চা শ্রমিক জাতীয় কনভেনশনের ধ্বনি প্রতিধ্বনি থেকে

আহমদ সিরাজ

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষে শিল্প কারখানার ইতিহাসে চা শ্রমিকরা শিল্প শ্রমিক হয়েও ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যের অধিকারী শ্রমজীবী মানুষের অংশ। অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে বিশেষত আসাম ও সিলেটসহ এসব অঞ্চলে চা শ্রমিকদের বসতি গড়ে ওঠে। কিছু ক্ষেত্রে লাভ-লোভ ছলচাতুরিতে তাদের নিয়ে আসা হয় এসব অঞ্চলে। সেই শ্রমিকেরাই ভাগ্যোন্নয়নের আশায় জঙ্গল আবাদ করে চায়ের পত্তন বা বাগান প্রতিষ্ঠায় তাদের শ্রমঘাম ঝরাতে শুরু করে। সে পরিশ্রম ছিল নিষ্ঠুরতর মাত্রার। যা ইতিহাস, গল্প, উপন্যানে জায়গা পেয়েছে। একসময় যারা নিজ দেশে ভূমিপুত্র হিসেবে পরিচিত ছিল তারাই কাজ ও টাকার ধান্দায় পড়ে পরবাসী চা শ্রমিক হিসেবে ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে অভিন্ন পরিচয়ে থেকে গেছে। বাংলাদেশে এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছয় লক্ষাধিক হলেও বাগানের স্থায়ী কর্মরত শ্রমিক হিসাবে এক লাখ বা তার কিছু বেশি হতে পারে। তবে কর্মহীন বেকার শ্রমিকের সংখ্যা অনেক। কিন্তু বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে চা বাগান শ্রমিকের রক্ত-ঘাম-অশ্রুর যে সম্পৃক্ততা রয়েছে তাকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই, বরং মূল ¯্রােতের মানুষের সঙ্গে সমান তালে তাদের অংশগ্রহণ দেশ জাতিকে গর্বিত করে রেখেছে। এমন চা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ব্রিটিশ পাকিস্তান আমলের আদলে দাস শ্রমিকের মতো শোষিত বঞ্চিত থাকার কথা নয়। নির্মম হলেও সত্য চা বাগানের শ্রমিকরা মূল স্রোতের অংশ হয়ে আধুনিক অগ্রসর চা বাগান শ্রমিক হয়ে উঠতে পারেনি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসেও তাদের বসতভিটা কাজ মজুরি ইনসাফ স্বাস্থ্য চিকিৎসা শিক্ষার মতো মৌলিক বিষয়সমুহের জন্য দাবি জানাতে হয়েছে–লড়াই সংগ্রামে যুক্ত হতে হয়েছে। বাবু-ম্যানেজার মালিকের একই আচরণের শিকার হতে হয়েছে। যা কিছুতেই কাম্য হয়ে উঠেনি। সাম্প্রতিককালে চা শ্রমিকের সামগ্রিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ১০ দফা দাবিনামার একটা খসড়া প্রণয়ন করে চা শ্রমিকদের মাঝে বিতরণ করে-“চা শ্রমিকদের ১০ দফা বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটি”। ২৭ নভেম্বর ২০২২ চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে চা শ্রমিক জাতীয় কনভেনশন আহ্বান করা হয় সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। কনভেনশনকে কেন্দ্র করে সারা বাংলাদেশের ১৬৭টি বাগানের মধ্যে ১০০টির মতো বাগান থেকে ছয়শোর বেশী প্রতিনিধির উপস্থিতি ঘটে। বাংলাদেশের জন্মের পর এতগুলো বাগানের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এ জাতীয় কোনো কনভেনশন বাগান শ্রমিকদের হয়েছে বলে মনে হয় না। সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁওসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শ্রমিকদের উপস্থিতি ছিল আশা জাগানিয়া। এছাড়া শুভার্থী, ছাত্র, যুবক সুধীজনদের উপস্থিতিতে কনভেনশন স্থল আলোকিত হয়ে উঠে। চা শ্রমিকদের র্যা লির ধ্বনি-প্রতিধ্বনিতে গোটা সিলেট শহর মুখর হয়ে উঠে। কনভেনশনের উদ্বোধনী বক্তব্য প্রদান করতে গিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয় মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখায় তেতুলিয়া যেমন ঐতিহাসিক একটা ঘটনা তেমনি সিলেটে চা শ্রমিকদের এই কনভেনশনও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। তিনি পাশাপাশি যুক্ত করেন চা বাগানের বার্ষিক উৎপাদন আয়-ব্যয়ের একটা শ্বেতপত্র প্রকাশের বিষয়, যা থেকে সত্য জানার সুযোগ ঘটবে। সেদিন শহীদ মিনার কনভেনশনস্থল হয়ে উঠে চা শ্রমিকদের শক্তি ও প্রেরণার জায়গা। একে একে অনেকজন তাদের প্রাণের কথা উচ্চারণ করেন। এদের ক’জনের মধ্যে মুমিনছড়া চা বাগানের সুনীল মৃধা, মাধবপুর চা বাগানের সুতপা বিশ্বাস, খাদিমনগর চা বাগানের রোকসানা বেগম, তেলিয়াপাড়া চা বাগানের লালন পাহান, গোবিন্দপুর বাগানের সুমন পানিকা, চাঁদপুর বাগানের শচী রানী ভৌমিক, ইটা বাগানের নূরে আলম, পঞ্চগড় বাগানের সিরাজুল ইসলাম ঠাকুরগাঁও বাগানের বিদ্যাচাষা, রত্মা বাগানের সুমন ঘোষ প্রমুখ। তাদের সকলের অভিজ্ঞতার কথাগুলো নানাভাবে উচ্চারিত হয়। যা থেকে কতিপয় অংশ এখানে সারাৎসার হিসেবে টেনে আনা যেতে পারে। তাদের অনেকেই কনভেনশনস্থলে আসতে পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন, কখনও ফোনে কিংবা সরাসরি তাদের ওখানে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ তাতে বিভ্রান্ত হয়েছেন। তবু তাদের সাহসী উপস্থিতি ছিল। তারা দ্বিধাহীনভাবে ১০ দফার প্রতি সংহতি জানিয়ে বলেছেন, বাইরে থেকে আসা লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের এদেশে আশ্রয় নেওয়া মানবিকতার নামে জায়গা জমি নিয়ে রাজ্যের মতো অবস্থান নিয়ে বসবাস করছে। অথচ চা বাগানের শ্রমিকরা দেড়শ বছরের অধিক সময় ধরে চা উৎপাদন করে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে, মুক্তিযুদ্ধে শত শত চা শ্রমিক প্রাণ বির্সজন করেছেন, কিন্তু এদেশে এখনো বসতভিটা নিয়ে বাঁচার সুযোগ হয়নি তাদের। মূল স্রোতের লোক হয়েও পরবাসী ঠিকানাহীনভাবে থেকে গেছে তারা। তাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, চা বাগানের মজুরি প্রশ্নে শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে ইউনিয়ন কী পরিমাণ মালিক স্বার্থের প্রতি নতজানু থাকে। তারা ১৪৫ টাকা মজুরিতে আন্দোলন থেকে শ্রমিকদের প্রত্যাহার করে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শ্রমিকের দৃঢ় অনমনীয় মনোভাবের কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। এই আন্দোলনে প্রশাসনসহ সরকারদলীয় রাজনীতিকদেরও অবস্থান ছিল একই রকম। শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করতে চা শ্রমিক প্রতিনিধিদের অবস্থান অনেকটাই মালিকপক্ষের সমর্থনকারী হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে। বিগত দেড় বছরের ইতিহাসেও শ্রমিকদের মজুরি দেড়শো টাকা হয়নি। এমন একটা অদ্ভুত সত্যকে চা বাগান শ্রমিকরা যুগ যুগ ধরে বহন করে আছে, তা ভাবলে গা শিউরে উঠে। টানা উনিশ দিন আন্দোলন করতে গিয়ে কোনো নেতা নয়, সাধারণ শ্রমিকরাই ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। তখন পরিস্থিতি বেগতিক দেখে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের ভিত্তিতে শ্রমিকরা আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। আন্দোলনের