কমিউনিস্ট পার্টি কী?
লুৎফর রহমান
কমিউনিস্ট পার্টি কী, এই আলোচনায় যেতে হলে কিছু বিষয় পরিষ্কার হতে হবে। যেমন- পার্টি, উৎপাদন প্রণালী, উদ্বৃত্ত-মূল্য ইত্যাদি। এই বিষয়গুলোর ওপর বিস্তৃত আলোচনা প্রয়োজন, তবে এখানে হবে সংক্ষিপ্ত।
পার্টি:
আমরা জানি একসময় সমাজ ইতিহাসের গতিধারায় শ্রেণিবিভক্ত হয়ে যায়। ফলে শ্রেণিগুলোর স্বার্থ ভিন্ন ভিন্ন হয়। একেক শ্রেণি স্বার্থ হাসিলে সংগঠিত হয়। এখান থেকেই রাজনৈতিক দল বা পার্টির জন্ম। প্রত্যেক দল সমাজে বিদ্যমান শ্রেণিগুলোর অংশ। তারা নিজেদের স্বার্থ জনগণের মধ্যে তুলে ধরে। শেণিস্বার্থ রক্ষার জন্য তুমুল লড়াই করে। এই লড়াইয়ের বাস্তব ভিত্তি হচ্ছে পার্টি। মূলত শ্রেণি-সংগ্রামের মাঠেই রাজনৈতিক দলের উৎপত্তি।
উৎপাদন প্রণালী:
সমাজের যতো পরিবর্তনই হোক সব সমাজেই উৎপাদন বিরাজমান। উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন মানুষের শ্রম। শ্রম হচ্ছে মানুষের সচেতন ও উদ্দেশ্যপূর্ণ মানবিক কাজের এক প্রক্রিয়া। শ্রমের জন্য প্রয়োজন শ্রমের বস্তু। মানুষ যে প্রাকৃতিক পদার্থসমূহের ওপর কাজ করে সেগুলো শ্রমের বস্তু। মানুষ শ্রমের বস্তুর ওপর শ্রম প্রয়োগের জন্য যেসব উপকরণ ব্যবহার করে তাকে শ্রমের উপকরণ বলে। শ্রমের বস্তু ও উপকরণ একত্রে মিলে হয় উৎপাদনের উপকরণ। উৎপাদনের উপকরণ ব্যবহার করে যে সকল মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান কাজে লাগিয়ে উৎপাদন করে তারা উৎপাদিকা শক্তি। আর উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় হওয়া মানুষে মানুষে সম্পর্ককে উৎপাদন-সম্পর্ক বলে।
সমাজ বিকাশের একটি পর্যায় থেকে প্রতিটি পর্যায়ে থাকে নিজস্ব উৎপাদিকা শক্তি এবং এর সাথের উৎপাদন-সম্পর্ক। উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্ক মিলে হয় উৎপাদন-প্রণালী। সেটা গড়ে ওঠে উৎপাদনের উপকরণের ওপর মালিকানার ভিত্তিতে। এই মালিকানাই উৎপাদন-প্রণালীর সব নিয়মকানুন ঠিক করে দেয়।
উদ্বৃত্ত-মূল্য:
সহজ কথায় পুঁজিবাদী উৎপাদন-প্রণালীতে পণ্য বিনিময়ের ফলে পুঁজিপতির যে পরিমাণ পুঁজি বেড়ে যায় তাকে বলে উদ্বৃত্ত-মূল্য। যেমন, একজন পুঁজিপতির নিকট থেকে কোনো চালক ভাড়ায় একটি অটো গাড়ি নিয়ে ৮ ঘণ্টা চালিয়ে ৮০০ টাকা রোজগার করলো। সে ভাড়া ৪০০ টাকা মালিককে দেয়ায় তার ভাগে রইলো ৪০০ টাকা। সে তার দেয় শ্রম সময়ের ৪ ঘণ্টার দাম পেলো। বাকি ৪ ঘণ্টার মূল্য মালিক আত্মসাৎ করলো। এই ৪০০ টাকা মালিকের পুঁজির সাথে যুক্ত হয়ে তার পুঁজি বেড়ে গেলো। এটাই শ্রমিকের উদ্বৃত্ত-মূল্য আত্মসাৎ।
এখন আমরা কমিউনিস্ট পার্টি কী এই আলোচনায় যেতে চাই। প্রত্যেক শ্রেণিবিভক্ত সমাজই মৌলিক দুই শ্রেণি দ্বারা বিভক্ত থাকে। পুঁজিবাদী সমাজে আছে শোষক পুঁজিপতি শ্রেণি বা বুর্জোয়া শ্রেণি এবং শোষিত শ্রমিক শ্রেণি। পুঁজিপতি শ্রেণির আকার ক্ষুদ্র এবং শ্রমিক শ্রেণির আকার বৃহৎ। তারপরও রাষ্ট্রের ক্ষমতা বুর্জোয়া শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে থাকে।
