এ মাটি আদিবাসীদের–কার সাধ্য দখল নিতে

আসলাম খান

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
তখন কুয়াশাচ্ছন্ন রাজধানী ঢাকা। একটি নাগরিক প্রতিনিধিদলের গন্তব্য বগুড়ার শেরপুরের ভবানীপুর ইউনিয়নে। চলতে চলতে মোবাইলের রিংটোনের শব্দ, শেরপুর থেকে আদিবাসী নেতারা বারবার খোঁজ নিচ্ছেন কোথায় আছি? পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে। সময়টা শীতকাল। এ শীতেই সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা ও বগুড়া থেকে আদিবাসী নেতৃবৃন্দ ভবানীপুরে যাবেন। আদিবাসী ইউনিয়নের উপদেষ্টা ডা. দিবালোক সিংহ সর্বক্ষণ খোঁজখবর নিচ্ছেন। কুয়াশা ভেদ করে সকালের রোদ ততক্ষণে উঁকি দিয়েছে। শরীরে একটু তাপ লাগছে, শীতের অনুভূতিও কমে আসতে শুরু করেছে। দুপুর নাগাদ অপেক্ষার পালা শেষ হলো। স্থানীয় আদিবাসীদের নিয়ে ভবানীপুর বাজার থেকে সরুপথ, রাস্তার দু’ধারে ধানক্ষেত, মাটির বাড়ি পার হয়ে একসাথে কমল সিংয়ের বাড়ির আঙিনায় পৌঁছে গেলাম। রাস্তার পাশেই বটগাছ পুরনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। এখানেই আদিবাসীরা মিটিং করেন। আজ এখানে মিটিং হবে না। কারণ কদিন আগেই ভূমিকে কেন্দ্র করে ভূমিদস্যুরা সেখানে সশস্ত্র আক্রমণ করেছে। হামলায় সুশীল সিং, রিপন কুমার, সুজন সিং, মিনা রানী সিং, সুখী রানী ও টিকলা সিংসহ আহত হন ১৭ জন। কারো মাথায় ব্যান্ডেজ, কারো হাত ভেঙে দিয়েছে, পা দুটি ফোলা বা শরীরে অসংখ্য ক্ষত। নারীরাও রেহাই পায়নি হামলা থেকে। কপালের সামনে রক্তবর্ণ দাগ সিঁদুরের নয়, আক্রমণকারীর আঘাতের চিহ্নের। হামলার শিকার হয়ে কপালে সেলাইয়ের দাগ নিয়ে এরাই আবার মামলার আসামি। দুর্বলরা মার খাবে আবার আসামি হবে! পুরো গ্রামজুড়ে যখন চাপা ভয়, আতঙ্ক আর অসহায়ত্ব তখন গ্রামবাসীদের সাথে কথোপকথন শুরু হলো। হঠাৎই তারা কোথায় যেন সাহস খুঁজে পেলেন। পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে মানুষ সামনের দিকে এগোয়। তাদের অবস্থাও এখন তেমনই। আহত, ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষগুলো নির্যাতনের তাজা দাগ নিয়েই আলোচনায় এসেছেন। নারী-পুরুষ ও শিশুদের উপস্থিতিতে আঙিনা ভরে গেল। পূর্ব আকাশে সূর্যের তেজ বেড়েছে, সূর্যের দিকে তাকিয়ে রোদে পুড়ে তারা কথা বললেন। নির্যাতন নিপীড়নের ঘটনা শুনলেন প্রতিনিধিদল। জাতীয় ও স্থানীয় সাংবাদিকরা উপস্থিত হলেন। কুয়াশা নেই, সূর্যের তাপ বেড়েছে, নির্যাতিতদের সাহসও বেড়েছে। নতুন গল্প নয়, বেঁচে থাকার পুরনো গল্প: গাইবান্ধার বাগদা ফার্মে বাপ-দাদার আমল থেকে বসবাস করছে সাঁওতালসহ আদিবাসীরা। এ জমিটা গ্রাস করা দরকার ভূমিদস্যুদের। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো। দাউ দাউ করে জ্বলছে লেলিহান শিখা। পুড়বে মানুষ দখল হবে ভূমি। একটা সময় ভূমি থেকে উচ্ছেদ হবে। মানুষ তাড়িয়ে উন্নয়ন হবে। মানুষ তাড়ানোর উন্নয়ন। জোট বাঁধলো আদিবাসীরা। সরকার, পুলিশ ও ভূমি দখলকারীরা এক হয়ে গেল। মুখোমুখি লড়াইয়ে শহীদ হলেন রমেশ টুটু, মঙ্গল মার্ডি ও শ্যামল হেমব্রম। মাটিতে রক্তের দাগ, সে মাটির মানুষ বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ালো, পিছু হটলো দুর্বৃত্ত ভূমিদস্যুরা। বাগদা ফার্মের