
দিনের প্রান্তিকে স্মৃতিময় গাঢ় রঙ মিলিয়ে যেতে থাকে সীমানাবিলীন অন্ধকারে। নৈঃশব্দ আর বিষণ্নতার ভারে পৃথিবী বিমর্ষ করুণ। অন্ধ শূন্যতায় নীলাকাশ অস্তিত্বহীন। পুঁজঘোলা প্রতিবেশের কোনো কিছুই দৃশ্যমান নয়। ঘোর বিষণ্ন তমসায় অনুভূতিও দশাগ্রস্ত উদাসীনতায় বিহ্বল।
জমাট রক্তের মতো গাঢ় সন্ধ্যার পৃথিবী দিলীপ সিং-এর নয়নে নিরাকার, অতল- অন্ধকারে অদৃশ্য; পূর্বে অশ্রুত শব্দের গোঙানিতে অন্ধকার যেন জ্যান্ত শরীরে মূর্ত হয়ে আঁচড়ায়, হৃৎপি- ছেড়া আর্ত-হাহাকার নিয়ে বাতাস চক্রাকারে ঘোরে; ক্ষতবিক্ষত দিলীপ সিং অস্তিত্ববোধহীন ভাসতে থাকে।
ধীরে ধীরে গ্রামীণ রাত্রির চাঁদ আরো উঠে আসে, সিগারেটের ধোঁয়ার মতো জ্যোৎস্না পেঁচিয়ে দুর্বল করে তোলে রজনীর অন্ধকার। মৃদু মৃদু চেতনায় শিহরিত শরীর। খাঁটিয়ায় শুয়ে দিলীপ সিং অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নিশির নিঃসীম নীলাকাশে অফুরন্ত তারার মেলা। অসহ্য ভ্যাপসা গরম। দেহে এক ফালি কাপড় জড়িয়ে শুয়ে আছে, তবুও সমস্ত শরীরে বিরক্তিকর ঘামের প্লাবন। সারাদিন গনগনে বোদ্দুরে মাটির তৈরি ঘরের দেয়াল তপ্ত হয়ে আছে। কয়েকবার চাঁদ জলে ঢেলেও সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। বরং গোবর ও তুষ মিশ্রিত মাটির সোঁদা গন্ধে নাক ঝাঁঝা করছে। আকণ্ঠ জল পান করেও গলাটা বার বার শুকিয়ে আসছে। এর ওপর মশার উৎপাত, অবিরাম গুনগুন শব্দ। মশাগুলো নাছোড়বান্দার মতো উড়তে উড়তে কখনো দাঁড়ির মধ্যে ঢুকছে, আবার কখনো কানের মধ্যে। সতর্কতার সাথে দিলীপ সিং দুহাতে মশাগুলোকে মারতে চেষ্টা করে। কিছু মরে, আবার কতকগুলো কামড় দিয়ে সন্তর্পণে উড়ে পালায়।
খুব কাছেই দিলীপের কাকার সুরম্য অট্টালিকা। সে চেয়ে দেখে ওই দৃষ্টিনন্দন বাড়ির ছাদে অনেকগুলো খাঁটিয়া পাতা। একটিতে ওর কাকা বান্তা সিং হাত-পা ছড়িয়ে নিশ্চিন্তে উৎফুল্ল চিত্তে ঘুমিয়ে আছে। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের তালে তালে স্ফীতকায় উদর একবার উঠছে আবার নামছে অবিরাম। বিকেলে ভাং খেয়ে এখন সে খোশমেজাজে গভীর ঘুমে বলা যায় অচেতন। ছাদের আরেক পাশে বাড়ির কামিনীরা মৃদুস্বরে সঙ্গোপনে নানা গল্পে মত্ত। ওদের ঘূর্ণায়মান হাত পাখার শব্দ এ ছাদ থেকেও শোনা যাচ্ছে।