বুর্জোয়া শ্রেণির ধরনটা এক রকম না, এদের বিভিন্ন স্তর থাকে। যেমন, বৃহৎ বুর্জোয়া, একচেটিয়া বুর্জোয়া, লুটেরা বুর্জোয়া, ফ্যাসিস্ট বুর্জোয়া, ফিনান্সিয়াল বুর্জোয়া, মধ্য বুর্জোয়া, পাতি বুর্জোয়া প্রভৃতি স্তর। বুর্জোয়াদের সাথে বুর্জোয়াদের প্রতিযোগিতা থাকে। যুদ্ধও হয়। যেমন, আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পাতি বুর্জোয়ারা যুদ্ধ করেছিলো পাকিস্তানের বৃহৎ বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে অন্যান্য শেণি-পেশার মানুষের সাথে। এমন প্রতিযোগিতার কারণে একই দেশে অনেক বুর্জোয়া দল থাকে। যেমন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামাত ইত্যাদি। এইসব ধনিকদের দল বিভিন্ন স্তরের স্বার্থ নিয়ে কাজ করে। কিন্তু এসব দলগুলোর কোনোটাই পুঁজিবাদী শোষণভিত্তিক উৎপাদন-ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে না এবং তাদের কর্মসূচিতে পুঁজিবাদের অবসানের কথা থাকে না। যেমন, বিএনপির ২৭ দফা রাষ্ট্র মেরামতের প্রস্তাবে পুঁজিবাদ নির্মূলের কোনো কথা নেই। অন্যদিকে যদি পুঁজিবাদী সমাজের উচ্ছেদের অবস্থা সৃষ্টি হয় তখন বুর্জোয়া দল এক হয়ে লড়াই করে। তখন তারা গণতন্ত্র, মানবতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভুলে যায়। তারা সব সময় মনে রাখে বুর্জোয়া শ্রেণির আসল স্বার্থ নিহিত আছে শ্রমিক শ্রেণির দ্বারা সৃষ্ট উদ্বৃত্ত-মূল্য আত্মসাৎ করার মধ্যে।
অন্যদিকে শ্রমিকও বহুস্তর বিশিষ্ট হওয়ায় তাদের মধ্যে একাধিক পার্টির অস্তিত্ব আছে। আপন কাঠামোর মধ্যেই শ্রমিক শ্রেণির বিভিন্ন বাহিনী আছে। যেমন, পরিবহন-শ্রমিক, নির্মাণ-শ্রমিক, শিল্প-শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, কর্মচারি, ওয়ার্কসপ-শ্রমিক, দোকান-শ্রমিক আর আছে বেকাররা। এছাড়া জাতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও নানা দিক থেকে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
অবাদ প্রতিযোগিতার পুঁজিবাদী সমাজে ছোট পুঁজির মালিক প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে নিঃস্ব হয়ে শ্রমিক হয়। এরা পুঁজিবাদী আদর্শেই থেকে যায়, এমন কি পুঁজিবাদী দলে যোগদান করে ভূমিকাও রাখে। তাদের ওপরও পুঁজিবাদের শোষণ চলে। শ্রমিক শ্রেণিকে সব সময় শোষকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলতে হয়। প্রথম দিকে শ্রমিকরা অর্থনৈতিক দাবি নিয়ে লড়াইয়ের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলে। শ্রমিক শ্রেণির ধরন নানা রকম হলেও তাদের মূল স্বার্থ এক ও অভিন্ন। শ্রমিক শ্রেণি উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃষ্টি করে আর বুর্জোয়া শ্রেণি তা আত্মসাৎ করে, কারণ তা না করে বুর্জোয়া শ্রেণি বেঁচে থাকতে পারে না, গাছ যেমন পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না।
পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক শ্রেণি মজুরি-দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারে না। মূলত মুক্তিই শ্রমিক শ্রেণির আসল স্বার্থ। তাই তার বাস্তব অবস্থানই তাকে শ্রেণি-সংগ্রামের দিকে নিয়ে যায়। পুঁজিবাদী সমাজের মূল দ্বন্দ্ব হচ্ছে শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্ব, শ্রমিক শ্রেণি ও পুঁজিপতি শ্রেণির দ্বন্দ্ব। রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে পুঁজিপতিদের উচ্ছেদ করে এই দ্বন্দ্বের অবসান করা সম্ভব। এই বিষয়টিই শ্রমিক শ্রেণিকে পার্টি করতে বাধ্য করে। এভাবেই গড়ে ওঠে শ্রমিক শ্রেণির নানা পার্টি। যেমন, ট্রেড ইউনিয়ন ও বিভিন্ন ধরনের সমিতি ও সোসিয়েল ডেমোক্রেটিক পার্টি। একটি কথা মনে রাখতে হবে শ্রমিক শ্রেণির পার্টি হলেই কমিউনিস্ট পার্টি হয় না।
শ্রমিক শ্রেণির সর্বোচ্চ চেতনাসম্পন্ন সদস্যদের নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে। তাদের কমিউনিস্ট দর্শন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ আত্মস্থ করার যোগ্যতা থাকতে হয়। এই বিষয়ে কোনো আপস নাই। এ জন্যই বলা হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে যারা চেতনায়, ত্যাগে ও কর্মে অগ্রসর তাদের পার্টি। কোনো সংস্কার নয়, শোষণের সমাজ আমূল বদলে দেয়াই কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য। একেই বলে বিপ্লব। তবে কোনো সময়ই শ্রমিক শ্রেণি ও কমিউনিস্ট পার্টিকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। আবার শ্রমিক শ্রেণির ভেতর থেকেই বেরিয়ে এসেছে কমিউনিস্ট পার্টি। এটাই পার্থক্য ও সম্পর্ক যাকে বলে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক।
১৮৪৭ সালে কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলস ‘কমিউনিস্ট লীগ’ গঠন করেন। এই পার্টি সর্বপ্রথম তার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে’। বুর্জোয়াদের ক্ষমতাচ্যুত করা এবং সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা পার্টির লক্ষ্য ঠিক করা হয়। জার্মান গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ১৮৫২ সালে মার্কস-এঙ্গেলস কমিউনিস্ট লীগ তুলে দেন। তারপর ঊনবিংশ শতাব্দির ষাটের দশকের গোড়ার দিকে মার্কস-এঙ্গেলসের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক গঠিত হয়। প্রথম আন্তর্জাতিকের মধ্যে কমিউনিস্ট লীগের সকল বৈশিষ্ট্যই ছিলো। কমিউনিস্ট লীগই শ্রমিক শ্রেণির প্রথম রাজনৈতিক পার্টি। এই পার্টি শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতাবাদী চেতনার বিকাশ করেছিলো।
তবে আধুনিক কমিউনিস্ট পার্টির রূপকার মহামতি লেনিন। বিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে তিনি এক ‘নতুন প্রকার পার্টির’ তত্ত্ব উপস্থিত করেন। আজকের পৃথিবীতে কমিউনিস্ট পার্টির নামে যেসব পার্টি তৎপর আছে সেগুলো এই নতুন রকমের পার্টির নীতি, আদর্শ ও কাঠামো অনুসরণ করে চলার চেষ্টা করে।
আমাদের এবং যারা নতুন হিসেবে পার্টি করতে ইচ্ছুক তাদের এসব বিষয় সুন্দর ও বিস্তারিতভাবে জানতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট
Login to comment..