গুজরাট দাঙ্গায় মোদীর ভূমিকার তথ্যচিত্র নিয়ে তোলপাড়

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

একতা বিদেশ ডেস্ক : গুজরাটে ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ঐ রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা নিয়ে একটি তথ্যচিত্রকে ঘিরে তোলপাড় চলছে দেশটিতে। ভারতে যেন এই তথ্যচিত্রটি দেখা না যায় তা নিশ্চিত করতে বিজেপির সরকার যে ধরনের নজিরবিহীন তৎপরতা শুরু করেছে-তাতে বিস্ময় তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে সারা বিশ্বে খবর হচ্ছে। ‘ইন্ডিয়া, দি মোদী কোয়েশ্চেন’ নামে বিবিসির অনুসন্ধানী এই তথ্যচিত্রটি টুইটার, ইউটিউবে দেখানো বন্ধের নির্দেশের পর ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে পড়ে। সরকার এ তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী বন্ধের নির্দেশ দিয়ে নতুবা কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। কিন্তু ছাত্ররা তা মানায় চালানো হয়েছে হামলা, হয়েছে ব্যাপক ধরপাকড়। ২৪ জানুয়ারি দিল্লির জেএনইউ ক্যাম্পাসে সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একদল ছাত্রছাত্রী বড় পর্দায় নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে বিবিসির আলোচিত তথ্যচিত্রটি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল, সেটি দেখার জন্য জমায়েতও হয়েছিল বিশাল। জেএনইউ কর্তৃপক্ষ এরপরই ছাত্র সংগঠনের অফিসে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট কানেকশন ছিন্ন করে দেন। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যেই শত শত ছাত্রী কিউ আর কোড শেয়ার করে নিজেদের মোবাইল বা ল্যাপটপে ডকুমেন্টারিটি দেখতে শুরু করেন-এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় বিরুদ্ধ মতাবলম্বী ছাত্রগোষ্ঠীর পাথরবৃষ্টি। ক্যাম্পাসে ঢোকে দিল্লি পুলিশও, নির্বিচারে লাঠিচার্জ করে তারা। গভীর রাতে জেএনইউ-তে সেই মারপিট ও ধস্তাধস্তির পুনরাবৃত্তি দেখা গেল রাজধানীর আর একটি নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতেও। আর সেখানেও উপলক্ষ ছিল একই- বিবিসির তথ্যচিত্রটি দেখানো। জামিয়াতেও কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বামপন্থি ছাত্রদের একটি সংগঠন বড় পর্দায় ডকুমেন্টারিটি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু দুপুরে দাঙ্গা পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকে তাদের সেই আয়োজন তছনছ করে দেয়। পূর্ব দিল্লিতে জামিয়ার ক্যাম্পাস রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে, ডজনখানেক ছাত্রকে পুলিশ তুলেও নিয়ে যায়। এর আগের আটচল্লিশ ঘণ্টায় তেলেঙ্গানার হায়দ্রাবাদ ইউনিভার্সিটি, কেরালার কোচি ইউনিভার্সিটিসহ আরও বহু প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা এই ডকুমেন্টারিটি প্রকাশ্যে দেখানোর ব্যবস্থা করেছে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (বিশ্ববিদ্যালয়) বা যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতেও এই তথ্যচিত্রের স্ক্রিনিং হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং সর্বত্রই আয়োজক ছাত্রগোষ্ঠীগুলো এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে সরকারি সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই তাদের এই পদক্ষেপ। বস্তুত তিন বছর আগে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে যেরকম স্বত:স্ফূর্ত প্রতিবাদ দেখা গিয়েছিল, অনেকটা একই ধরনের দৃশ্য যেন আবার দেখা যাচ্ছে ভারতের নানা প্রান্তে-যদিও প্রতিবাদের বিষয়টা এখানে ভিন্ন। কিন্তু একটি সংবাদ মাধ্যমের একটি তথ্যচিত্র নিয়ে ভারতের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের সরকারের মধ্যে এই মাত্রার স্পর্শকাতরতা, এই উদ্বেগ ঠিক কেন? যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা উড্র উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করছেন, অস্বাভাবিক নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তির প্রশ্নে তার দল, অনুসারী এবং সমর্থকদের অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি প্রতিফলন এখন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু গুজরাট দাঙ্গায় মি. মোদীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন নতুন কিছু নয়। বিবিসির তথ্যচিত্রে যা বলা হয়েছে তার সিংহভাগই পুরনো। সবই ভারতীয়দের জানা। একটি যে বিষয় কিছুটা নতুন - তা হলো দাঙ্গার পর তা নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের নিজস্ব একটি তদন্তের ফলাফলের কিছু অংশ প্রথমবারের মত জানা গেছে। ব্রিটিশ ঐ তদন্ত রিপোর্টে গুজরাটে ‘জাতিগত হত্যাকাণ্ডের’ মত শব্দ ছিল। বলা হয়েছে, ঐ হত্যাযজ্ঞের জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদী ‘সরাসরি দায়ী’ ছিলেন। অবশ্য এমন সন্দেহ-অভিযোগও নতুন কিছু নয়। যদিও ২০১২ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের গঠিত তৈরি বিশেষ তদন্ত কমিটি দাঙ্গায় মোদীর সরাসরি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ খারিজ করে দেয়, তারপরও বিতর্ক থামেনি। এবং এসব সন্দেহ-বিতর্কে ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে মি. মোদীর যে ক্ষতি হয়েছে - তার কোনও প্রমাণ নেই। সাম্প্রতিক সময়ে মানবাধিকারের বিভিন্ন ইস্যুতে দেশের বাইরে থেকে কোনও প্রশ্ন-অভিযোগ ওঠানো হলেই বিজেপি সরকার রুটিনমাফিক শক্ত ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছে। এই কৌশল মোদীর সমর্থকরা পছন্দ করছে। তারপরও বিবিসির তথ্যচিত্রটি নিয়ে বিজেপি সরকার যা করছে- তাতে অবাক হচ্ছেন অনেক পর্যবেক্ষক। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, ভারতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের মর্যাদায় বসানোর চেষ্টার সাথে মোদী নিজেও একজন শীর্ষ সারির বিশ্ব নেতা হওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। ২০১৪ সালে ক্ষমতা নেওয়ার পর ঘনঘন বিদেশ সফর করেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক যে কোনও ফোরামে যোগ দেওয়ার কোনও সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেন না। ভারতের বর্ষীয়ান সম্পাদক ও দ্য হিন্দু পত্রিকাগোষ্ঠীর প্রধান এন রাম মনে করেন, সত্যিকারের পরিণত একটি সরকার হলে তারা এই ধরনের একটি তথ্যচিত্রে ‘নো কমেন্টস’ বলেই জবাব সারত এবং পুরোপুরি উপেক্ষা করত। বাস্তবে কিন্তু দেখা গেছে ভারত সরকার এটিকে ‘প্রোপাগান্ডা পিস’ বলে বর্ণনা করেছে এবং এতে ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচয় প্রকাশ পাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছে। গুজরাটে ওই দাঙ্গার সময় মোদী পশ্চিমাঞ্চলীয় এই রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সেবারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সরকারি হিসাবেই এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান। দাঙ্গায় প্রকৃত নিহতের সংখ্যা সরকারি সংখ্যার দ্বিগুণের বেশি বলে অনুমান একাধিক মানবাধিকার সংস্থার। হিন্দু তীর্থযাত্রীবাহী একটি ট্রেনে আগুন ধরে ৫৯ জনের মৃত্যুর পর গুজরাটে ওই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। দাঙ্গা রোধে মোদী কার্যকর ব্যবস্থা নেননি, এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলেন বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এই শীর্ষ নেতা অবশ্য প্রথম থেকেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..