বারী জোয়ার্দার চাচাকে যেমন দেখেছি
আকমল হোসেন
‘নয়নসমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই’–
প্রবীণ রাজনীতিক আব্দুল বারী জোয়ার্দার। আমার মতো অনেকের কাছে তিনি বারী চাচা নামে পরিচিত এবং সম্মানিত। একসময় আমরা যারা বিদ্যমান পাঠশালার গতানুগতিক পাঠের বাইরে অপ্রাতিষ্ঠানিক পাঠশালায় মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্নে ঐক্য শিক্ষা শান্তি প্রগতির পতাকাবাহী কাফেলায় যুক্ত হয়েছিলাম, তাদের সবার কাছেই তিনি ছিলেন শ্রদ্ধা ও সম্মানের ব্যক্তি। ১৯২৮ সালের ২০ মার্চ কুমারখালীর সদরপুর গ্রামের ফয়েজ উদ্দিন জোয়ার্দ্দার ও রূপজান বেগমের ঘরে জন্ম নেওয়া শিশুপুত্র বারীই পরে বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির অঙ্গনে স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত, সমাদৃত ও সম্মানিত হয়েছিলেন। ২০২২ সালের ১৮ মার্চ এই প্রবীণ রাজনীতিকের চিরপ্রস্থান ঘটে। প্রকৃতির নিয়ম আর বয়সের মাপকাঠিতে এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যুই বলা যায়। তারপরও প্রিয়জনকে হারাতে মনে কষ্ট পাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। মৃত্যুর মাস দুয়েক আগে বারী চাচা টেলিফোন করেছিলেন। করোনা এবং শারীরিক সমস্যার কারণে সেসময় তিনি বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। আমি ঢাকায় থাকি, বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় লেখালেখি করি, সে কারণেই হয়তো বিভিন্ন বিষয় শোনার জন্য মাঝেমধ্যে টেলিফোন করতেন, আমিও মাঝে মাঝে করতাম। কুমারখালী গেলে দেখা করে আসতাম। ৯৪ বছর বয়সে তিনি পার্থিব জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান। তিনি একই সঙ্গে ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নাগরিক, দুটি কাল বা শতাব্দির সাক্ষী। পঁজিবাদী লুটেরা অর্থনীতি, সাম্রাজ্যবাদী তোষণনীতি, রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার, ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন পদ্ধতি আর অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থামুক্ত এবং মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন।
স্বপ্নের স্বদেশ গড়ার জন্য ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন বারী জোয়ার্দার। প্রাথমিক পর্যায়ে অন্যদের মতো তিনিও সফল হয়েছিলেন, কিন্তু নিজেদের শক্তি ও সংগঠনের মাধ্যমে সেই কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত না হওয়ায় স¦াধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন পর্যন্ত বেঁচে থেকেও দেখে যেতে পারলেন না তার স্বপ্নের বাংলাদেশ।
লেখাপড়ার হাতেখড়ি গ্রামের পাঠশালায়, তারপর জীবন সংগ্রামে নামেন, কর্মজীবনের প্রথমেই যোগদান করেন কুষ্টিয়ার মোহিনী মিলে শ্রমিক হিসেবে। সেখানে পরিচয় ঘটে মোহিনী মিল শ্রমিক আন্দোলনের নেতা প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা কমরেড শেখ রওশন আলীর সাথে। যোগ দেন শ্রমিক আন্দোলনে। নিজেসহ শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া আদায়ের আন্দোলন থেকে স্বপ্ন দেখেন শ্রমিকদের স্থায়ী মুক্তির। মানবমুক্তির মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে অংশগ্রহণ করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপে। সমাজ বিপ্লবের লড়াকু কাফেলা কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় বামপন্থি বিপ্লবীরা ন্যাপে কাজ করতেন। সেই সূত্রেই ১৯৬৭ সালে নিষিদ্ধঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসে ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। মোহিনী মিল মজদুর আন্দোলন করতে গিয়ে মালিকের রোষানলে পড়েছিলেন, জীবন-জীবিকা আর অধিকারের কথা বলতে গিয়ে মালিকপক্ষের মামলায় অন্য শ্রমিক নেতাদের মতো তারও এক বছরের জেল ও ১০টা বেত্রাঘাতের সাজা হয়েছিলো। এ আমলে বিচারে মৃত্যুদণ্ড থাকলেও শারীরিক নির্যাতন নেই, কিন্তু সে আমলেও সেটাও ছিলো। শ্রমিক নেতৃবৃন্দ, ন্যাপ ও নিষিদ্ধঘোষিত কমিউস্টি পার্টির নেতৃবৃন্দের পরামর্শে ঐ রায়ের বিরুদ্ধে করাচি হাইকোর্টে আপিল করা হয়। আপিলে ১০টি বেত্রাঘাত বাতিল হলেও কারাবাস ভোগ করতে হয় তাকে।
১৯৬৭ সালে মোহিনী মিলস মজদুর ইউনিয়ন গঠিত হলে বারী জোয়ার্দার সেটির নেতৃত্ব পর্যায়ের সাংগঠনিক কাজের সাথে যুক্ত হন, দায়িত্ব পালন করেন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের। এর আগে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়তে হক-ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠে। সারা দেশব্যাপী মিটিং মিছিল ক্যাম্পিংয়ের মধ্যেই খুলনার সমাবেশে আসেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। খুলনায় মুসলিম লীগের নেতৃত্বদানকারী খান-এ সবুর সমাবেশ ঠেকানোর হুমকি প্রদান করেন। সেদিন ভাসানীর সমাবেশ সফল করতে কুষ্টিয়া মোহিনী মিলস থেকে তিন শতাধিক শ্রমিক জমায়েত করার দায়িত্ব পালন করেন বারী জোয়ার্দ্দার।
বাংলাদেশে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হলে তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়। বামপন্থি নেতাকর্মীরা তাতে যোগদান করে দেশে ও দেশের বাইরে সংগঠিত হয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীতে বামপন্থিদের অংশগ্রহণে বাধার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু সততা, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা আর মানবমুক্তির সংগ্রাম করতেই যে রাজনৈতিক শক্তির জন্ম তারা কী করে ঘরে বসে থাকে? জাতির এই সংকটকালে বামপন্থিরা ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের নিয়ে গড়ে তোলে বিশেষ গেরিলা বাহিনী। বারী জোয়ার্দার দেশের মধ্যে থেকেই ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর একজন হিসেবে কাজ করতে থাকেন। কুমারখালী-খোকসা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ডাঁসার কমান্ডার লুৎফর রহমান তার ভাই জাহিদ চৌধুরী, বিরিকয়ার আব্দুল মাসুদ ফুল, দুর্গাপুরের খুশী বিশ্বাস, মহেন্দ্রপুরের আব্দুল বারী খান, চাপড়া ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান কেরু মিয়ার ছেলে ঝন্টু প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের পর জাতীয় দাবি জাতীয় সরকার গঠনের দাবি উপেক্ষিত হলেও বামপন্থিরা বঙ্গবন্ধুর সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন দেন। তারই আলোকে ১৯৭৪ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, অন্যদিকে প্রবল বন্যায় ফসলহানি, আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গঠন করা গণবাহিনীও জাসদের সরকারবিরোধী তৎপরতা এবং সরকার সমর্থিত লুটেরা ব্যবসায়ীদের মুনাফামুখী অপতৎপরতার কারণে দুর্ভিক্ষের শুরু হলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো কুমারখালীতেও আওয়ামী লীগের তৎকালীন এমপি গোলাম কিবরিয়ার নেতৃত্বে গঠিত লঙ্গরখানার কাজে সহায়তা করেন বারী