৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির লাল পতাকা মিছিল [ ছবি: রতন কুমার দাস ]একতা প্রতিবেদক :
‘দ্বি-দলীয় রাজনীতি যখন কেনাবেচা, আখের গোছানো, নোংরা খেলা, সেখানে নীতির প্রশ্নে আপসহীন থেকে শ্রমিক-কৃষক, মেহনতি মানুষের পার্টি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ‘মানুষ ও প্রকৃতির মুক্তির’ লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকশ্রেণিসহ মেহনতি মানুষের নেতৃত্বেই গণসংগ্রাম গড়ে তুলে ক্ষমতায় যাবে সিপিবি।’
গত ৬ মার্চ সিপিবি’র ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বছরব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধনী সমাবেশে নেতৃবৃন্দ উক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।
এদিন বিকাল ৪টায় রাজধানীর পুরানা পল্টনে পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সিপিবি সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ। উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য শাহীন রহমান, অধ্যাপক এ এন রাশেদা, সাবেক সভাপতি, কেন্দ্রীয় সদস্য মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাজ্জাদ জহির চন্দন, লক্ষ্মী চক্রবর্তী, অনিরুদ্ধ দাশ অঞ্জন, আব্দুল্লাহ আল ক্বাফি রতন, আহসান হাবিব লাভলু, জলি তালুকদার, ডা. দিবালোক সিংহ, ডা. সাজেদুল হক রুবেল, লুনা নূর, অ্যাড. সোহেল আহমেদ, অ্যাড. মাকসুদা আকতার লাইলি, রাগিব আহসান মুন্না, অ্যাড. আনোয়ার হোসেন রেজা, লাকি আকতার, আবিদ হোসেন, অ্যাড. আইনুন নাহার লিপি, কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যান মাহাবুব আলম, সদস্য অধ্যাপক ডা. এম এ সাইদসহ পার্টির শত শত প্রবীণ, নবীন নেতাকর্মীরা।
সমাবেশে পার্টির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সিপিবি সবচেয়ে আপসহীন ও মেহনতি মানুষের স্বার্থে যোগ্য রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আর এই শক্তি ও দৃঢ়তা অর্জন করেছে তার ৭৫ বছরের লড়াই-সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে।
তিনি বলেন, বেআইনি থাকার পরেও পাকিস্থানের দীর্ঘ শাসন ও শোষণবিরোধী লড়াইয়ে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ছিল কিংবদন্তিতুল্য। ঐ সময় নানাভাবে কমিউনিস্টদের হত্যা করা হয়। ১৯৫০ সালে ২৪ এপ্রিল রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে কমিউনিস্ট রাজবন্দিদের নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়, যা ছিল প্রথম জেল হত্যা। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন, দুর্নীতি-লুটপাট রুখে দাঁড়াতে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জাতীয় সম্পদ রক্ষা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনসহ দেশের সকল শ্রেণিপেশার আন্দোলনে সিপিবি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
এ দেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, প্রকাশনা, গণমাধ্যম, পেশাজীবী আন্দোলন, সেক্টরভিত্তিক শ্রমিক আন্দোলন, পরিবহন শ্রমিক আন্দোলনসহ নানা আন্দোলন ও সৃজনশীল কর্মে কমিউনিস্ট পার্টির রয়েছে নেতৃত্বের ভূমিকা। শান্তি আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, যুব আন্দোলন, কৃষক ও ক্ষেতমজুর আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন, শিশু-কিশোর আন্দোলন, দাঙ্গাবিরোধী গণআন্দোলনসহ সকল আন্দোলনকে সিপিবি একসূত্রে বাধতে সমর্থ হয়েছিলো।
নানা সংকটের মধ্যেও আদর্শবাদী ও শ্রেণিভিত্তিক পার্টি হিসেবে সিপিবি তার আন্দোলন ও লড়াই সংগ্রামের ধারাকে অব্যাহত রেখেছে বিগত ৭৫ বছর ধরে। হাজার হাজার কমরেডের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকে এই স্বাধীন স্বদেশ আমরা পেয়েছি। বিশ্বব্যাপী সকল শোষণ ও বঞ্চনা ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধেও সিপিবি বরাবরই সরব থেকেছে।
তিনি বলেন, পুঁজিবাদ আজ ব্যর্থ, যুদ্ধ ছাড়া তারা আজ বাঁচতে পারছে না। ভবিষ্যৎ পৃথিবী সামজতন্ত্র ও সাম্যবাদের।
