একাত্তরের উত্তাল মার্চে কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর কমিউনিস্ট পার্টি তার কর্মীদের জানিয়ে দিয়েছিল যে ‘এটি ছিল আরো বৃহত্তর সংগ্রামের একটি ড্রেস রিহার্সেল মাত্র’। পার্টি আরও জানিয়ে দিয়েছিল যে ‘সশস্ত্র সংগ্রাম এখন এজেন্ডায় চলে এসেছে’। এর কিছুদিন আগে ১৯৬৮ সালে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্টরা ‘প্রাদেশিক সম্মেলনে’ মিলিত হয়ে তাকে পার্টির ‘প্রথম কংগ্রেস’ হিসাবে ঘোষণা করে স্বাধীন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেছিল (আগে কেন্দ্রীয় কমিটি ছিল সর্ব-পাকিস্তান ভিত্তিক)। পার্টি কংগ্রেসে সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণা করে এবং সেই লক্ষ্যে স্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদনের রণনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে এভাবে সুনির্দিষ্ট কর্তব্যরূপে মূর্ত করা হয়েছিল।
তবে একথাও সত্য যে, স্বাধীনতার সংগ্রাম সামনে চলে আসবে একথা কমিউনিস্ট পার্টির হিসাবে থাকলেও, তা যে এতো দ্রুত শুরু হয়ে যেতে পারে সে বিষয়ে পার্টির ধারণা স্পষ্ট ছিল না। বরং ধারণাটা ছিল এমন যে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও স্বাধীনতা একই সাথে আসবে। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের শর্ত পরিপক্ক হওয়ার আগেই যে স্বতন্ত্রভাবে যে স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি চলে আসতে পারে সে বিষয়টি আগে থেকে পার্টির হিসাবে ছিল না। ঘটনাবলী যখন শেষ পর্যন্ত সেই রূপেই মূর্তমান হয়, পার্টিকে দ্রুত তার চিন্তা ও কার্যক্রম ঢেলে সাজিয়ে তাতে নতুন উপাদান সংযোজন করতে হয়েছিল। স্বাধীনতা ও সশস্ত্র সংগ্রামের ধারায় খুব তাড়াতাড়ি সে তা করতে সক্ষম হয়েছিল। এটা ছিল কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের কৃতিত্ব ও দক্ষতার একটা প্রমাণ।
‘৭১-এর শুরুতেই ছাত্র ইউনিয়ন বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করে সংগঠনের ঘোষণাপত্রে বাঙালিসহ পাকিস্তানের সব ভাষাভাষি জাতির জন্য বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারসহ পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি অন্তর্ভুক্ত করেছিল। একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারির কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশে ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা বক্তৃতা করে পাকিস্তানের শাসকদের এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল যে, নির্বাচনের রায় বানচালের চেষ্টা করা হলে “স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে ‘পূর্ব পাকিস্তানে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র’ গঠন করে” গণরায় বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা হবে।
স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে পরিস্থিতি অগ্রসর হবে একথা মনে রেখে ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি প্রচারণা ও এ্যাজিটেশন বাড়িয়ে দিয়েছিল। বহু বছর পর আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা গোপন কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে জনগণের মাঝে হাজার হাজার ইশতেহার প্রচার করা হয়েছিল। সত্তরের নির্বাচনে ন্যাপ (মোজাফ্ফর) প্রায় সব আসনে প্রার্থী দিয়ে তাদের প্রগতিশীল বক্তব্য তুলে ধরেছিল। ... কিন্তু বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের প্রত্যাশায় জেগে ওঠা দেশবাসী এবার একটি একক দলকে বাঙালির মুখপত্র হিসেবে ম্যান্ডেট দেয়ার জন্য উদগ্রীব ছিল। ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা মামলা ইত্যাদি ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে পূর্ববর্তী ৪/৫ বছরে শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগ স্বাধিকারের প্রশ্নে চ্যাম্পিয়ন হিসাবে ভাবমূর্তি ও শক্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। সেই নেতা ও দলের পক্ষে ম্যান্ডেট দেয়ার জন্য মানুষ মন স্থির করে ফেলেছিল। ... প্রায় সব আসনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল। ন্যাপ (ভাসানী) ও চীনপন্থী কমিউনিস্টরা ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো’ বলে নির্বাচন বয়কট করায় তা শেখ মুজিবের পক্ষে একক ম্যান্ডেট পাওয়াকে আরো সহজ করে দিয়েছিল। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিচালিত কাজকর্মের পাশাপাশি কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা রুটি-রুজির দাবি, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দাবি, সমাজতন্ত্রের শ্লোগান ইত্যাদি নিয়ে সংগ্রাম ও প্রচারণা অব্যাহত রাখায় চলমান জাতীয় আন্দোলন ও গণআন্দোলনের ধারা ক্রমাগতভাবে র্যা ডিক্যালাইজড হতে থাকে।
সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য কর্মীদেরকে মানসিকভাবে তৈরি করার কাজেও তারা হাত দেয়। গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে তথ্য ও বইপত্র সংগ্রহের চেষ্টা শুরু হয়ে যায়। কিভাবে মলোটভ ককটেল তৈরি করতে হয়, বুবি-ট্র্যাপ দিয়ে কীভাবে শত্রুকে ঘায়েল করতে হয়, প্যারি-কমিউনের সময় ফ্র্যান্সে কীভাবে ব্যারিকেড যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, ভিয়েতনামে কীভাবে গেরিলা যুদ্ধ চলছে– এসব নিয়ে অনুসন্ধান-আলোচনা বেড়ে গিয়েছিল।
একাত্তরের ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান সদ্য নির্বাচিত জাতীয় সংসদের ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য প্রথম অধিবেশনের নির্ধারিত বৈঠক স্থগিত করে দিলে, দেশবাসী চাবি দেয়া স্প্রিং-এর মতো মুহূর্তের মধ্যেই স্বাধীনতার শ্লোগান নিয়ে রাজপথে নেমে পড়েছিল। শুরু হয়ে গিয়েছিল মার্চের রক্তঝরা প্রতিরোধ, অসহযোগ ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির অধ্যায়। আওয়ামী লীগ ঐক্য গড়ার বদলে ‘একলা চলার নীতি’ নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল। সে কারণে কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা অবশ্য ঘরে বসে থাকে নি, বরং মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাস্তব প্রস্তুতি কাজে প্রবল শক্তি ও দৃঢ়তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সংসদে একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়ায়, আওয়ামী লীগ ও তার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর হাতেই স্বাভাবিক কারণে চলে এসেছিল জনগণ ও প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ প্রদানের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধুই কার্যত হয়ে উঠেছিলেন অঘোষিত রাষ্ট্র পরিচালক। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে গোটা জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনসহ যে মহাজাগরণের অধ্যায় রচনা করেছিল, বামপন্থিরা তাদের সব শক্তি দিয়ে সে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির অনেক আত্মগোপনকারী নেতা প্রকাশ্য ও আধা-প্রকাশ্য হয়ে কাজ করা শুরু করেছিলেন।
১ মার্চ থেকে, একমাত্র কারফিউ-এর দিন ছাড়া, ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র-গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো। সেখানে চলতি ঘটনাবলী ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফিং-এর ব্যবস্থা করা হতো। প্রাত্যহিক এসব সমাবেশে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের সাথে সাথে ন্যাপের নেতারাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা করতেন। প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ তাদের কথা শুনতে আসতো। সারা দেশে তারা এ ধরনের আম জনতার জন্য ব্রিফিং-এর কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। পল্টন ময়দানে বড় জনসভা করেও মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় বার্তা পৌঁছে দেয়া হতো। বামপন্থিদের নিজেদের শক্তি সংহত করতে এবং স্বাধীনতার জন্য জাতির সব শক্তির ঐক্য সুদৃঢ় রাখতে এই কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
১ লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করার সাথে সাথে স্বাধীনতা ও তার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রসঙ্গটি আশু ও তাৎক্ষণিক করণীয় হিসাবে সামনে চলে এসেছিল। সশস্ত্র সংগ্রাম একটা সিরিয়াস বিষয়, যার জন্য প্রয়োজন সিরিয়াস ধরনের প্রস্তুতি ও কাজ। এটা শুধু শ্লোগান ও ভাবাবেগ দিয়ে পরিচালিত হয় না। বামপন্থিরা সেই বাস্তব কাজে দ্রুত হাত দিয়েছিল। তারা অত্যাসন্ন মহাসংগ্রামকে রাজনৈতিকভাবে পরিচালনার জন্য উপযুক্তভাবে সংগঠনকে সাজানো এবং একইসাথে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার জন্য তরুণ কর্মীদের দ্রুত প্রশিক্ষিত ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। দ্বিতীয় কাজে ছাত্র ইউনিয়ন একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এক বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করা হয়েছিল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র সংগ্রামপরিষদের ঐক্য না এগিয়ে নিয়ে ছাত্রলীগ এককভাবে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে কলা ভবন, মধুর ক্যান্টিন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ– এসব এলাকাকে তাদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সাইন্স এ্যানেক্স ভবনের বলাইয়ের ক্যান্টিন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠকে কেন্দ্র করে ছাত্র ইউনিয়ন তার কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়েছিল।
১০ মার্চ থেকে ছাত্র ইউনিয়ন সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য সচেতন কর্মী ও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিয় ‘গণবাহিনী’ গঠনের কাজ শুরু করেছিল। ২০ জন করে সদস্য নিয়ে প্রয়াত বিপ্লবী ও শহীদদের নামে একেকটি করে ব্রিগেড গঠন করা হয়েছিল। এসব ব্রিগেডকে রাজনৈতিক দায়িত্ব দেয়ার পাশাপাশি প্রাথমিক ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছিল। ডামি রাইফেল সংগ্রহ করে প্রতিদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে এসব ব্রিগেডের শত শত ছাত্র-ছাত্রী সদস্যকে অস্ত্র চালনার পদ্ধতি ও বিভিন্ন হোল্ডিং পজিশন ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। ২০ মার্চ ঢাকার রাজপথে ডামি রাইফেল কাঁধে কয়েকশ ছাত্র-ছাত্রীর আনুষ্ঠানিক প্যারেড সংগঠিত হয়েছিল। হাজার হাজার পথচারী দু’পাশে দাঁড়িয়ে এই প্যারেডকে উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন জানিয়েছিল। পরদিনের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে রাইফেল হাতে তরুণ-তরুণীদের ছবিসহ ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক সংগঠিত এই ভবিষ্যৎ মুক্তিযোদ্ধাদের সুশৃঙ্খল প্যারেডের খবর প্রকাশিত হয়েছিল। ‘গণবাহিনীর’ এরূপ একটি বাস্তব প্রদর্শন দেশবাসীর চিন্তা জগতকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে এগিয়ে নিয়েছিল। এর পরে পরেই ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় এ ধরনের ব্রিগেড গঠন ও তাদের সামরিক প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হয়েছিল। ছাত্রলীগও দু’চার দিনের মধ্যে এ ধরনের কাজের অনুসারি হয়েছিল।
শুধু কুচকাঁওয়াজ শিক্ষাই নয়, কয়েকটি সত্যিকার রাইফেল ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রও সংগ্রহ করা হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির দক্ষ পরিচালনায় বাছাই করা কর্মীদের জন্য লাইভ ফায়ারিং-এর প্রশিক্ষণও শুরু করা হয়েছিল। প্রতিদিন বিকেলে ছোট ছোট দলকে ঢাকার অদূরে জনবসতিহীন এলাকায় নিয়ে গিয়ে লাইভ বুলেটসহ রাইফেল ফায়ার করে হাতে-কলমে অস্ত্র চালনার অভিজ্ঞতা দেয়া শুরু হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উঁচু ক্লাসের কিছু মেধাবী ছাত্রদের দিয়ে ‘বিশেষ বোমা স্কোয়াড’ গঠন করে তাদেরকে বিস্ফোরক বানানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ল্যাবরেটরি থেকে কেমিক্যাল চুরি করে এনে তারা বিস্ফোরক তৈরি করে। মধ্য মার্চের পর তারা নিজেদের তৈরি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছিল। এদিকে, মলোটভ ককটেল, বুবি ট্র্যাপ ইত্যাদি কীভাবে তৈরি ও ব্যবহার করতে হয়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মাইক থেকে সে বিষয়ে প্রতিদিন গণপ্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো।