দিলীপ সিং বিমর্ষ হৃদয়ে আকাশের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে। মনে তার স্বস্তি নেই। তাই তার ঘুম নিষিদ্ধ হয়ে যায়, বৃক্ষের পাতা অথবা নদীর মতো ঢাকনাবিহীন পোখরাজ চোখ। অথচ তার জনকের সহোদর এবং হত্যাকারী বান্তা সিং কী পরম সুখানুভূতিতে গভীর নিদ্রায় বিভোর। দিলীপ সিং মনে মনে ভাবে এই নিরুপম নিশীথে কাকার বাড়ির সবাই একত্রে খোশগল্প করছে। অথচ ওর কালিনী জননী ছাই দিয়ে এটো বাসন পরিষ্কার করে, গোবর কুড়িয়ে ঘুুটে বানাতে সময় পায় না। কাকার আলয়ে কাজের লোকের কোনো অভাব নেই। অপরদিকে বান্তা সিং এর উর্বশী তনয়া বিন্দু সর্বদা দৃষ্টিনন্দন দামি বাহারি পোশাক নিয়ে বিমোহিত, অথচ দিলীপ সিং এর পরিশ্রমের বিকল্প কিছু নেই।
কয়েক পসলা মেঘ চাঁদের বুক চেটে দ্রুত সরে যায়। হঠাৎ টিনে ঘষা শব্দে চেঁচিয়ে একটি বিহঙ্গ অব্যক্তিবাচক শূন্যতার নৈঃশব্দে বিষণ্নতা বাড়িয়ে পালায়। ঝির ঝির মৃদু মলয়ে গাছের পাতা কেঁপে ওঠে। দিলীপের ঘর্মাক্ত তনুমনে শীতল স্পর্শ অনুভূত হয়ে ওঠে। মধুময় স্নিগ্ধ আবেশে তার দুচোখের পাতা ঘুমে ভারি হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে বান্তা সিং এর বাড়ির ছাদে গল্পরত রমণীরা হাতপাখা রেখে দিয়েছে। বিন্দু দিগন্তবর্তিনী চন্দ্রিমার মতো সুন্দর। নৈশ বাতাসে দোদুল্যমান এবং অসংখ্য নক্ষত্রের আলোয় মৃদু আলোকিত সাইপ্রেস গাছের মতোই সে লাবণ্যময়ী। রাত্রির সঘন অন্ধকারের মতোই কালো তার কেশ। অপরূপে এক আলোর বন্যা খেলে যায় তার চোখের তারায়। তার অধরোষ্ঠের হাসিতে আছে আসন্ন প্রত্যুষের গোলাপী আভা। খাটিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে মাথাটা হেলিয়ে বিন্দু শীতল বাতাসে প্রাণভরে নিশ্বাস নেয়। দিলীপ চেয়ে দেখে বিন্দু আড়চোখে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিপাত করছে। পাশের বাড়িগুলোর ছাদে এবং আঙিনায় অনেকে শুয়ে আছে, তারা সবাই এখন ঘুমে অচেতন। আস্তে আস্তে বিন্দু নিজের খাটিয়ার পাশে এসে দাঁড়ায়। শীতল বায়ুর প্রত্যাশায় সে প্রবল ভাবাবেগে তার আজানুলম্বিত কামিজের দুকোন ধরে দেহের ওপর দিকে টেনে তোলে। কোমর থেকে গলা অবধি বিন্দুর অনাবৃত নিটোল অনিন্দ্য সুন্দর দেহশ্রী চাঁদের রূপালি আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কে যেন নিজের দায়বদ্ধতা থেকে মৃদুস্বরে তাকে ধমক দেয়। বিন্দু অপ্রত্যাশিতভাবে দ্রুত কামিজ নামিয়ে খাটিয়ায় শুয়ে সতর্কভাবে বালিশে মুখ লুকায়। নির্জনতা এবং নৈঃশব্দ পূর্বের মতোই, কোথাও কেউ নেই, বিস্ময়ান্বিত চোখে চারদিকে চেয়ে আবারও ওঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বিন্দু, তখনই তীক্ষ্মতায় ঝংকৃত হয়ে ওঠে অদৃশ্য আওয়াজ–
বলছি, “দাঁড়ানোর চেষ্টা করো না”।