‘এরশাদ স্বৈরাচারের পতন হয়েছে ৩২ বছর। আওয়ামী লীগ-বিএনপি বারবার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু দেশে গণতন্ত্র আসেনি, দেশ সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হয়নি, দেশে ধনবৈষম্য-শ্রেণি বৈষম্য পর্বতপ্রমাণ। দেশ ৫ এবং ৯৫ এ ভাগ হয়ে গেছে। দেশে দুটি অর্থনীতি চলছে। একটা গরিবের আরেকটা ধনীর।
‘আমাদের দেশের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। আমাদের রাজনীতিতে তারা প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ করছে।
‘কমিউনিস্টরা-কমিউনিস্ট পার্টি, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, ভোট ও ভাতের জন্য লড়াই করছে। দেশের জনগণের মুক্তির জন্য যত নির্যাতন আসুক ব্যবস্থা বদল, গণতন্ত্র কায়েম, বিকল্প গড়ার লড়াই কমিউনিস্ট পার্টি অব্যাহত রাখবে, জোরদার করবে।’
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলাবাহিনীর সার্বিক কার্যক্রম মুক্তিযুদ্ধে এনেছিল নতুন এক মাত্রা, যা জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে আজও স্মরণ করে।
আজকের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বি-দলীয় লুটপাট ও ক্ষমতাকেন্দ্রীয় ভাগ-বাটোয়ার ধারার বিপরীতে সিপিবি আদর্শের ঝান্ডা নিয়ে অন্যান্য বামপন্থীদের নিয়ে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি যখন কেনাবেচা, আখের গোছানো, নোংরা খেলা, সেখানে নীতির প্রশ্নে আপসহীন কমিউনিস্ট পার্টি।
তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ লুটপাটের এক মহোৎসব সৃষ্টি করেছে। জনগণ দুঃশাসনে অতিষ্ট, ন্যূনতম ভোটের অধিকার হরণ করা হয়েছে। মানুষের প্রকৃত আয় কমলেও মূল্যবৃদ্ধি দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করলেও, অন্যদিকে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা করে কিছু মানুষ বিদেশে লক্ষ কোটি টাকা পাচার করছে। কিন্তু তার কোনো বিচার নাই। তথাকথিত কাঠামোগত উন্নয়ন (যার ভেতরে ভরপুর দুর্নীতি) দিয়ে মানুষকে একটি কাল্পনিক উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখাতে তারা পটু। অন্যদিকে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি তার বিগত দিনের দেওলিয়াপনা আজও ঘুচাতে ব্যর্থ। তাছাড়া জামাতসহ সাম্প্রদায়িক দলগুলো বরাবরের মতই একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্নেই বিভোর। এ সুযোগে বিরাজনীতিকরনের শক্তি মাথা ছাড়া দিয়ে উঠছে।
তিনি আরও বলেন, এই সার্বিক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সিপিবি একটি বিকল্প রাজনৈতিক বলয় গড়তে নীতিনিষ্ঠ জায়গা থেকে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই সংগ্রামে সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। নীতিহীন শক্তিকে ‘না’ ও নীতিনীষ্ঠ শক্তিকে ‘হ্যাঁ’ বলতে হবে।
তিনি সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেয়া, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন এর দাবি জানান।
৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সিপিবি নেতৃবৃন্দ এ দেশের সকল নির্যাতিত ও মেহনতি মানুষকে লাল পতাকাতলে সমবেত হবার আহ্বান জানান। নেতৃবৃন্দ বছরব্যাপী সারাদেশে নানামুখী কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
সমাবেশ শেষে একটি বর্ণাঢ্য লাল পতাকা মিছিল পুরানো পল্টন, দৈনিক বাংলা, মতিঝিল, দিলকুশা, গুলিস্তান হয়ে পার্টি কার্যালয়ে এসে শেষ হয় ।
সমাবেশের পূর্বে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন যথাক্রমে সিপিবি সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। এ সময়ে জাতীয় সংগীত, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল পরিবেশন করা হয়। এর আগে গণসংগীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীবৃন্দ।
৭৫তম প্রতিষ্ঠা দিবসে আজ ঢাকার বিভিন্ন থানাসহ সারাদেশের জেলা সদর ও উপজেলা, থানায় পার্টি কার্যালয়ের সামনে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সমাবেশ-র্যা লি অনুষ্ঠিত হয়।