জোয়ার্দার। তারপরও ১৯৭৫ সালে তাকে রক্ষীবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হতে হয়েছিলো, গ্রেফতারকালীন তিনি কুমারখালী থানা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করায় সারাদেশে বামপন্থিদের গ্রেফতার শুরু হলে তিনিও ঐ আতংকে ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ও ন্যাপ নেতা জাহিদ চৌধুরীকে নিয়ে নিজেদের গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। তবে সেটাকে আর কাজে লাগাতে পারেননি। ৮০-এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৫ দল, ৭ দল ও ৫ দলের আন্দোলনের সময় তিনি ১৫ দলের প্রতিনিধি হিসেবে কুমারখালী এবং ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংগঠনিক কাজ করেছেন। ন্যাপে বিভক্তি শুরু হলে তিনি ন্যাপ (মোজাফ্ফর) পরে সৈয়দ আলতাফ হোসেনের সাথে একতা পার্টি পরে গণতন্ত্রী পার্টি এবং সর্বশেষ ঐক্য ন্যাপের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পার্টির ভাঙ্গাগড়ার ঘটনা ঘটলেও দলীয় আদর্শ এবং লক্ষ্য, মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ, শোষণ-বঞ্চনামুক্ত সমাজ, সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ার স্বপ্নকেই হৃদয়ে লালন করেছিলেন বারী জোয়ার্দার।
আট সন্তানের জনক হয়েও সন্তানদের জন্য তেমন সহায়-সম্পত্তি অর্জন করেননি ঠিকই, তবে তাদের মানুষ হিসেবে গড়ার চেষ্টা করেছেন, অনেকটা সফলও হয়েছিলেন। তবে তাঁর অবর্তমানে তার স্বপ্নের সেই আদর্শ সন্তানেরা লালন-পালন করতে সক্ষম হবেন কি না সেটা তাদের ব্যাপার। কারণ, আমাদের সমাজে এমন কালচার শুরু হয়েছে যে সন্তানেরা বাবা-মায়ের বৈষয়িক বিষয়ের উত্তারাধিকার হলেও তার আদর্শ ও মূল্যবোধের অংশীদার হতে চান না। এ আমলের শ্রমিক নেতারা যেভাবে অর্থবিত্তের মালিক হচ্ছেন তাদের সময় এমনটা ছিলো না, তবে একেবারেই যে ছিলো না তা নয়। কিন্তু তিনি সেটা সঠিক বলে মনে করেননি, বামপন্থিদের অনেকেই এখনো যা সঠিক মনে করেন না। তাদের কাছে রাজনীতি মানুষের জন্য, অবৈধভাবে বক্তিগত সম্পদ অর্জনের জন্য নয়। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে তাকে পাজামা আর খদ্দরের পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য পোশাক পরতে দেখিনি। সাধারণ মানুষের মতোই সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। রাজনীতিতে তিনি ঢোলের লাউ আর অম্বলের কদি হননি।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একই আদর্শ আর মূল্যবোধ আলিঙ্গন করে থাকা কম কথা নয়। রাজনীতি করে ভোগ-বিলাস আর অর্থ-সম্পদ অর্জনে চ্যাম্পিয়নদের কাছে তিনি অনুকরণীয় না হলেও প্রগতিমনা দেশপ্রেমিক এবং মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন আজও যারা দেখেন এবং হৃদয়ে লালন করেন তাদের জন্য বারী জোয়ার্দার মধ্য আকাশের ধ্রুবতারার মতো। অন্ধকার রাতে জোনাকির আলোয় পথচারী যেমন পথের দিশা পায় তেমনই প্রগতিশীলরা তাকে ধ্রুবতারা করে নতুন পথের দিশা পাবেন। কারণ, অন্ধকার সব সময় থাকে না, আজকে হয়তো প্রগতিবাদীদের জন্য রাজনীতির পথ অন্ধকার, কাল তার পরিবর্তন আসবে না এমনটাতো নয়। বারী চাচার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সততা, দেশপ্রেম, আদর্শ ও মূল্যবোধের দর্শন পথ দেখাবে আগামী দিনের সঠিক রাজনীতির। তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক : কলেজ অধ্যক্ষ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাকবিশিস
Login to comment..