
[গত সংখ্যায় প্রকাশের পর]
১৯৩৪ সালে রণেশ দাশগুপ্তের বাবা অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ঢাকায় চলে এসে বাসা নেন পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে। ডাক পড়ে ছেলেরও। ছেলে রণেশ দাশগুপ্ত পড়াশোনা শেষ না করেই চলে আসেন ঢাকায়। পরিবারের অস্বচ্ছল আর্থিক অবস্থা নিরসনের উদ্দেশ্যে কলকাতা যান চাকরির খোঁজে। কলকাতায় সংবাদপত্রে চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আবারও ঢাকায় ফিরেন। ১৯৩৮ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত নলিনীকিশোর গুহ সম্পাদিত ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকায় চাকরি নেন সহ-সম্পাদক পদে। সে বছরই বাবাকে হারান। এরপর রণেশ দাশগুপ্ত কাজ শুরু করেন একটি বিমা কোম্পানিতে।
দশ বছর ঢাকায় থেকে ১৯৪৮-এ কলকাতা যান ছোটবোনের বিয়ে উপলক্ষে; তবে ফিরেও আসেন কিছু দিনের মধ্যে। একই বছরের মার্চ মাসের ১০ বা ১১ তারিখ বাংলাভাষার প্রচারের দায়ে গ্রেফতার হন; ছাড়া পান কিছু দিন পর। ৭ জুলাই আবার গ্রেফতার হন। এবার বন্দি হন প্রাদেশিক জননিরাপত্তা আইনে। বিনা বিচারে প্রায় ৮ বছর বন্দি থাকেন কারাগারে। ঢাকা জেলে রণেশ দাশগুপ্তের নেতৃত্বে তিনবার অনশন ধর্মঘট করে রাজবন্দিরা। তৃতীয়বার অনশনের অপরাধে রণেশ দাশগুপ্তের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয় আইন অমান্যের অভিযোগে। সেই মামলা দমাতে পারেনি রণেশ দাশগুপ্তকে। আবার অনশন আবার ধর্মঘট। কর্তৃপক্ষ এবার কিছু দাবি মেনে নিল ঠিকই কিন্তু রণেশ দাশগুপ্তকে পাঠিয়ে দিল যশোর কারাগারে। যশোর কারাগারে গড়ে তোলেন ‘সাহিত্য-অনুশীলন চক্র’ নামে সংগঠন। এই অপরাধে রণেশ দাশগুপ্তের আবাস হলো রাজশাহী কারাগার। রাজশাহী থেকে আবার ঢাকা। ঢাকা কারাগারে বন্দিদশায়ও তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড গড়ে তোলেন। ১৯৫৪-র প্রাদেশিক নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে বাতিল করা হয় ‘জননিরাপত্তা আইন’। ঢাকা কারাগার থেকে মুক্তি পান রণেশ দাশগুপ্ত। এরই মধ্যে চলে গেছে ৭ বছর ৮ মাস।
মুক্তি পেয়ে যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে জারি হয় ৯২(ক) ধারা। বাতিল করা হয় প্রাদেশিক সরকার। প্রগতিশীল মুক্তমনা মানুষদের পথচলায় আবার কালো ছায়া। রণেশ দাশগুপ্ত এবার আত্মগোপনে। ‘রেজা’ ছদ্মনামে পরিচিত হলেন পুরনো ঢাকার উর্দুভাষীদের কাছে। আত্মগোপন করেন তাদেরই মধ্যে– এই সুবাদে উর্দুভাষা শিখে ফেললেন।
পরের বছর (১৯৫৭ সালে) ঢাকা পৌরসভা নির্বাচন। শাঁখারীবাজার-তাঁতীবাজার- ইসলামপুর নিয়ে গঠিত ওয়ার্ডে কমিশনার পদে নির্বাচন করলেন রণেশ দাশগুপ্ত। নির্বাচিত হলেন জনতার ভোটে। পরের বছর ১৯৫৮-এ যোগ দেন দৈনিক ‘সংবাদ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক পদে। বছরের শেষের দিকে (৭ অক্টোবর ১৯৫৮) পাকিস্তানী জেনারেল আইউব খান সামরিক আইন জারি করে। ১৯৬২-র ছাত্র আন্দোলনের সূত্র ধরে আবার গ্রেফতার করা হয় রণেশ দাশগুপ্তকে। কয়েক মাস পর মুক্তি পেয়ে যোগদান করেন ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক পদে। সংবাদে চাকরি আর আইউববিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম-সংগঠন দুই কাজই করছিলেন সমানতালে। কিন্তু ওই অবস্থা বেশি দিন চলতে পারেনি। ১৯৬৫-তে আবার গ্রেফতার; ছাড়া পান ১৯৬৮-তে। সংবাদে তাঁর চেয়ারটি রক্ষিতই ছিল– মুক্তির পর আবার নেই ‘দৈনিক সংবাদ’। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পথে রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন গভীর প্রত্যয়ী এক বিপ্লবী পথিক। অসহযোগ আন্দোলনে শিল্পী-সাহিত্যিক তথা সংস্কৃতিকর্মীদের সংগঠিত করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন রণেশ দাশগুপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আগরতলা হয়ে কলকাতা; বক্তৃতা ও লেখনীয় মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে সংক্রিয় অংশ গ্রহণ। চলেছে অবিরাম গতিতে। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এসে আবার কর্মক্ষেত্র ‘দৈনিক সংবাদ’।
