কলম্বিয়ায় জয়ী বামপন্থিরা

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email

একতা বিদেশ ডেস্ক : লাতিন আমেরিকায় বামপন্থার অগ্রগতির পথে এক মাইলফলক সূচিত হলো। একটানা দক্ষিণপন্থিদের শাসনে থাকা, এই মহাদেশে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মার্কিন-মিত্র কলম্বিয়ায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হলেন বামপন্থি গুস্তাভো পেত্রো। ১৯ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের চূড়ান্ত দফায় তিনি পরাস্ত করেছেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী, নির্মাণ বাণিজ্যের রাঘববোয়াল রোডোলফো হার্নান্ডেজকে। পেত্রো পেয়েছেন ৫০.৪ শতাংশ ভোট। হার্নান্ডেজ ৪৭.৩ শতাংশ। প্রাক্তন গেরিলা যোদ্ধা, বোগোতার প্রাক্তন মেয়র পেত্রোর জয়ে কলম্বিয়ার অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নীতির গুরুতর পরিবর্তন ঘটে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পেত্রোর জুড়ি হিসাবেই উপ রাষ্ট্রপতি পদে জয়ী হয়েছেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ কলম্বিয়ান মহিলা ফ্রান্সিয়া মার্কেজ। লাতিন আমেরিকায় এই ঘটনাকে ‘রাজনৈতিক ভূমিকম্প’ বলেই দেখা হচ্ছে। কিউবার পরে ভেনেজুয়েলা, চিলি, নিকারাগুয়া, পেরু, হন্ডুরাসে বামপন্থি সরকার তৈরি হয়েছে। কোনও কোনও দেশে বামপন্থিরা শাসনক্ষমতায় এলেও পরে সামরিক অভ্যুত্থানের মুখে পড়েছে। কোথাও ভোটে হেরেও পরে আবার জয়ী হয়ে এসেছে। কিন্তু কলম্বিয়ার দক্ষিণপন্থি শাসনে এযাবৎ চিড় ধরানো যায়নি। ওয়াশিংটনের বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসাবেই কাজ করেছে বোগোতার সব সরকার। বিশ্ববন্দিত সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের স্বদেশ কলম্বিয়ায় যেন ‘শতাব্দীর নিঃসঙ্গতা’ কেটে গেল এই পরিবর্তনে। গুস্তাভো পেত্রো নিজে ছিলেন একদা সক্রিয় এম-১৯ গেরিলা গোষ্ঠীর সদস্য। ধরা পড়ে জেল খাটেন। পরে এই গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তি হয়। পেত্রো নির্বাচনে অংশ নিয়ে সেনেটর হন। বোগোতার মেয়রও হন। এর আগেও দু’বার তিনি রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। কলম্বিয়ায় দারিদ্র, বৈষম্য তীব্র। ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি ইভান ডুকের অর্থনৈতিক সংস্কারের বিরুদ্ধে দেশে প্রতিবাদ জোরালো হতে থাকে। গত বছর দেশব্যাপী তুমুল বিক্ষোভ হয়। পুলিশ ও আধা সেনাদের বর্বর আক্রমণের মুখে পড়েন প্রতিবাদকারীরা। রাস্তার লড়াই থেকেই ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকেন বামপন্থিরা। পরিবর্তনের দাবি জোরালো হতে থাকে। পেত্রো বামপন্থি মঞ্চ ‘হিস্টোরিক প্যাক্ট’-এর নেতা হিসাবে নির্বাচিত হন। এই জোটে কমিউনিস্টরাও রয়েছে। পথের লড়াইয়ের প্রতিফলন পড়েছে ভোটে। বিশেষ করে গরিব মানুষ, আফ্রো-কলম্বিয়ান, আদিবাসী মানুষের ঢালাও সমর্থন পেয়েছেন পেত্রো। বামপন্থিদের বিরুদ্ধে লাগাতার শারীরিক আক্রমণের ইতিহাস রয়েছে কলম্বিয়ার। গত এক দশকে তা নতুন করে জোরদার করে শাসক দলগুলি। অতীতে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হয়েও নিহত হন এম-১৯ গোষ্ঠীর নেতা কার্লোস পিজারো। এবারও আক্রমণের খবর থাকায় নির্বাচনী প্রচার কিছুদিনের জন্য স্থগিত রাখতে হয়েছিল পেত্রোকে। দক্ষিণপন্থি গোষ্ঠী ছাড়াও মাদক ব্যবসায়ীদের চক্র বামপন্থিদের হত্যার অভিযানে জড়িত ছিল। পেত্রোর জয়ে বোগোতা সহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় রাস্তায় নেমে উল্লাস প্রকাশ করছেন মানুষ। বৃষ্টির মধ্যেই হাজার হাজার মানুষ বোগোতার রাস্তায় নেমে পড়ে গান-নাচ করতে থাকেন। এই প্রথম ‘প্রকৃত’ পরিবর্তনের