বা ভরতুকি দিয়ে চালানো উচিত নয়। ছাব্বিশ-বছর পর, উদার অর্থনীতির এই বন্ধ্যা ও ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে সেই ফুকুয়ামাই বললেন, ‘এই সন্ধিক্ষণে কার্ল মার্কসের কথাগুলো কিছু বিষয়কে সত্য বলে আমার মনে হচ্ছে। মার্কস অতি উৎপাদনের সংকটের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন শ্রমিকরা হবেন আরও গরিব, যেখানে থাকবে পর্যাপ্ত চাহিদার অভাব।’ (সমাজতন্ত্রের ফিরে আসা উচিত, নিউ স্টেটসম্যান, ১৭ অক্টোবর, ২০১৮) সমস্ত উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে উচ্চ হারের অসাম্য নিয়ে নানা ক্ষেত্রের অর্থনীতিবিদরা এখন উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি আয় ও সম্পদের অসাম্য গত সত্তর বছরে পৌঁছছে সর্বোচ্চ স্তরে। আয়ের অসাম্যের নিরিখে, ফরারি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেত্তি বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অসাম্যের হার ‘সম্ভবত, বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে অতীতের যে কোনো সময়ে যে কোনো সমাজের চেয়ে বেশি’। [মার্কসবাদী পথ- থেকে পুনর্মুদ্রিত ও ঈষৎ সম্পাদিত]

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..