বিপ্লবী গণ-নারী সংগঠন গড়ার প্রত্যয়ে এবারের নারী দিবস
মমতা চক্রবর্তী
মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ অর্থ্যাৎ সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদী সমাজেই প্রকৃত নারীমুক্তি সম্ভব। সকল প্রকার শ্রেণি ও শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত মানবমুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে নারীমুক্তির সংগ্রামও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারীমুক্তির সংগ্রাম শুধুমাত্র নারীর একার নয়, সর্বকালে এই সংগ্রাম সকল মানুষের। কারণ পুঁজিবাদী সমাজে নারীর সৃষ্টিশীল সত্তা বিকাশের স্বার্থে তাকে দ্বৈত শক্রর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। শ্রমিক হিসেবে তার লড়াই পুঁজির বিরুদ্ধে আর নারী হিসেবে লড়াই পুরুষ ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। আজ নারীর লড়াই খুবই কঠিন ও জটিল।
বর্তমান এক কঠিন সমাজ বাস্তবতায় নারীর বহুমুখী সমস্যা সংকুল জীবন ব্যবস্থাকে সঠিক উপলব্ধিতে নিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বিগত একাদশ কংগ্রেসে সমাজ বদলের সহায়ক একটি বিপ্লবী গণ-নারী সংগঠন গড়ার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নিয়েছে। পার্টির দৃষ্টিভঙ্গিতে বিরাজমান লুটেরা পুঁজির আধিপত্যের সমাজে নারী সমাজের সংকটগুলো দিন দিন জটিল আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঘরে-বাইরে নারীদের জীবনে বৈষম্য, নিপীড়ন, নিগ্রহ, অত্যাচার, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, অপহরণ, বিদেশে পাচার অব্যাহত এবং ক্রমাগত বাড়ছে। বর্তমান রাষ্ট্র ও সমাজ নারীকে বিলাসদ্রব্য, ভোগ্যপণ্য ও বিজ্ঞাপনের পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে। নারীরা শ্রমবাজারে যুক্ত হলেও মজুরি ও কাজের বৈষম্যের শিকার। উপরন্তু নারীর গার্হস্থ্য কাজের কোনো সামাজিক এবং আর্থিক স্বীকৃতি নেই। উগ্র-ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছেও নারীরা প্রথম ও প্রধান শিকার। সম্পত্তির সমঅধিকার থেকে নারীরা এখনো বঞ্চিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রমজীবী নারীরা যৌন নিপীড়নসহ নানামুখী নির্যাতনের শিকার।
এছাড়াও পুরুষতান্ত্রিকতার যাতাকলেও পিষ্ট। নারী নীতির সঠিক বাস্তবায়ন করছে না রাষ্ট্র। আরো বহুবিধ সংকট যথা- খাদ্য, পুষ্টি, কর্মপরিবেশ, চিকিৎসা, নারী শিশুর নিরাপত্তা সবই সংকটাপন্ন এবং রাষ্ট্র নারীর সুরক্ষা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এমনকি শিক্ষার্থী মেয়েদের শিক্ষা জীবনকে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের উপায় হিসেবে ব্যবহার করে অতিষ্ঠ ও বিপন্ন করে তুলেছে। নিকট অতীতের শিকার ‘ফুলপরী’ নামক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী। সরকার এখনো নীরব ভূমিকায় থাকায় আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে বিষয়টি।
এতসব ঘটনার পরেও দেশে কার্যকরী কোনো নারী আন্দোলন ও সংগ্রাম অনুপস্থিত। কতিপয় সচেতন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারীর প্রতিবাদ পত্রিকায় বিবৃতিসর্বস্ব পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। নারীরা যেন তাদের অতীত গৌরবোজ্জল আন্দোলন সংগ্রামের ভূমিকা বিস্তৃত হয়ে রাজপথের সংগ্রাম ভুলে কোনো এক নিদ্রাভূমে আশ্রয় নিয়েছে। অথচ দেশে প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দলের গণ-নারী সংগঠন বহু ছাত্রী, ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত থেকে নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারের পন্থা বেছে নিয়ে প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনকে অস্থির করে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দিচ্ছে।