স্বাদ পাওয়া যাবে বলে তাঁদের অনেকেই সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন। এমনই একজন আন্দ্রেস ফেলিপে ব্যারেরো বলেছেন, ‘ইতিহাসের বেড়া ভেঙে গেছে; ২০০ বছর আগে স্বাধীন হবার পর থেকে এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি’। ‘কলম্বিয়ায় নতুন মুহূর্ত’, বলেছেন পিস অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন ফাউন্ডেশনের লুই এডুয়ার্ডো সেলিস। শিক্ষাবিদ লুসিমার অ্যাসপ্রিলা এএফপি’কে বলেছেন, আশা তৈরি হয়েছে, এ তারই উৎসব। পেত্রোর কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্রের মোকাবিলা, পেনশনের সংস্কার, অনুৎপাদনশীল জমির ওপরে বর্ধিত কর। নয়া উদারনীতির বিরুদ্ধে ঝাঁঝালো সমালোচনা শোনা গেছে তাঁর মুখে। পরিবেশ রক্ষার প্রশ্ন এবারের নির্বাচনে বড় আকারে সামনে এসেছে। কলম্বিয়ার ও বহুজাতিক খনি কোম্পানিগুলির তরফ থেকে পেত্রোকে আটকানোর চেষ্টাও করা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব বাধতে পারে। কলম্বিয়ার অন্যতম বড় সমস্যা দশকের পর দশক ধরে চলা সংঘাত। একদিকে দীর্ঘ সময় ধরে গেরিলা লড়াই চালানোর পরে বামপন্থি রিভলিউশনারি আর্মড ফোর্সেস অফ কলম্বিয়া (ফার্ক) গোষ্ঠীর সঙ্গে ২০১৬ সালে সরকারের শান্তিচুক্তি হয়। প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ও ৭০ লক্ষ মানুষের বাস্তুচ্যুতির পরে এই চুক্তি আপাত শান্তি এনে দিয়েছে। কিন্তু বিদায়ী রাষ্ট্রপতির আমলে এই চুক্তির সমস্ত ধারা কার্যকর হয়নি। পেত্রো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এই চুক্তি রূপায়ণ করবেন। বোগোতায় জয়ের পরে পেত্রো বলেছেন, কলম্বিয়া পালটে যাচ্ছে। এমন এক পরিবর্তন যা ভালোবাসার রাজনীতির দিকে আমাদের নিয়ে যাবে। বোঝাপড়ার রাজনীতি চালু করবে। বিরোধীদের সঙ্গে কথাবার্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। উপ রাষ্ট্রপতি ফ্রান্সিয়া মার্কেজ বলেছেন, এমন এক শান্তির নির্মাণ করতে হবে যা সামাজিক ন্যায় নিশ্চিত করে। লাতিন আমেরিকার বামপন্থি নেতারা পেত্রোর জয়ে স্বভাবতই খুশি। ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরো বলেছেন, কলম্বিয়ার মানুষের আকাঙ্ক্ষা রূপ পেয়েছে, গণতন্ত্র ও শান্তির পথে যাত্রা সুরক্ষিত হবে। ভেনেজুয়েলার সঙ্গে সম্পর্ক পেত্রোর নীতির অন্যতম আলোচ্য বিষয় হবে। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি ডুকে মাসুরো সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। বরং সদ্যই আমেরিকান শীর্ষ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রপতির পাশে দাঁড়িয়ে বলে এসেছিলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা শরণার্থীদের কলম্বিয়ায় স্বাগত জানানো হচ্ছে। পেত্রো নিজে ভেনেজুয়েলার সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার পক্ষপাতী। চিলির রাষ্ট্রপতি গ্যাব্রিয়েল বোরিক টুইটে লিখেছেন, ‘লাতিন আমেরিকার পক্ষে আনন্দের দিন!’ অন্যদিকে আশঙ্কার মেঘ ওয়াশিংটনে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছেন, নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে তিনি উৎসুক। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য লাতিন আমেরিকায় ওয়াশিংটনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত স্তম্ভই ভেঙে পড়ল। কলম্বিয়ায় বামপন্থিদের খতম করার জন্য আমেরিকার বৃহত্তম আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দিয়েছিল হোয়াইট হাউস। ‘প্ল্যান কলম্বিয়া’ নামের সেই প্রকল্প ২০০০-র প্রথম দিক থেকে চালু হয়। সেই সম্পর্কে ফাটল ধরতে চলেছে। গণশক্তি অবলম্বনে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..