দিলীপ সিং-এর চোখে ঘুম নেই। অপ্রত্যাশিতভাবে ওর তনুমনের নিস্তরঙ্গ সরোবরে কে যেন হঠাৎ করেই ঢিল ছোড়ে। আয়েশি স্বপ্নিল সুখানুভূতিতে এক সময় তার চোঁখ দুটো বুজে আসে। সে আচম্বিতে ঘুমিয়ে পড়ে। হৃদয়ের বাতায়ন থেকে বান্তা সিং-এর বিদঘুটে চেহারাটা একটু একটু করে সরে যায়। তার মানসপটে ভেসে ওঠে বিন্দুর মনোহর নিরাবরণ দেহ সৌষ্ঠব। দিলীপ অনন্যচিত্তে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বিন্দুকে ওর বুকের মধ্যে। বিন্দুর গোলাপী পাপড়ি কাঁপা পোখরাজ নয়নে অনুরাগের রক্তিম আভাস। তাতে নাছোড়বান্দা কামনার প্রার্থনা। দিলীপের সামনে ভেসে ওঠে অনাবিল এক আনন্দোময় পৃথিবী, যেখানে শুধু তন্বী বিন্দু আর বিন্দু। বিন্দু পরম পেয়সী আবরণহীন অপরূপা সুখদ সংবেদনশীল প্রত্যুষে সূর্যের গন্ধ বাড়ে, তাকে ক্রমশ ঝাঁজ ধীরে ধীরে তীব্র হয়। সূর্য উঠলে মাঠে কাজ করা দুরূহ। তাই মা এসে কাঁধে ঝাঁকি দিতেই দিলীপ সিং-এর মধুময় ঘুম ভেঙে যায়। এখন তাকে লাঙল নিয়ে মাঠে যেতে হবে বৈকি। কালা নীলাকাশে তারাগুলো এখনও ঝিকমিক করছে বালিশের তলা থেকে ভাঁজ করা জামাটা নিয়ে দিলীপ গায়ে চাপায়। পাশের ছাদে চেয়ে দেখে বিন্দু সানন্দে বিমোহিত হয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে আছে এরপর দিলীপ লাঙল কাঁধে বলদ দুটো নিয়ে ক্ষেতের দিকে অগ্রসর হয়। ছায়া ঢাকা এবড়োথেবড়ো পথ পেরিয়ে মাঠে পৌছে দেখে চারদিকে চন্দ্রিমা। নিজেকে বড্ড পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছিল তার। বিন্দুর কথা মনে পড়তেই একটা নিটোল পরমানন্দে হৃদয় তার মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।
পূর্বাচলে তখন ধূসর রঙের আভা। বাগান থেকে ভেসে আসে ঘুম ভাঙা কোকিলের সুমধুর ডাক। রাতের শেষ প্রহরে কাকের অবিরাম কা কা রব। একনিষ্ঠভাবে দিলীপ কাজে মনস্থির করতে পারছিল না। আনকোরার মতো ধরা লাঙলের পিছে পিছে আস্তে আস্তে হেঁটে চলে। মাটির বুকে এঁকেবেঁকে অগভীর দাগ কাটে। ভোরের আভা তাকে নিদারুণ লজ্জা দেয়। ব্যাপারটা দিলীপের কাছে অনভিপ্রেত মনে হয়। অপ্রত্যাশিত বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো ঝেড়ে ফেলে সে সজোরে লাঙল মাটিতে চেপে ধরে। ছড়ির প্রচণ্ড আঘাত দিতেই বলদ দুটো লেজ নেড়ে ছুটতে থাকে। লাঙলের তীক্ষ্ম ফলার আঁচড়ে মাটি খণ্ড খণ্ড হয়ে দিলীপের পায়ে গড়িয়ে পড়ে। দিলীপ কাজে উৎসাহ বোধ করে, শক্ত হাল ধরে লাঙলের ফলার দিকে দৃষ্টিপাত করে। ক্রমে ক্রমে প্রখর আভা ছড়িয়ে সূর্য ওঠে। হ্যাঁ, নামিয়ে বলদ দুটোকে গাছের ছায়ায় খালের পাশে নিয়ে দিলীপ যোয়ালের দড়ি খুলে দেয়। নিজে গোসল করে বলদ দুটোর গা ধোয়। এরপর আস্তে আস্তে চনমনে বলদ দুটোকে নিয়ে ভেজা শরীরে বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। প্রতীক্ষারত মমতাময়ী মা ওকে দেখা মাত্র রুটি তরকারি নিয়ে আসেন। সঙ্গে এক বাটি দুধ। দিলীপ প্রসন্নচিত্তে সবটুকু খেয়ে ফেলে। বিদুষী জননী পাশে বসে পাখার বাতাস দেয়। খাওয়ার পর শোয়ামাত্র সে সন্তর্পণে ঘুমিয়ে পড়ে। এরপরও মা সস্নেহে বাতাস করতে থাকেন। দিলীপ বাউরি মনে সারাদিন ঘুমায়। তমসাচ্ছন্ন সন্ধ্যাবেলা উঠে জল সেচের নালা পরিষ্কার করতে ক্ষেতের দিকে রওনা হয়। নালার অপর পাশে দিলীপের চাচার জমি। চাচার জমিতে তখনও লোকজন কাজ করছে। বিনাদ্বিধায় ভাইকে হত্যাকরার পর বদমায়েশ বান্তা সিং সন্ধ্যার পর আর ক্ষেতে আসে না। নালা থেকে আবর্জনা সরিয়ে দিলীপ খালের জলে হাত-পা ধোয়। এরপর জননীর প্রতীক্ষায় দুই হাত পা ঠান্ডা জলে ডুবিয়ে বসে থাকে। পশ্চিমে সূর্য অস্ত যেতেই ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে। দিগন্তপ্রসারী মেঘম্ক্তু আকাশে বাঁকা চাঁদকে ঘিরে অসংখ্য তারা। গোধূলি বেলায় নিড়ে ফেরা বিহঙ্গ-বিহঙ্গীদের মধুর কলরব আর কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দের সাথে কুয়োতলায় ভিড় করা রমনী এবং খেলায় মত্ত শিশুদের উচ্চ সোরগোল। সন্ধ্যার আবছা প্রভায় ঝোপের আড়ালে চোখে পড়ে রূপসী নারীদের দলবেঁধে মলত্যাগ করা আর উবু হয়ে পাশাপাশি বসে খালের জলে বিনাদ্বিধায় শৌচকর্ম করা।
দিলীপের মা ক্যানেল রক্ষকের কাছ থেকে জলসেচের অনুমতি নিয়ে আসে। নিয়ম অনুযায়ী ওদের জমিতে জল দেয়ার সময়। মা ঘরে ফিরে যান। কিছুক্ষণ আগে বান্তা সিং-এর লোকজন কাজ সেরে চলে গেছে। চাচার জমির নালা মুখ বন্ধ করে নিজেদেরটা খুলে দিতেই অমনি কল কল শব্দে জল¯্রােত বয়ে চলে। দিলীপ নালার ধারে সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর শরীরটা এলিয়ে দিয়ে আনমনে শুন্য আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। নালায় প্রবাহিত জলরাশি জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোতে ঝিকমিক করছে। গাঁয়ে হট্টগোলের অস্পষ্ট আওয়াজ। বান্তা সিং-এর জমিতে সে মহিলাদের মৃদু কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। ইলা তখন নিস্তব্ধ চন্দ্রিমার আভায়।
হঠাৎ জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে দিলীপ উল্লসিত হয়ে ওঠে। পাশ ফিরে আড়চোখে দেখে খালের ধারে এক তন্বী রমণী শৌচকর্ম করছে। এক হাতে উরুদেশের মাঝখানে জল ছিটিয়ে আরেক হাতে পরিষ্কার করছে। বা হাতের তালু মাটিতে ঘষে মেয়েটি খালের জলে হাত ধোয়। সে আনমনে অঞ্জলি ভরে মুখে জল ছিটায়। তারপর আস্তে আস্তে উদাসীমনে ওঠে দাঁড়ায়। অনেকটা ঢিলেঢালা পায়জামাটা তার পায়ের গোড়ালিতে জড়ো হয়ে আছে। গেহটা অনেকটা বাঁকা করে সামনে ঝুঁকি কামিজের সম্মুখ ভাগ তুলে উর্বশী মুখ মোছে।
এই সেই বিন্দু! তাই না?