একদিকে চাকরি আর একদিকে দেশগঠনের সংগ্রাম। শিশু-কিশোর শিল্পী- সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সচেতন-সংগঠিত করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা যার মূল উদ্দেশ্য। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য-স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশ গঠনে অর্থনীতি- রাজনীতির সংগে সামাজিক আন্দোলন অতি অপরিহার্য এবং গুরুত্বপূর্ণ। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান, পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ, তার মূল নীতিসমূহ মানুষের মননে-মানসে পৌঁছে দেয়া এবং তাকে ধরে রাখার কঠিন কাজে ব্রতী হলেন রণেশ দাশগুপ্ত। বেছে নিলেন শিশু-কিশোর, ছাত্র-যুব ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। খেলাঘর, উদীচী, বাংলাদেশ সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন প্রভৃতি সংগঠনের ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রাপ্ত থেকে আর এক প্রাপ্ত। ঢাকায় বিকাশমান নাট্য আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সভা-সেমিনার-সংগঠন সর্বত্রই রণেশ দাশগুপ্ত যেন মধ্যমণি। সাংবাদিক মহলের অভিভাবক। চিন্তা-ভাবনার এক নতুন আলোর শিখা পৌঁছে দিচ্ছেন মানুষ, বিশেষ করে ছাত্র-যুব-তরুণ জনগোষ্ঠীর হৃদয় দুয়ারে। তাঁর বাণী, শোষণ-বঞ্চনাহীন, সাম্যের এক বাংলাদেশ। যার ভিত্তিতে ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মবিসর্জনে বাংলাদেশ অর্জন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে সেন্সর বোর্ডের সদস্য হয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে দিয়েছেন নতুন পথের দিশা। ব্যাপক এই সাংস্কৃতিক পরি-লে এক আলোর শিখা হয়ে উঠেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন সবার হৃদয়ে।
মানুষের মুক্তির আদর্শের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বাংলাদেশ সামাজিক-সাংস্কৃতিক- অর্থনীতিক-রাজনৈতিক স্থিতি অর্জনের আগেই যুদ্ধে পরাজিত শক্তি এবং তাদের অভিভাবক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে বাংলাদেশকে নিয়ে। শুরু হয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে অস্থিরতা সৃষ্টির উন্মাদনা। গড়ে ওঠে নতুন নতুন সংগঠন ও নতুন নতুন দল। এদের হটকারীতায় হটিয়ে দিতে চায় বাঙালির দীর্ঘ দিনের অর্জন। গুপ্তহত্যা, গুপ্ত-আঘাত প্রাকাশ্যে উদ্ভটসব সাংস্কৃতিক-সামাজিক কর্মকাণ্ড, ভঙ্গুর অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করা, লুট-ডাকাতির মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি এদের নৈমিত্তিক ও মৌলিক দায়। চুয়াত্তরে পি-এল-৪৮০ গমের জাহাজ মাঝ পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। সৃষ্টি হয় মহাদুর্ভিক্ষ। আর এসব ফলাও করে প্রচার করতে থাকে সাংবাদিক নামধারী হাতে গোনা কিছু জ্ঞানপাপী মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সহায়তা প্রদানকারী আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তোলে। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও রণেশ দাশগুপ্ত দৃঢ়-ঋজু-অবিচল। তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় এই কুজ্জটিকা একদিন কেটে যাবেই। ১৯৭৪-এ ঘুরে আসেন সোভিয়েত ইউনিয়ন। স্বচক্ষে দেখে আসেন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামো, অর্থনীতি আর সামাজিক প্রতিবেশ। ঘটে যায় পঁচাত্তরের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি (!) আসে সৌদি আরব আর চীনের কাছ থেকে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের এক মহামিলন।
