শাহবাগে বসন্তকে গাইতে দিও গান শিরোনামে কর্মসূচি পালন করে কবি, লেখক ও সংস্কৃতি কর্মীরাএকতা প্রতিবেদক :
বাংলা একাডেমির ওপর আমলাতন্ত্রের হস্তক্ষেপের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ২৪ লেখক-শিল্পী।
পাশাপাশি বাংলা একাডেমির ওপর হস্তক্ষেপের অভিযোগে সংস্কৃতিসচিবের অপসারণও দাবি করেছেন তারা।
এদিকে সরকারের তোষামোদ ও সব নিবর্তনমূলক আইন মাথা পেতে নিতে পারেন এমন ব্যক্তিরা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও পদক পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন দেশের কবি, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীরা। আদর্শ প্রকাশনীকে বইমেলায় স্টল বরাদ্দ দেওয়ার দাবিতে ২৫ জানুয়ারি শাহবাগে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে তারা এ অভিযোগ করেন।
‘বন্দী সময়ের চিৎকার’ ব্যানারে ও ‘বসন্তকে গাইতে দিও গান’ শিরোনামে এ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এই আয়োজন থেকে দেশের কবি, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীরা অবিলম্বে আসন্ন একুশে বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনী নামের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানান।
অমর একুশে বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার ঘটনায় সরকার ও মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির কঠোর সমালোচনা করেন বক্তারা। তারা বলেন, বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রকল্পটি চিন্তা-ভাবনাবিরোধী। এই বিরোধিতার কারণ, সৃজনশীলতার উৎপাদন হলে তা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায়।
প্রতিবাদী এই আয়োজনে অংশ নেন আদর্শ প্রকাশনীর প্রকাশক মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আদর্শ প্রকাশনী অমর একুশে বইমেলায় স্টল পেল কি পেল না, আমার কাছে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। মূলত এর পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় আজকে এ জটিলতা (স্টল বরাদ্দ না পাওয়া) তৈরি হয়েছে। আমরা স্টল পেলেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে আদর্শ প্রকাশনী ও ব্যক্তি হিসেবে আমার যে অবস্থান, সেই অবস্থান বা দাবি থেকে আমরা কখনোই সরে আসব না।’
সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন শুভ্র বলেন, আদর্শ প্রকাশনী থেকে তার দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি একটি বইয়ের ব্যাপারে আপত্তি তুলে আদর্শ প্রকাশনীকে এবারের বইমেলায় স্টল বরাদ্দ দিচ্ছে না। কাজেই তাঁর বই দুটি পাঠক কীভাবে পাবেন, তার কোনো সদুত্তর তিনি পাচ্ছেন না। এই লেখক বলেন, ‘বই দুটির ভবিষ্যৎ একরকম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল। কোন আইন বা নীতিমালার ভিত্তিতে বাংলা একাডেমি এটা করতে পারে, সেটা আমরা জানি না। বাংলা একাডেমিও এর উত্তর দিতে পারবে কি না, সন্দেহ। এই যে আমার লেখা দুটি বই বইমেলায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না, এটা লেখক ও নাগরিক হিসেবে আমার জন্য অবমাননাকর ও অধিকারবঞ্চিত করে রাখা।’
লেখক অনুপম দেবাশীষ রায় বলেন, ‘আমরা এখন এমন একটি বিরূপ রাষ্ট্রে বাস করছি, যেখানে আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আমাদের চিন্তা করতে দেওয়া হচ্ছে না। বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রকল্পটি চিন্তাভাবনাবিরোধী। কারণ, আমাদের মধ্যে সৃজনশীলতার উৎপাদন হলে তা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায়।’
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার বলেন, অবিলম্বে আদর্শ প্রকাশনীকে বইমেলায় স্টল দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হোক। দুর্নীতিবাজ, লুটপাটকারী ও সন্ত্রাসীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে। এই আইনসহ সব ধরনের নিবর্তনমূলক আইন বাতিল করতে হবে।
আরও বক্তব্য দেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, শিল্পী অরূপ রাহী। বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে চলে গান ও কবিতা আবৃত্তি। অধিকারকর্মী মার্জিয়া প্রভা আয়োজনটি সঞ্চালনা করেন।
২৬ জানুয়ারি একাডেমি-মন্ত্রণালয় দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে লেখক-শিল্পীদের বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া বাংলা একাডেমি আইনের ৩-এর ২ ধারা অনুযায়ী বাংলা একাডেমি একটি সংবিধিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান। এটি পরিচালনা করবে কার্যনির্বাহী পরিষদ। এ পরিষদে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন করে সদস্য থাকবেন। এ ছাড়া থাকবেন একাডেমির মহাপরিচালকসহ শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিজগতের অন্য সদস্যরা। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে তারাই নেবেন।
কিন্তু এ বছর আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে বাংলা একাডেমির স্বকীয়তা নষ্টের চেষ্টা করা হচ্ছে।
‘আমরা সংবাদমাধ্যম সূত্রে জেনেছি, সম্প্রতি সংস্কৃতিসচিব মো. আবুল মনসুর বাংলা একাডেমিতে গিয়ে একাডেমির কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকি দিয়েছেন, বইমেলাকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছেন। একাডেমির কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘‘কিসের স্বায়ত্তশাসন! আপনারা সবাই মন্ত্রণালয়ের অধীন। আপনারা যদি সের হন, মন্ত্রণালয় সোয়া সের,’ বিবৃতিতে ঘটনার উল্লেখ করে বলেন লেখক-শিল্পীরা।
তারা বলেন, সংস্কৃতিসচিবের অসৌজন্যমূলক আচরণে তারা স্তম্ভিত, মর্মাহত। সচিব কার্যত সংসদে পাসকৃত আইন লঙ্ঘন করেছেন। তারা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট সচিবের অপসারণ চান তাঁরা।
লেখক-শিল্পীরা বিবৃতিতে বলেন, শিল্প-সাহিত্যে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ চলবে না। তারা চান না ভবিষ্যতে বাংলা একাডেমির অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ হোক।
বিবৃতিদাতারা হলেন মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, শামীম আজাদ, হাফিজ রশিদ খান, ফেরদৌস নাহার, খালেদ হোসাইন, শামীম রেজা, শোয়াইব জিবরান, রাজীব নূর, হেনরী স্বপন, শামীম শাহান, শাহেদ কায়েস, কাজল কানন, আহমেদ শিপলু, সাকিরা পারভীন, অতনু তিয়াস, অরবিন্দ চক্রবর্তী, হামিম কামাল, শরাফত হোসেন, মীর রবি, লোপা মমতাজ, শারমিনুর নাহার, হাবিবুল্লাহ ফাহাদ ও হাসান হামিদ।