দিলীপের তনুমন উন্মুক্ত অভিলাষ এবং অনাবিল আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। প্রত্যয়দীপ্ত হয়ে দিলীপ প্রবল ভাবাবেগে-খালটা এক লাফে পেরিয়ে ওর দিকে ছুটে যায়। বিন্দুর চন্দ্রানন নীলাম্বরে ঢাকা। দিলীপ পেছন থেকে ওকে দুহাত দিয়ে বুকের মধ্যে চেপে ধরে। হঠাৎ মুখ ফেরাতেই নিজের কামনা সিক্ত ঠোঁট বিন্দুর কোমল ঠোঁটে, মুখে ও গলায় স্পর্শ করতে থাকে ব্যাকুলভাবে। বিন্দুর বিস্ময়ান্বিত ভয়ার্ত চিৎকার স্বকণ্ঠে তলিয়ে যায়। দু’হাতে শূন্যে তুলে দিলীপ সবুজ ঘাসের মসৃণ গালিচায় বিন্দুকে শুয়ে দেয়। খাঁচায় বাঁধা পাখির মতো বিন্দু ভয়ার্ত পরশে ছটফট করতে থাকে। হিংস্রভাবে দ্বিধান্বিত হয়ে দু’হাতে দিলীপের দাঁড়ি টানে। বিন্দু তার ধারালো কামড়ে দিলীপের নাক দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে। এই মধুযামিনীতে ক্রমশ বিন্দুর শেষ শক্তিটুকুও নিঃশেষিত হয়ে যায়। নিজেকে মুক্ত করার সব প্রচেষ্টা ত্যাগ করে সে নিস্তেজ হয়ে যায়। বিন্দুর নিমীলিত আঁখি বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ে। চোখের কাজল ধুয়ে যায়। মৃদু জোছনার আধো আলো আধো ছায়ায় বিন্দুকে অপরূপ মনে হয়।
দিলীপের হৃদকন্দর বেদনায় ভরে ওঠে। বিন্দুকে তো সে কোনোভাবেই আঘাত দিতে চায়নি। সে নিবিড়ভাবে বিন্দুর কপালে হাত বুলোয়, অবিন্যস্ত কুন্তলে অঙ্গুলি সঞ্চালন করে। দিলীপ মুখটা নামিয়ে অনেকটা আপ্লুত হয়ে ওর নাকে নিজের নাক ছোঁয়ায়। বিন্দু চেয়ে থাকে একেবারে শূন্য ভাবলেশহীন দৃষ্টি। ওদের চোখে নেই কোনো ঘৃণা, নেই ভালোবাসা শুধু পরস্পর অপলক চাওয়া-চাওয়ি। দিলীপ বিন্দুর চোখে ও নাকে আলতো চুমু খায়। বিন্দু নির্বাক চেয়ে থাকে, দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সখীরা বিন্দুকে না দেখে ডাকাডাকি করতে থাকে। বিন্দু নিরুত্তর। একজন এগিয়ে এসে ওদেরকে ওই অবস্থায় দেখে ভীতস্বরে চিৎকার করে ওঠে। দিলীপ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। এক লাফে খালের ওপারে গিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দেয়।
সিংপুর গ্রাম ভেঙে লোক এসেছে মামলার রায় শুনতে। আদালতের ভেতরে এবং আদালত প্রাঙ্গণে লোকে লোকারণ্য। বারান্দার এক কোণে দিলীপ বসে আছে। হাতে হাতকড়ি, দু’পাশে দু’জন পুলিশ। চাদরে মুখ ঢেকে দিলীপের মা পাশে বসে বাতাস করছে। থেকে থেকে ফুপিয়ে কাঁদছে আর নাক ঝাড়ছে। বারান্দার ওপাশে বিন্দুকে ঘিরে বসে আছে ওর মা ও গাঁয়ের অন্যান্য মহিলারা। বিন্দুও কাঁদছে। বার বার কাপড়ের আঁচল দিয়ে নাক মুছছে।
ওপাশে বান্তা সিং কতগুলো লোকের সাথে চাপাস্বরে শলা পরামর্শ করছে। কেউ কেউ সময় কাটাবার জন্যে ফেরিওয়ালাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে মিষ্টি কিনে খাচ্ছে। কেউ বা ঘটনার সূত্র ধরে যৌন রসালাপে মত্ত। একে অপরকে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে ফিক ফিক করে হাসছে। মামলা পরিচালনার জন্যে বান্তা সিং একজন সাক্ষীসাবুদ সংগ্রহ করে তাদের আসামীপক্ষের সম্ভাব্য প্রশ্নের সঠিক উত্তর শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছে। সে আদালতে দারোয়ান পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। ওরা বকশিশ পেয়ে খুশি। এক তাড়া নোট গুঁজে দিয়েছে সরকারি উকিলের পকেটে। আদালত এখন তার হাতের মুঠোয়। দিলীপের পক্ষে উকিলও নেই, কোনো সাক্ষীও নেই। দরজা খুলতেই সদলবলে বান্তা সিং আদালত কক্ষে প্রবেশ করে। পুলিশ দিলীপকে ভেতরে নিয়ে এলো। বকশিশ না দেয়ায় দারোয়ান দিলীপের মাকে ঢুকতে নিষেধ করে। ম্যাজিস্ট্রেট কুমার সাহেব আসন গ্রহণ করলে তাকে আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ পাঠ করে শোনানো হলো।
