মার্চের উত্তাল দিনগুলি ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আকমল হোসেন

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
১৯৭১ সালের মার্চ মাস, নানা ঘটনা আর দুর্ঘটনার কারণে সবার নিকটই স¥রণীয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ২ ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ এবং ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পাকিস্থানী বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড এবং ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ (এম, এন, এ) নির্বাচন এবং ডিসেম্বরে প্রাদেশিক পরিষদের (এম, এল, এ) নিবার্চন অনুষ্ঠিত হলেও সরকার গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে আহ্বান জানানো হয়নি। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজয়ী দলের নেতা হিসেবে ৬ দফা ভিত্তিক কর্মসূচির আলোকে শাসনতন্ত্র রচনার কথা ব্যক্ত করেন এবং ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে পরামর্শ দেন। ৬ দফার প্রশ্নে শেখ মুজিবকে নমনীয় করার জন্য, জেনারেল ইয়াহিয়া পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভূট্টোকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। পরিস্থিতির অগ্রগতি না হওয়ায় ভূট্টো ঢাকা ত্যাগ করেন। ইয়াহিয়া খান ১৩ ফেব্রুয়ারির পরে ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন ডাকার ঘোষণা দেন। জুলফিকার আলী ভূট্টো ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের বিরোধিতা করেন। ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি ভূট্টো ও ইয়াহিয়া গোপন বৈঠক করে ১ মার্চ ঘোষণা দিয়ে ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে বাঙালিদের পক্ষ থেকে অসহোযোগ আন্দোলনের ডাক আসে। ২ ও ৩ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালিত হয়। সারাদেশে লাগাতার মিছিল, মিটিং, সমাবেশ, পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়ে ইয়াহিয়া খান তদানীন্তন গভর্নর আহসানের পরিবর্তে টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করে পাঠান। কিন্তু অসহযোগ আন্দোলন চরম আকার ধারণ করায় হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ করাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ: অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব:- নির্বাচনী ফলাফলের প্রতি পাকিস্তানী শাসক কর্তৃক অসম্মান প্রদর্শন এবং নানা টালবাহানার কারণে আওয়ামী লীগ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা আহ্বান করে। জনসভায় শেখ মুজিব বাঙালি জাতিকে যা কিছু আছে তাই নিয়েই স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহ্বান রেখে ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য নিম্নলিখিত কর্মসূচি ঘোষণা:- (ক) সব ধরনের অফিস আদালত বন্ধ রাখা (খ) স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা (গ) খাজনা এবং কর না দেওয়া (ঘ) কলকারাখানার উৎপাদন বন্ধ রাখা। জেনারেল ইয়াহিয়া আহুত ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের যোগদানের শর্ত হিসেবে জনসভা থেকে নিম্ন লিখিত শর্তারোপ করা হয়:- ১। অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে ২। অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে ৩। সামরিক বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। ৪। জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের (২৫ মার্চ) পূর্বেই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। ৯ মার্চ মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপের জনসভা হয় পল্টন ময়দানে। বিশাল জনসভায় মাওলানা ভাসানী মুজিবের দাবিকে সমর্থন করেন এবং স্বাধীনতার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। যদিও মাওলানা ভাসানী ন্যাপসহ নিষিদ্ধঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টি অনেক পূর্ব থেকেই স্বাধীনতার কথা বলে আসছিল। ২ মার্চ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় “স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ”, যার নেতা নির্বাচিত হন ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে নুরে আলম সিদ্দিকী ও শাহজাহান সিরাজ এবং ডাকসুর সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে আ, স, ম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন ডাকসুর ভিপি আ, স, ম আব্দুর রব। স্বাধীনতার প্রশ্নে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলি যেমন ছাত্র ইউনিয়ন ও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। ছাত্র ইউনিয়ন ৭ মার্চ থেকে স্বাধীনতার প্রস্তুতিস্বরূপ সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করে। সেটা অব্যাহত রাখা হয়। প্রতিদিন সকাল ৮টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে সামরিক প্রশিক্ষণ এবং ১১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জনগণের প্রতি প্রতিরোধ বাহিনীর কৌশল শিক্ষার জন্য সমাবেশ করতো। ১১ মার্চ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমন্ডলীর সভায় শোষণমুক্ত পূর্ববাংলা গঠনের জন্য দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের প্রস্তুতিতে নিম্নলিখিত কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১। ঢাকা শহরে প্রতিদিন সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে জঙ্গি কর্মীবাহিনীর প্যারেড। ২। ১২ মার্চ শুক্রবার বিকাল ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে পথসভা ও মিছিলের মাধ্যমে জনগণকে সংগ্রামে উদ্দীপ্তকরণ। ৩। ১৩ মার্চ শনিবার সন্ধ্যা ৬ টায় বায়তুল মোকাররম থেকে মশাল মিছিল বের হবে। ৪। ১৪ মার্চ বায়তুল মোকারমে জনসভা। এছাড়াও সারাদেশে নিম্নলিখিত কর্মসূচি পালনে সকল জেলা ও প্রাথমিক শাখাকে নির্দেশ প্রদান করে। নির্দেশসমূহ ছিল:- (১) সর্বাত্মক রাজনৈতিক প্রচার (২) জনগণকে নিয়ে সংগ্রাম কমিটি ও গণবাহিনী গঠন (৩) গ্রাম্য কৃষকদের মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া (৪) বৃহত্তম ও দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য “যার যা আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ”। (৫) জঙ্গি ও সাহসী কর্মী বাহিনীর সমন্বয়ে নিয়ন্ত্রিত প্যারেড অনুষ্ঠান। পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ১৫ মার্চ কর্মীদের মধ্যে এক গোপন সার্কুলার জারি করে। পূর্ব বাংলার সর্বশেষ অবস্থার আলোকে সশস্ত্র লড়াই ও বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সার্কুলারে আরও বালা হয়, সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়, সে কারণেই নিজস্ব উদ্যোগে সশস্ত্র হতে হবে জাতিকে, “জাতীয় শত্রু খতম কর” এই স্লোগানে গ্রামে গ্রামে সর্বপ্রথম স্বাধীন সরকার ঘোষণার আহ্বান জানানো হয়। স্থানীয় ও সামন্তবাদী শোষকদের শোষণ বন্ধ করা। বর্তমান অবস্থায় আওয়ামী লীগের বিরোধিতা না করে এবং সামন্তবাদী গোষ্ঠীকে আক্রমণ না করেই কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে। ১৪ মার্চ বায়তুল মোকাররমে সমাবেশ ও পরে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্র ইউনিয়ন। তখন বেসামরিক প্রশাসন মূলতঃ শেখ মুজিবের কথায় চলছিল। ১৬ মার্চ ছাত্র ইউনিয়ন এক বিজ্ঞপ্তিতে মণি সিংহসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি দাবি, সামরিক আইনে দায়েরকৃত সকল মামলার প্রত্যাহারের নির্দেশ প্রদানের জন্য শেখ মুজিবের প্রতি আহ্বান জানান। ১৯ মার্চ জয়দেবপুর (গাজীপুর জেলা) সামরিক কর্তৃপক্ষ ১ ব্যাটেলিয়ন (৭০০ জন) বাঙালি সৈন্যকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিলে সৈন্যরা তা প্রত্যাখ্যান করে। বাঙালি সৈন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ঢাকা থেকে পাঞ্জাবী সৈন্যরা জয়দেবপুরে মার্চ করে। এ খবর এলাকায় প্রচার হওয়ার পরে আওয়ামী লীগ নেতা ও জাতীয় পরিষদ সদস্য শামসুল হকের নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ বিদ্রোহী বাঙালি সৈন্যদের পক্ষে সংগ্রামে নামে, রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। দুই পক্ষের সশস্ত্র সংঘর্ষে ২০ জন মারা যান। এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। ১৯ মার্চ রাজধানী ঢাকাতে ঘটে আরেকটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। এ দিন ছাত্র ইউনিয়নের শত শত নেতাকর্মী (এদের মধ্যে মেয়ে কর্মীও ছিল) রাজপথে ডেমি রাইফেল নিয়ে মার্চ-পার্চ করে। এর থেকে মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগ্রামে আরও সাহস পায়। ১০ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে এই কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। ২১ মার্চ থেকে দ্বিতীয় ব্যাচে, ১২ প্লাটুনে (১ প্লাটুন=৩৫ জন) বিভক্ত হয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ২১ মার্চ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে গঠিত স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের স্ব স্ব শাখাকে প্যারেডের প্রস্তুতি নিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ২১ মার্চ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াকত হলে বিকাল ৪টায় সকল নেতাকর্মীকে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানায়। এরই মধ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া ঢাকা এসে ১১ মার্চ, ২০ মার্চ, ২১ মার্চ শেখ মুজিবের সাথে আপস মীমাংসার জন্য বৈঠকে বসে কিন্তু ইতিবাচক কোনো অগ্রগতি ঘটেনি। মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার আলোকে ২১ মার্চ পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভূট্টো ১৫ সদস্যের এক প্রতিনিধি দলসহ ঢাকা আসেন। ২১-২৪ মার্চ ৪ দিনব্যাপী মুজিব-ইয়াহিয়া ও ভূট্টো ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১২ তারিখের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চের পূর্ব ঘোষিত জাতীয় পরিষদ সভা স্থগিত ঘোষনা করে ঢাকা ত্যাগ করেন। সেই রাতেই পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী নিরীহ ঘুমন্ত মানুষের ওপর চালায় ইতিহাসের নিকৃষ্টতম হত্যাযজ্ঞ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চালায় হত্যাকাণ্ড। সেই ২৫ মার্চ বাংলাদেেেশর ইতিহাসে কালো এবং শোকাহত দিন হিসেবে পরিচিত। রাতের পরে দিন আসে যেমন সত্য তেমনি ২৫ তারিখের কালো দিবসের পর ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। উত্তাল মার্চ বাঙালিদের জন্য যেমন দুঃখের একইসঙ্গে আনন্দেরও। কারণ, এই মাসেরই ১৭ তারিখ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম দিবস। লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাকবিশিস

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..