চরিত্র এমন একটা অবস্থানে চলে যাওয়াতে শ্রমিকরা তাতেই ভরসা খোঁজেন, কনভেনশনের শ্রমিকদের কণ্ঠস্বর থেকেও এমন সত্য উঠে আসে। তাদের ভাষায় ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করতে গিয়ে ১৭০ টাকা ঘোষণা যখন সরকারপ্রধানের কাছ থেকে আসে তখন তাদের সম্মানের সঙ্গে মেনে না নিয়ে উপায় থাকে না। এখন তাদের প্রশ্ন পূর্বের সকল সুবিধাসমূহ বর্ধিত মজুরির সঙ্গে সংগতি রেখে অব্যাহত রাখার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে বাগানে ১৭০ টাকা মজুরি পাওয়া যায় না। কোথাও ৮২ টাকা, কোথাও ৯৯ টাকা ইত্যাদি কথাও তাদের মুখ থেকে উঠে আসে। বকেয়া টাকার কোনো সুরাহা নেই। অন্যান্য সুবিধাদিরও খবর নেই। ইউনিয়নের নেতাদের এজন্য কোনো দায় নেই। এসব কথা কনভেনশনে তারা ক্ষোভের সঙ্গে উচ্চারণ করেন। তারা শ্রমিকদের দেওয়া চাঁদার কথাও উচ্চারণ করেন এবং তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবের দাবি জানান। অন্যথায় এই চাঁদা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তাদের কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়ে উঠে বাংলাদেশের ইতিহাসে চা শ্রমিকদের জন্য ১০ দফা দাবিনামা চা শ্রমিকদের সার্বিক জীবনযাত্রার পরিবর্তনে একটা দলিল। তাকে সংগঠিত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশ জাতির জন্য গ্রহণযোগ্য করে তুলে বাস্তবায়িত করতে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে হবে। তাদের ভয় ও আশঙ্কার দিক হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধ একটা প্রগতিশীল উপাদানকে বহন করে গড়ে উঠছিল, কিন্তু দেশ স্বাধীনের ৫০ বছরে এসে রাষ্ট্র এসব উপাদান বহন করতে সক্ষম হচ্ছে না। মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা সংবিধান আমলে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশ প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতায় তাড়িত হয়ে পড়েছে। চা বাগান শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নেতৃত্বের চা বাগান শ্রমিক প্রীতির নমুনা থেকেও এমন আঁচ করা গেছে। তারা মনে করে থাকে চা বাগানের ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে অনেক কিছুই চা শ্রমিকদের দেওয়া হয়েছে। তাদের যেন একটা অনুগত অবস্থান নিয়ে বসবাস করতে হবে। এমনকি কোনো বামপন্থি সংগঠনের চা বাগানে অবস্থান তাদের সহ্যের বাইরে। এতদ্ সত্ত্বেও আশা জাগানিয়া হিসেবে কনভেনশনে উঠে আসা শ্রমিকদের জন্য ১০ দফা দাবিনামা তাদের আশার হৃদপিণ্ড হিসেবে পাথেয় হয়ে উঠবে। পরিশেষে কনভেনশনে সকলের মতামতের ভিত্তিতে চা শ্রমিক ১০ দফা বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়েছে। এটা নিশ্চিতই বলা চলে দীর্ঘকাল ধান্ধা ও প্রতারণা শোষণ-নির্যাতনের ভেতর জর্জরিত চা শ্রমিক আশা ভরসায় জেগে উঠতে পারে। বিদ্যমান বাস্তবতায় পথ কঠিন হলেও যোগ্য নেতৃত্ব জটিল ও আঁকাবাকা পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে শ্রমজীবী চেতনাকে বহন করে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সংগ্রাম ও সংগঠন এগিয়ে নিয়ে যাবে এমন আশা রাখা যায়। কনভেনশনে আশার সেই প্রত্যয়ী ধ্বনিই উচ্চারিত হয়েছে। লেখক : সদস্য, সিপিবি, মৌলভীবাজার জেলা কমিটি

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..