মাটিতে আদিবাসীরা ফসলের আবাদ করেছে, সবুজে ছেয়ে গেছে প্রান্তর। সুনিপুণ হাতের যতেœ মাঠে মাঠে ধানের ছরা। মধুপুর ইকোপার্ক করা হবে, জমি লিজ নেবে। বান্দরবানের ম্র সম্প্রদায়কে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। পাঁচ তারকা হোটেল হবে। ঝলমলে হোটেলের আলোয় ঝকমক করবে বান্দরবান। শুধু কি মানুষ উচ্ছেদ? ধ্বংস করা হচ্ছে বৈচিত্র্যময় প্রথাগত সংস্কৃতি। হুমকিতে ভাষা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নাচ, গান, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, বাদ্য বাজনা, লোকসাহিত্য, লোককাহিনী, প্রবাদ প্রবচন ও নিজস্ব ধারার নাটক। নিজস্ব সামাজিক উৎসবসমূহও গুটিয়ে যাচ্ছে। পূর্বপুরুষের সময় থেকে বংশপরম্পরায় যে জমিতে কর্ষণ করেছে আইনের মারপ্যাঁচে তা এখন হবে অন্যের। মাটি হচ্ছে মা, এ মাটিতেই তার প্রাকৃতিক অধিকার। দুর্বৃত্ত ভূমিদস্যুরা রাষ্ট্র মা’কে দখলে নেবে। সারাদেশে চলছে দখলের অমানবিক উদ্যোগ। অবরুদ্ধ আদিবাসী পল্লি: দীর্ঘদিন ধরে আম্বইল গ্রামের শতবিঘার বেশি জমির দখল নিয়ে চলছে বিরোধ। মওল গ্রুপ ও এসএ গ্রুপ কয়েক বছর আগে দখলে নেয় পুকুর, ধানক্ষেত, বসতভিটা। ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা লড়াই করে তাদের বিতাড়িত করে। পরাজয় হলেও প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠে মওল গ্রুপ। মামলা দিয়ে হয়রানি করে সাহসী মানুষদের। দিন যায় রাত আসে। গ্রামপল্লির জ্যোৎস্না রাতে, ঝি ঝি পোকার শব্দে তাদের ঘুম আসে না। রজনীর পর রজনী বিনিদ্র অন্ধকারে ভয় নেমে আসে। পাশেই মসজিদের মাইক দিয়ে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হয়, হাজারখানেক মানুষ গ্রাম ঘেরাও করে ফেলে। অবরুদ্ধ হয়ে যায় পল্লি। হাসপাতালে নিতে পারে না আহতদের। সন্তানরা যেতে পারে না স্কুলে, বাজারঘাট কাজকর্ম বন্ধ। উপার্জনের অভাবে না খেয়ে থাকার উপক্রম হয়। বাজার স্কুল কর্মক্ষেত্র যেতে হলে ভূমিদস্যুদের স্থানীয় টাউটদের বাড়ি ডিঙিয়েই যেতে হয়। সংকীর্ণ রাস্তার দু’ধারেই দালালদের বাসস্থান। এ করিডোরের মধ্য দিয়েই যাতায়াত করতে হয় আদিবাসীদের। আদিবাসী পরিষদ, আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ আদিবাসী ইউনিয়ন, আদিবাসী যুব পরিষদ, জনউদ্যোগ, শিক্ষক, নাগরিকদের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিদলের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব রুবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক আহসান হাবিব, নাগরিক উদ্যোগের জাকির হোসেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারাহ তানজিম তিতিল, আসলাম খান, দীপায়ন খীসা ও হরেন সিং। উপস্থিত ছিলেন গজেন্দ্র নাথ মাহাতো, আমিনুল ফরিদ, জাহাঙ্গীর কবির তনু, হরি শংকর প্রমুখ। মানুষগুলো সাহস পায় তারা একা নন। ঘর থেকে বের হয়ে আসে আদিবাসীরা। কথা বলেন, আদিবাসী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আহত শ্রীকান্ত মাহাতো, করুনা রানী তুরি, কমল তুরি, সুজন চন্দ্র। তারা ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন প্রতিনিধিদলের কাছে। প্রতিনিধিদল অভয় দিয়ে বললেন- “আমরা আপনাদের সঙ্গেই আছি”। বিকেলে আদিবাসী পল্লি