১৯৭৫-এর দৈনিক সংবাদ বন্ধ হয়ে গেলে রণেশ দাশগুপ্ত কিছুদিন কর্মহীন থাকেন। সংবাদ পুনঃপ্রকাশিত হলে আবার তিনি দৈনিক সংবাদে। এসময় কিছুটা হতবাক রণেশ দাশগুপ্ত। অক্টোবর (১৯৭৫) মাসে ব্যক্তিগত কাজে রণেশ দাশগুপ্ত কলকাতা যান। এরপর আর ফিরে আসেননি বাংলাদেশে। হয়ত এক গভীর ক্ষোভ, অভিমান অন্তর্জালায় পুড়ে অঙ্গার হচ্ছিলেন ‘চির উন্নত শির’ এই মানুষটি। কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির লেনিন স্কুলের বর্ণনাতীত এক পরিবেশে জীবনের শেষ ২২টি বছর কাটিয়েছেন নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে। না, সে যুদ্ধে পরাভব মানেননি জীবন রণে জয়ী রণেশ দাশগুপ্ত। প্রতিনিয়ত লিখে চলেছেন মানবমুক্তির সংগ্রামে প্রগতির পথে চলার অমোঘ উচ্চারণ।
১৯৯৭-এর ৪ নভেম্বর দুপুরে কলকাতায় মহাপ্রস্থানে চলে যান রণেশ দাশগুপ্ত। একদিন পর ৬ নভেম্বর তাঁর মরদেহ নিয়ে আসা হয় বাংলাদেশের এই ঢাকায়। তারপর শেষকৃত্য।
এর চৌত্রিশ বছর আগে (শ্রাবণ ১৩৭০) রণেশ দাশগুপ্ত লিখেছিলেন, সেদিন সকালে ঢাকায় :
‘শ্রাবণের আসার মহড়া চলছে উপরে এক ফালি আকাশে। কোন প্রচণ্ড অগ্নিকাণ্ডজাত ধোয়ার কু-লীর মতো মেঘ গমকে গমকে খুব নিচু দিয়ে দ্রুতগতিতে ধাবমান। পথিকেরা আসন্ন বর্ষণের কথা ভেবে ত্রস্তপায়ে পথ চলছে। গাড়ির মিছিল আর কর্দমাক্ত পথেও এই ত্রস্ততা। হঠাৎ দক্ষিণ-পশ্চিমের আকাশে মেঘের পর্দাকে এক মুহূর্তের জন্য সরিয়ে সকালের সূর্য উঁকি দিয়ে আবার মুখ ঢাকলো। আর সেই আলো এসে পড়লো পথচারী আর যানবাহনগুলোর ওপর এবং সরেও গেলো সঙ্গে সঙ্গে। এ-কে বিদ্যুতের ঝলকের সঙ্গে তুলনা করা যায়। আর সেই ঝলকে উদ্ভাসিত হলো অনেকের চোখের সামনে একটি বালিকার মুখচ্ছবি। খোলা রিকশাায় বসেছে সে একটা প্রকাণ্ড তানপুরা নিয়ে। এমন ঋজু তার ভঙ্গি যে মনে হয়, সে যেন একটা কঠিন রাগিণীর রেয়াজ করতে বসেছে। মুখে ভারি অদ্ভুত এক নিষ্ঠার হাসি। এত যে ভিড়, এত যে বিচিত্র যানবাহনের গর্জন, তাকে যেন স্পর্শ করতে পারছে না। তার উপস্থিতিটা এ দিক দিয়ে সহজ। মেয়েটির পরনে ফ্রক। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সিঁড়ির একেবারে নীচের ধাপে তার থাকার কথা। কোন স্বীকৃতিই সে পেতে পারে না গায়িকা হিসাবে অভিজ্ঞ শহরবাসী পথচারীদের চোখে। সে যেন জানে যে, পথচারীর ভ্রুক্ষেপই করবে না তাকে দেখে, তবু সেও কিন্তু ভ্রুক্ষেপ করছে না জনাকীর্ণ পথে চলতে চলতে। মৌন রয়েছে সহজ অন্তঃসুরে। চলমান ছবিটা দেখে শেষের এই কথাটাই মনে লেগে রইল অনেক্ষণ, তারপর মনের মধ্যে পরিপুষ্ট হয়ে উঠল এমন একটি ছবি, যাকে পছন্দ করিরনা। এই ছবিটির নির্মাতা হচ্ছে একটি রেওয়াজ। এই রেওয়াজ হচ্ছে শিল্পীর বিচ্ছিন্নতার রেওয়াজ, জনতা থেকে দূরে সরে যাওয়ার রেওয়াজ। এই বালিকাও কি সেই রেওয়াজে আবদ্ধ হয়ে বসবে?’
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় বাইশ বছরের প্রবাস জীবনেও তাঁর মননে-মানসে ছিল বাংলাদেশের খেলাঘর আর উদীচী। এক কথায় বলা যায় রণেশ দাশগুপ্ত আমৃত্যু আপাদমস্তক সংগঠক, সংগঠনের উপদেশক ও সংগঠনের মস্তিষ্ক। এই ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর বিচিত্র ও বিপুল রচনাসম্ভারে।
তাঁর বিচিত্র রচনাপাঠ বাঙালি মননের আলোর শিখা হয়ে ওঠে সহজেই। তাঁর লেখা বাঙালির প্রগতি চিন্তার চালিকাশক্তি বলা যায়। তাই রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর সাহিত্যসাধনার মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন প্রগতি সাহিত্য-সংস্কৃতি সাধনার প্রজ্জ্বলিত বাতিঘর।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী