কমরেড দুলাল কুন্ডু লাল সালাম

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

জিন্নাতুল ইসলাম প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট কমরেড দুলাল কুন্ডু একজন অসাধারণ সমাজ বিপ্লবী ছিলেন। তিনি ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক, মানবিক গুণাবলি সমৃদ্ধ একজন বড় মাপের কমিউনিস্ট নেতা। ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, কুসংস্কার মুক্ত অসাম্প্রদায়িক দ্বান্দিক বস্তুবাদে বিশ্বাসী, সমাজ বিপ্লবের একজন বিশ্বস্ত অগ্রসেনানী। তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নে। তিনি যুব ইউনিয়ন বগুড়া জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. কমরেড দুলাল কুন্ডু বগুড়া করোনেশন ইনস্টিটিউশন থেকে ১৯৭০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক এবং পাবনা সরকারি বুলবুল কলেজ থেকে ১৯৮০ সালে বিএ পাস করেন। দীর্ঘদিন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে চাকুরি করেন এবং চাকুরিরত অবস্থায় ১৯৮৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৮৫ সালে বার কাউন্সিল হতে লাইসেন্স পান। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। এক পর্যায়ে চাকুরি ছেড়ে তিনি আইন পেশায় নিজেকে নিযুক্ত করেন এবং সক্রিয়ভাবে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। লড়াই সংগ্রাম, আন্দোলন এবং ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্যে দিয়ে রাজনীতিতে একজন প্রথম কাতারের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। কমরেড দুলাল কুন্ডুর আত্মত্যাগ, সাংগঠনিক দক্ষতা, সততা, দেশপ্রেম প্রভৃতি গুণাবলির কারণে তাঁকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত করে। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বগুড়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সুনাম এবং দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন একাধারে দেশপ্রেমিক ও বিনয়ী। তিনি ধীর-স্থির এবং শান্ত প্রকৃতির একজন কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন। কখনো কারও সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে নিজেকে জড়াতেন না। তাঁর জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা ছিল অতুলনীয়। সততা এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে আইন পেশার কার্যক্রমের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। গরিব মোয়াক্কেলদের মামলা বিনা পারিশ্রমিকে পরিচালনা করতেন। কোনো গরিব মোয়াক্কেলের যাতায়াতের টাকা না থাকলে তিনি নিজের পকেট থেকে টাকাও দিতেন। তাঁর বড় গুণ ছিল, তিনি সকলের কথা মনোযোগ সহকারে শুনতেন এবং সকলের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন। কমরেড দুলাল কুন্ডু বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সদস্য ছিলেন। তিনি আদিবাসী ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন। আদিবাসী বন্ধুদের প্রায় সকল মামলা তিনি বিনা পারিশ্রমিকে পরিচালনা করতেন। প্রয়াত এই বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা বগুড়া পৌর এলাকার গাজী পালশা কুন্ডু পাড়ায় ২১ নভেম্বর ১৯৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৃত মাখন চন্দ্র কুন্ডু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ঈর্ষণীয় পর্যায়ে ছিল। মাতা মৃত উষা রাণী কুন্ডু ছিলেন গৃহিণী। পাঁচ ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে দুলাল কুন্ডু ছিলেন দ্বিতীয়। তার সহধর্মিনী শিক্ষিকা হিসেবে গোদারপাড়া ছয়পুকুরিয়া বালিকা বিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন। প্রয়াত কমরেড দুলাল কুন্ডু গরিব মেহনতি মানুষের রাজনীতি করতেন। তিনি নিপীড়িত নির্যাতিত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। গরিব মেহনতি মানুষের দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। শত বাধা-বিপত্তি, নির্যাতন, শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রতিটি লড়াইয়ে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন নীতিতে নিষ্ঠাবান, কৌশলে নমনীয়। ১৯৬৯ সালে ১১ দফা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং অবদান রেখেছেন। প্রতিটি মিছিলে, কর্মসূচীতে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল। এই