দিলীপের বিনীত দাবি সে সম্পূর্ণ নিরপরাধ। কুমার সাহেব বিন্দুকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দিলেন। চাদরে মুখাবৃত বিন্দু কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ায়। ইন্সপেক্টর বিন্দুকে তার পিতার সাথে দিলীপের পারিবারিক শত্রুতার কথা জিজ্ঞাসা করে। আদালতে প্রমাণস্বরূপ উপস্থাপন করে অশ্রুমিশ্রিত বিন্দুর রক্তাক্ত পোশাক। অপরাধী প্রতিপাদন কার্য সমাপ্ত হয়।
আসামির স্বপক্ষে কোনো বক্তব্য আছে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে দিলীপ করজোড়ে উত্তর দেয়, “হুজুর, বিশ্বাস করুন, আমি অপরাধী নই”।
কুমার সাহেব অধৈর্য হয়ে বললেন, “তোমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তুমি নিশ্চয় শুনেছো? এবার বাদীকে তোমার কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারো। আমি আদালতের রায় দেবো”।
হুজুর আমার কোনো উকিল নেই। গাঁয়ে আমার কেউ নেই যে আমার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। আমি খুবই গরিব। হুজুর, আমাকে দয়া করুন। আমি কোনো অপরাধ করিনি।
ম্যাজিস্ট্রেট রাগত স্বরে কেরানিকে বললেন, “লিখুন, আসামির কোনো বক্তব্য নেই”।
“তবে”, দিলীপ সিং রাগে তো তো করে বলে ওঠে, “আমাকে জেলে পাঠাবার আগে আমার একটি আর্জি আছে। হুজুর, শুধু একবার ওকে জিজ্ঞাসা করুন, ওই ব্যাপারে ওর সম্মতি ছিল কি না। ও আমাকে চেয়েছে বলেই আমি ওর কাছে গিয়েছিলাম, আমি নিরপরাধী।
কুমার সাহেব কেরানির দিকে মুখ ফেরালেন। আসামি জেরা করছে, তুমি কি স্বেচ্ছায় ওই যুবকের কাছে গিয়েছিলে?
উত্তর দাও......................।
বিন্দুকে লক্ষ্য করে কুমার সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “জবাব দাও, তুমি কি স্বেচ্ছায় আসামির কাছে গিয়েছিলে?”
বিন্দু নাক ঝেড়ে ফুঁপিয়ে কাদতে থাকে। ম্যাজিস্ট্রেট এবং আদালতে উপস্থিত সকলে উৎসুক চিত্তে অপেক্ষমান। “হ্যাঁ কি না? উত্তর দাও, আমার আরও কাজ আছে”। নম্র নত মস্তকে চাঁদরের ভাঁজে মুখ ঢেকে বিন্দু উত্তর দেয় “হ্যাঁ”।
লেখক পরিচিতি
খুশবন্ত সিং ১৯১৫ সালে বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত পাঞ্জাবের হাদালি নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। খুশবন্ত সিং একাধারে খ্যাতিমান উপন্যাসিক, ঐতিহাসিক, ছোটগল্প রচয়িতা এবং লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাংবাদিক ছিলেন। দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে অধ্যয়ন শেষে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে এল এল বি এবং ইনার টেস্পল থেকে বার-অ্যাট-ল করার পর লন্ডনস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে জনসংযোগ অফিসার হিসেবে কিছু দিন কাজ করেছিলেন। তিনি ২০ মার্চ ২০১৪ নয়া দিল্লিতে পরলোক গমন করেন। বক্ষ্যমান গল্পটি চার রচিত “দ্য রেইপ”- এর বঙ্গানুবাদ।