বাড়ছে কোটিপতি, বাড়ছে অর্ধাহারি দরিদ্রের সংখ্যা

রুহুল আমিন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
এই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডেঙ্গু মহামারি, বাজার সিন্ডিকেটসহ নানামুখী সংকটে বিপর্যস্ত জনজীবন। লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, ডলারসংকট, ক্রমহ্রাসমান রিজার্ভ, রেমিট্যান্সে ভাটাসহ সামষ্টিক অর্থনীতির নানামুখী সংকটের মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় (বণিক বার্তা) বাংলাদেশে দ্রুত সুপাররিচ (বা অতিধনী) হওয়া ধনীদের মালিকানাধীন নীট সম্পদের পরিমাণ প্রকাশ করেছে সুইজারল্যান্ডের ইউবিএস (টইঝ) ব্যাংক। বিশ্বের সম্পদশালীদের ডাটাবেজ প্রকাশ করেছে জুরিখভিত্তিক ইউবিএস ব্যাংক। ডাটাবেজটির সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২৩ সালের সংস্করণে দেখা যায়, ২০২২ সাল শেষে ৫০ কোটি ডলার বা সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার (প্রতি ডলার ১১০ টাকা ধরে) বেশি পরিমাণের সম্পদ আছে বাংলাদেশের ২২ ব্যক্তির কাছে। যেখানে ২০২১ সাল শেষে এ ক্যাটাগরির সম্পদশালীর সংখ্যা ছিল ২১ জন। অর্থাৎ একজন নতুন এই সর্বোচ্চ ধনীদের গ্রুপে এসেছেন। সব মিলিয়ে দেশে ১১০ কোটি থেকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা ২০২২ সাল শেষে ৫২৯ জনে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫০৩ জন। দেখা যাচ্ছে এক বছরে বাংলাদেশে শতকোটি টাকার বেশি সম্পদ যুক্ত করেছেন আরও ২৬ জন। সুইজারল্যান্ডের ওই ইউবিএস ব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশি টাকায় ১০০ কোটির কাছাকাছি বা এর ওপরে সম্পদশালী ব্যক্তির সংখ্যা বাংলাদেশে প্রায় এক হাজার ৭০০, যাদের মোট সম্পদের পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকার বেশি। যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ। অন্যদিকে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যের দাম জ্যামিতিক হারে বাড়লেও মানুষের আয় বাড়ছে না। এমন অবস্থায়ও এক শ্রেণির মানুষের ধনসম্পদ আরো ফুলে-ফেঁপে উঠছে। গত এক-দেড় বছরের হিসেব অনুযায়ী, দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুসারে আমদানি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এতে আমদানির পরিমাণ কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ফলে উৎপাদনমুখী শিল্পের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে রিজার্ভ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে দেশের রিজার্ভ এখন ২ হাজার ১৭০ কোটি ডলার। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত রফতানি খাতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়নি, রেমিট্যান্স পরিস্থিতিও আশাব্যঞ্জক নয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুইমাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমেছে। ঋণখেলাপিতে জেরবার দেশের ব্যাংকগুলো। গত বছর শেষে দেশের ব্যাংকখাতে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ১২ হাজার ৭৮০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। তবে এতসব হিসাবনিকাশে দেশের বিলিয়নেয়ারদের কিছু যায় আসে না। এসব তথ্য দেখলে পাকিস্তান আমলের সেই বিখ্যাত ২২ পরিবারের কথা মনে পড়ে যায়। যার মধ্যে ছিলো সামরিক ব্যক্তিবর্গ, রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা ও শিল্পপতি। এই গোষ্ঠী পাকিস্তানের শতকরা ৮০ ভাগ ব্যাংকিং সম্পদ, ৭৫ ভাগ বীমা সম্পদ ও ৬০ ভাগ শিল্প সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করত। তারা বিবাহসুত্রে সম্বন্ধযুক্ত ছিল এবং তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার জন্য একত্রিত ছিলো। অন্যায়, অবিচার, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও পরিবারতন্ত্র থেকে মুক্তি পেতেই প্রাণ দিয়েছিল এদেশের প্রায় অর্ধকোটি মানুষ। অথচ, স্বাধীনতার ৫২ বছর পর আবারও সেই ২২ পরিবারের ভূত’ই যেন আবির্ভূত হয়েছে। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানামুখী সংকটে টালমাটাল বৈশ্বিক অর্থনীতি। সরকারি হিসেবেই প্রায় ২৫ লাখ যুবক কাজের সন্ধানে ঘুরছে। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে প্রায় ২ গুণ। এমন অবস্থার মধ্যেই বেড়ে যাচ্ছে কোটিপতির সংখ্যা। এসব কোটিপতির কেউ সরকারি আমলা, কেউ রাজনীতিবিদ, কেউবা ব্যবসায়ী। দুর্নীতিতে জর্জড়িত প্রশাসন আর ঋণখেলাপিতে দেউলিয়া হতে চলেছে বাংকগুলো। প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে, দেখার কেউ নেই। অর্থনীতির জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মন্দার মধ্যেও কিভাবে বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা, এর প্রভাবই বা কি? জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম. এম. আকাশ বলেন, ‘এটা দুটো জিনিস প্রমাণ করে– দেশের ভিতওে ও বাইরে যুগপৎ একচেটিয়া ফাইন্যান্স পুঁজির উদ্ভব হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ শাসক শ্রেণির ত্রিভুজ ক্ষমতাকাঠামোর প্রত্যক্ষ মদতে তা গড়ে উঠেছে। রাষ্ট্র ও বর্তমান সরকার মুখে যাই বলুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে ও শেষ বিচারে এই বেআইনি পুঁজি সঞ্চয়, পাচার ও ট্যাক্স ফাঁকিকে সুশাসনের আওতায় আনতে সরকার সম্পুর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।’ করোনা ভাইরাস পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৭৩ শতাংশ মানুষের পুষ্টিকর খাবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। জাতিসংঘের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের ‘বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি’ শীর্ষক আরেকটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে দরিদ্রের সংখ্যা ৩ কোটি ১৭ লাখ ৫৭ হাজার। এদেশের প্রচলিত অর্থনৈতিক কাঠামো অনুযায়ী উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, দরিদ্র ও হতদরিদ্র শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল মানুষ। কতিপয় সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণি পরিবর্তন করে উচ্চবিত্ত হলেও বাকিরা যাপন করছে দারিদ্রক্লিষ্ট জীবন। এদিকে উচ্চবিত্ত পৌঁছে গেছে অতি উচ্চে। তাই কোটিপতির টাকার পাহাড় দেখা যায়, কিন্তু দেখা যায়না তার নিচে চাপা পড়া হাজারো দরিদ্রের কান্না।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..