মার্চের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা মিলে ঢাকা শহরকে সেনা আক্রমণ থেকে রক্ষা করার একটা পরিকল্পনা তৈরি করেছিল। যে সব বিষয়কে এখন একেবারেই ছেলেমানুষী মনে হবে, সে ধরনের কিছু প্ল্যান নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সৈনিকরা শহরের দিকে আসতে শুরু করলে, রাস্তার পাশের সব বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে তাদের উপর মরিচের গুড়া ও ভাতের ফ্যান নিক্ষেপ করে নাজেহাল করা, রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে তাদের অগ্রগতি রোধ করা, মলোটভ ককটেল দিয়ে ট্যাংক বাহিনীর উপর আত্মঘাতী হামলা চালানো, রাস্তা কেটে ট্যাংক ও সেনা বহনকারী যানের চলাচল আটকে দেয়া ইত্যাদি নানা পরিকল্পনা। এসবকে এখন খুব হালকা বলে মনে হলেও, এসব প্রস্তুতির পেছনে যে সিরিয়াসনেস ছিল, তা স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রশ্নে কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের সে সময়কার আত্মপ্রত্যয়ী দৃঢ়তার প্রমাণ বহন করে। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে সামনে সময় কম, যে কোনো সময় শুরু হয়ে যেতে পারে সশস্ত্র সংগ্রাম। অন্য কেউ এসে স্বাধীনতা এনে দেবে না, আমাদেরকেই লড়াই করে তা ছিনিয়ে নিতে হবে। কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা এসব বুঝতো। তাই বাস্তব প্রস্তুতিতে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল।
আদমজি, ডেমরা, পোস্তগোলা, টঙ্গীসহ শিল্প এলাকাগুলোতে শ্রমিকদের ব্রিগেড গড়ার প্রচেষ্টাও একই সাথে এগিয়ে নেয়া হয়েছিল। কৃষক আন্দোলনের সংগঠিত এলাকাগুলোতেও ভলেন্টিয়ার সংগ্রহের কাজ শুরু করা হয়েছিল। ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে পাকিস্তান সরকারের কর্তা-ব্যক্তিরা এবং জাঁদরেল রাজনীতিবিদরা অবস্থান করতেন। সেখানকার ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদেরকে তাদের কথাবার্তা-আলাপচারিতা আড়ি পেতে শুনে তার বিবরণ কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে বলা হয়েছিল। অনেক গোপন খবরা-খবর এভাবে সংগ্রহ করা হতো। কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের পরিচালনায় ঘুম হারাম করে সর্বশক্তি দিয়ে সর্বত্র চলছিল স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের দ্রুত প্রস্তুতি নেয়ার কাজ।
এসব আয়োজন চলতে চলতে নেমে আসে ২৫ মার্চের কালো রাত্রির আঘাত। আধুনিক পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সর্বাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে পরিচালিত বর্বর অভিযান ও নির্বিচার গণহত্যার মুখে একথা তৎক্ষণাৎ স্পষ্ট হয়ে যায় যে, হানাদার বাহিনীকে রুখতে হলে আরো উন্নত, দক্ষ ও পেশাদারী বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। সূচনা করতে হবে ‘সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ’। বামপন্থিরা ক্ষয়-ক্ষতি বাঁচিয়ে শক্তি রিগ্রুপ করার মাধ্যমে যথাসম্ভব সংগঠিতভাবে নতুন ধরনের কাজের জন্য নিজেদেরকে গুছিয়ে নিতে স্বক্ষম হয়েছিল।
এর পরেই শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের মূল পর্ব। এই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল ৯ মাস ধরে। কে ছিল মুক্তিযুদ্ধের আসল নায়ক? সত্য হলো- মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়ক ছিল ‘জনগণ’। তবে রাজনৈতিক শক্তির অবদানও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর অবদানের পাশাপাশি কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের অবদানও ছিল অনন্য। মুক্তিযুদ্ধের এই ৯ মাসে সামরিক এ্যাকশন সম্পর্কিত বিষয়গুলো ছিল কেন্দ্রীয় কর্তব্যের প্রধান বিষয়। কিন্তু রাজনৈতিক সচেতনায়ন, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, অস্থায়ী সরকার পরিচালনা, জনগণকে সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ ও উদ্দীপ্ত রাখা ইত্যাদি কাজগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। উভয় ক্ষেত্রেই কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের অবদান ছিল অগ্রগণ্য। তাদের সেসব কাজের বিবরণ আরও দীর্ঘ ও বিস্তৃত। একথা সত্য নয় যে আওয়ামী লীগ ছিল মুক্তিযুদ্ধের একক নায়ক। আওয়ামী লীগের ভূমিকাকে ছোট না করেই বলা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধে দেশের কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা কৃতিত্বপূর্ণ ও গৌরবদীপ্ত ভূমিকা পালন করেছে। তারা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক। মোট কথা, কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের অবদান ও ভূমিকাকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয়ে থাকে খণ্ডিত। তা ইতিহাস বিকৃতিরই একধরনের অপচেষ্টা। মুক্তিযুদ্ধে দেশের কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের অবদানকে যারা আড়াল অথবা অস্বীকার করতে চায় তাদেরকে ফন্দিবাজ ইতিহাস বিকৃতিকারী ছাড়া অন্য কিছু বলে চিহ্নিত করা যায় না!
Login to comment..