সময়ে তিনি কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি বীরত্বর্পূণ অবদান রেখেছেন। অনেক ঝুঁকিপূর্ণ লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। প্রতিবাদ করেছেন এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। প্রয়াত এই নেতা অন্যায় অবিচার, শোষণ-লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। স্বাধীনতাবিরোধী জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। বগুড়ার গণজাগরণ মঞ্চে তিনি নিয়মিত বক্তৃতা করেছেন এবং সাহসী অবদান রেখেছেন। তিনি যুব ইউনিয়নের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৮৮ সালে ৬ মাসের একটি শিক্ষা কোর্সে অংশ নিতে মস্কোতে যান। এছাড়া ব্যবসা সংশ্লিষ্ট কাজে বেলজিয়াম, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, হংকং, ব্যাংকক, ভারত ভ্রমণ করেন। আইনজীবী প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ফ্রান্সও সফর করেন। কমরেড দুলাল কুন্ডু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তবাজার অর্থনীতি মানবমুক্তির দুশমন। পুঁজিবাদ ধনিক শ্রেণি ও লুটেরাদের সমাজ ব্যবস্থা। পুঁজিবাদ শোষণ, মুনাফা, লুণ্ঠন ছাড়া কিছুই বোঝে না। একভাগ মানুষ শাসন করে শোষণ করে নিরানব্বই ভাগ মানুষকে। অমানবিক একটি সমাজব্যবস্থা হলো পুঁজিবাদ। আমাদের প্রিয় নেতা একটি শ্রেণিহীন, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা তথা সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু লড়াই করেছেন। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী ধনিক শ্রেণি ও লুটেরাদের স্বার্থরক্ষা করে, প্রতিনিধিত্ব করে। ধনিক শ্রেণির রাজনৈতিক দল দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ-সাম্যের বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব না। কমিউনিস্ট এবং বামপন্থিদের উত্থান আজ সময়ের দাবি। এক বুর্জোয়া দলকে হটিয়ে জামাত-বিএনপিকে নয়, এরা আরও দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল। তাই ক্ষমতার আনতে হবে কমিউনিস্ট বামপন্থিদের। গঠন করতে হবে গরিব মানুষের সরকার। এজন্য বাম গণতান্ত্রিক বিকল্পের কোনো বিকল্প নেই। সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ হলো গরিব মেহনতি মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ। আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রিয় নেতা কমরেড দুলাল কুন্ডু দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ মৃত্যুবরণ করেন। প্রিয় নেতার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। কমরেড দুলাল কুন্ডুর মৃত্যুতে শুধু কমিউনিস্ট পার্টির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা নয়। বগুড়ার গণতান্ত্রিক এবং বাম আন্দোলনেরও অপূরণীয় ক্ষতি হলো। দেশ হারালো এক সন্তানকে। গরিব-মেহনতি মানুষ হারালো তাদেরই এক অকৃত্রিম বন্ধুকে। এ ক্ষতি সহসাই পূরণ হওয়ার নয়। কমরেড দুলাল কুন্ডু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, পুঁজিবাদী সমাজের পরবর্তী সমাজটাই হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক সমাজ, ইতিহাসের আগের প্রত্যেকটি সমাজের যেভাবে জন্মের পর মৃত্যুও হয়েছে পুঁজিবাদী সমাজেরও ঠিক একইভাবে বিকাশের একটি পর্যায়ের পরে মৃত্যু ঘটবে। আর পুঁজিবাদী সমাজকে ধ্বংস করেই জন্ম নেবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ”। দুলাল কুন্ডু নির্যাতন সহ্য করেছেন, আত্মগোপনে থেকেছেন তবুও আদর্শচ্যুত হননি, আপস করেননি, আত্মসমর্পণ করেননি। আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে সমাজ বিপ্লবের লক্ষ্যে আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন। প্রয়াত নেতার রেখে যাওয়া আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করে কাস্তে-হাতুড়ি খচিত রক্ত রাঙা লাল পতাকা শক্ত হাতে ধরে বীরদর্পে সামনের দিকে আমরা এগিয়ে যাবো। গড়বো নতুন সংস্কৃতি, নতুন সমাজ, নতুন সভ্যতা শ্রেণিহীন শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা, সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ। প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. কমরেড দুলাল কুন্ডু লাল সালাম। লেখক : সভাপতি, বগুড়া জেলা কমিটি, সিপিবি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..