এছাড়াও দেশে শ্রমিক-কৃষক-গৃহিণীসহ বিভিন্ন শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীসহ, অর্ধ নারী জনগোষ্ঠী। উপরন্তু নারীদের সমস্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার পরেও নারীরা জীবন যুদ্ধের পরাজিত সৈনিকের চেতনাহীন জীবন হয়ে চুপসে আছে সংকটাপন্ন বর্তমান আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও এক অস্থির সংস্কৃতির আঙিনায়।
নারী আন্দোলন সংগ্রামের এক স্পন্দনহীন ও নৈরাজ্যের আলোহীন প্রেক্ষাপটে ২০২৩-এর নারী দিবস ৮ মার্চ আগত। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ৮ মার্চের জন্যই হয়েছিল শ্রমিক নারীদের এক অগ্নিঝরা আন্দোলন-সংগ্রামের পটভূমিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায়। শ্রমিক নারীর সমমজুরি, কর্মঘণ্টা কমানো এবং কর্মক্ষেত্রে মানবিক পরিবেশের উন্নতির দাবি নিয়ে এবং এই দিবসটির গুরুত্ব উপলব্ধিতেও এগিয়ে আসেন জার্মান কমিউনিস্ট নারী ক্লারা জেটকিন। ১৯১০ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন থেকেই ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নারীদের সম অধিকারের দাবিতে ১৯১১ সালে থেকে এই দিবসটি পালিত হয়। সারা পৃথিবীতে কমিউনিস্ট এবং বামপন্থিরাই কেন নারীর সম অধিকার, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর শোষণ-বৈষম্য এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে আসছে।
উদাহরণ স্বরূপ, উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯২৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টি। এই পার্টির মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীন দেশে একটি শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সাথে সংগতি রেখে শ্রমিক-কৃষকসহ সকল শোষিত শ্রেণির আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার পাশাপাশি শোষিত-বঞ্চিত নারী সমাজকে আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পৃক্ত করা। ৪০-এর মাঝামাঝি সময়ে ফ্যাসিস্ট হিটলার বাহিনীর কলকাতায় বোমাবর্ষণের পর পরিস্থিতির তাগিদে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার পাশাপাশি শোষিত-বঞ্চিত নারী সমাজকে আন্দোলন-সংগ্রামে সম্পৃক্ত করা হয়। ‘৪০- এর মাঝামাঝি সময়ে ফ্যাসিস্ট হিটলার বাহিনীর কলকাতায় বোমাবর্ষণের পর পরিস্থিতির তাগিদেই কমিউনিস্ট মেয়েরা ‘আত্মরক্ষা সমিতি’ গঠন করেন। ১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টি এই সমিতিকে সমন্বিত ও সুসংগঠিত করার উদ্যোগ নিয়ে ‘নিখিল বঙ্গ আত্মরক্ষা সমিতি’ নামে অভিহিত করলে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি নারী, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তসহ সর্বস্তরের নারীদের সংগঠিত করতে পেরেছিল নিজেদের আন্তরিক, নিঃস্বার্থ ও নিরলস প্রচেষ্টার দ্বারা এবং পরবর্তীতে এই নারী কমরেডরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনসহ ঐ সময়ের কৃষকদের বড় বড় আন্দোলন তথা টংক, তেভাগা ও নানকার আন্দোলন সংগ্রামে এক বড় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ইতিহাসের বিশেষ স্থানে উজ্জল হয়ে আছেন। তেমনিভাবে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসানে ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। ১৯৫২ সনের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের গর্ভ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে একটি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন গণ সংগঠন জন্ম লাভ করে একঝাঁক ছাত্র-ছাত্রী সমন্বয়ে। আর এই প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক ছাত্রীরাই ১৯৭০ সনের ৪ এপ্রিল কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ‘মহিলা পরিষদ’ গণ-নারী সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এখানেও তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগী ভূমিকায় এই গণ-নারী সংগঠন। যে সংগঠন স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের তিন দশক নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই গণ-নারী মহিলা পরিষদ এক অনন্য-সাধারণ ভূমিকায় সারা দেশে নারীদের একটি সম্মিলিত আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে। সময় প্রবাহে এই সংগঠনটি তার সঠিক কর্তব্যের অবস্থানটি ধরে রাখতে পারেনি।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৃহত্তম নারী সমাজের আন্দোলন সংগ্রামের নির্লিপ্ততা ও সময়ের তীব্র চাহিদায় একটি বৃহত্তর নারীগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন সংগ্রামে পুনরায় নারীদের শাণিত চেতনায় প্রগতির পথে এগিয়ে নিতে এবং সমাজ বদলের আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি করতে একটি বিপ্লবী গণ-নারী সংগঠন গড়ে তোলা করণীয় হিসেবে একাদশ কংগ্রেসে পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশের সকল জেলাসহ ঢাকার স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয় কমিটির নারী কমরেডদের নিয়ে পার্টির মূল নেতৃত্ব একটি কমিউনিস্ট নারী সদস্য পরামর্শক সভা সম্পন্ন করেছে।
দুঃখের বিষয় এটাই, সকল জেলায় পার্টি সংগঠন থাকা সত্ত্বেও নারী কমরেডদের উপস্থিতি ছিল মাত্র ৬০/৭০ জনের মতো। আরো একটি দুর্বলতার দিক হলো ঢাকা শহরের স্থানীয় কমরেডসহ কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সদস্য পর্যন্ত এতে উপস্থিত হননি। এতে সমগ্র পার্টির শক্তি-সামর্থ ও চেতনার দৈন্যতার চিত্রটিই বেরিয়ে এসেছে। খুবই দুর্ভাগ্য ও হতাশজনক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা নারী কমরেডরা। নারী কমরেডদের পার্টির আদর্শ-উদ্দেশ্য-লক্ষ্য-শৃঙ্খলা ও দায়িত্ব কর্তব্যের জায়গাটি খুবই দুর্বল।
শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সমাজ বদলের বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন। এই কাজটি সম্পন্ন করতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল কমরেডকে পার্টির মূল আদর্শ-উদ্দেশ্য এবং নিরলস কাজের বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রেখে ধারাবাহিক কাজগুলো গুরুত্বের সাথে চালিয়ে যেতে হবে এবং চেতনার মান বৃদ্ধি করতে হবে। পার্টি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে বর্তমানে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের লড়াইসহ জনগণের প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই লড়াইতে দেশের ব্যাপক নারী জনসমাজকেও সম্পৃক্ত ও সংগঠিত করার লক্ষ্যে নতুন একটি বিপ্লবী গণ-নারী সংগঠন গড়ার চেষ্টায় সূচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
পার্টির এই উদ্যোগকে সফল করতে দেশের সকল নারী কমরেডদের অনেক সক্রিয় সহযোগিতার ভূমিকা বাড়িয়ে দিতে হবে। ইতোপূর্বের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা বলে পার্টির বিপ্লবী উদ্যোগ কখনো বৃথা যায়নি। এছাড়া ব্যাপক নারী সমাজের মানব মুক্তির লক্ষ্য কেবল সমাজ বদলের মধ্য দিয়েই সম্ভব। তাই বিপ্লবী গণ-নারী সংগঠনের কোনো বিকল্প নেই এই মুহূর্তে। নারী-পুরুষ সকল কমরেডদের ঐক্যবদ্ধ নিরলস চেষ্টায় ও এই কর্মেই বিপ্লবী গণ-নারী সংগঠন দ্রুত গড়ে উঠুক–এই প্রত্যাশায় এবারের আমাদের নারী দিবস।
লেখক: সদস্য, সিপিবি, ঢাকা দক্ষিণ
Login to comment..