থেকে সাংবাদিকসহ বগুড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা। বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামের সাথে মতবিনিময় সভা হলো। পেছনে ভবানীপুর ছেড়ে এলো আদিবাসীরা, তারা আশায় বুক বেঁধে রেখেছে। বারবার ভেসে আসছে নির্যাতিত মানুষগুলোর মুখ। আশা বেঁধে রাখি, দীপ জ্বেলে রাখি: জাতিগত সংখ্যালঘু বিরোধী, কায়েমি স্বার্থবাদী লুটেরারা সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে আদিবাসীদের ভূমি ও সম্পত্তি দখলসহ তাদের ওপর নানাভাবে শোষণ ও আধিপত্য চালাচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ঐতিহ্যগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি থাকলেও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে। ১০০ দিনের কাজ, ভিজি-এর কাবিখাতে আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। খাস জমি আদিবাসীদের বরাদ্দের দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। এ সংগ্রাম আজকের নয়– ব্রিটিশ আমলে জমিদারি মহাজনী শোষণের বিরুদ্ধে, জাতিগত শোষণ-নিপীড়ন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধেও আদিবাসীরা গৌরবোজ্জ্বল বিদ্রোহ ও গণসংগ্রাম গড়ে তুলেছে। উনবিংশ শতাব্দির বীর নায়ক সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরব থেকে একবিংশ শতাব্দির আলফ্রেড সরেন, পীরেন প্লান, সত্যবান হাজং লড়াইয়ে জীবন দিয়েছেন। কমরেড মণি সিংহ, ইলা মিত্র, রণেশ মিত্র “আদিবাসীদের চোখের মণি”তে পরিণত হয়েছেন। সারাদেশে ভীরুতা আপসকামিতার পথ পরিহার করে আপসহীন লড়াকু, গঠনমূলক জনমুখী আন্দোলনই পারে আঁধারে সাহসের প্রদীপ জ্বেলে রাখতে। আম্বইল, গোড়তা, কেশবপুর, মরাদীঘি জয়নগর গ্রামে ভয়-ভীতি কাটলেও আশঙ্কা এখনো কমেনি। সবুজ ধানক্ষেত, বিশাল দিঘি, গাছের ছায়ায় বসতভিটা, মন্দির, বাপ-দাদার ভিটায় থাকার সংগ্রামটা শুধু আদিবাসীদের দিয়ে সম্ভব নয়। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীরা রক্ত দিয়েছেন। রক্ত দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের প্রশাসন, বিবেকবান মানুষ দেশবরেণ্য ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র বিভিন্ন গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী জনগণকে আদিবাসীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সব ফুলের সমারোহে বৈচিত্র্যময় সুন্দর বাগান থেকে কোনো একটি গোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে মানবিক বাংলাদেশ গঠন হতে পারে না। ভবানীপুরে আজও স্কুলঘরের দরজার জানালা ভাঙা, চাল মাটির সাথে মিশে গেছে। তবুও শিশুরা আবার বই খাতা স্লেট নিয়ে স্কুলে যেতে চায়। বোরো মৌসুমে চারা রোপন করতে চায়। নিজের জায়গায় থাকতে চায়। ফসল উঠবে আঙিনায়, জটলা বেঁধে রোদ পোহাবে সব বয়সীরা। প্রবীণরা শিশুদের শোনাবে বীরত্ব আর গৌরবের গল্প । রোদে পোড়া শক্ত চোয়াল, সুঠাম পরিশ্রমী দেহ, সরল প্রকৃতির আদিবাসী নারী- তারা সবাই প্রকৃতির সন্তান। তারা আমাদের পরম প্রতিবেশী। তারা ভালো থাকলে প্রকৃতিও ভালো থাকবে। ভালো থাকবে দেশ। লেখক : উপদেষ্টা, বাংলাদেশ আদিবাসী ইউনিয়ন। শিক্ষা গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..