হাফ পাস চালুর দাবি এখনও করতে হচ্ছে, কেন?

Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn StumbleUpon Email
মীর মোশাররফ হোসেন : এটা এখনও ‘দাবি’। সেটা করতেও হচ্ছে। কী দুর্ভাগ্য আমাদের। অথচ এই দাবি কি নতুন? মোটেও নতুন নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের দাবি। দেশ নাকি উন্নত হতে হতে চাঁদে পৌছে গেছে। সম্ভবত সেই কারণেই মাটিতে থাকা ন্যায্য দাবিগুলো ক্ষমতাসীন আর তাদের সঙ্গী মাফিয়াদের চোখে পড়ছে না। দেশটা তো লুটেপুটে খাওয়া কারবারিদের হাতে চলে গেছে। সে কারণে ন্যায্য, যৌক্তিক এবং খুবই জরুরি ‘হাফ পাস’ও দাবি করতে হচ্ছে। অথচ এটা এমন কোনো রকেট সায়েন্স নয়, আশপাশের দেশগুলোতেই গণপরিবহনে শিক্ষার্থীরা যে কনসেশন পায় তার নজির পাওয়া যাবে। এই হাফ পাস কার্যকর হলে অর্থনীতি জটিল অংকের মারপ্যাঁচেও পড়বে না; সরকারি তহবিলে টান পড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে কেন এত ‘পাশ কাটানো’? গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া বা ‘হাফ পাসের’ কথা ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানো পরবর্তী বাস ভাড়া বৃদ্ধিতে। ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়লে বাজারে অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়ে, তা কারোই অজানা নয়। এর পাল্টায় মানুষের আয় বাড়ানোর কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার? মহামারীতে মানুষের পকেটের যে কী হাল, তা নিয়ে একটার পর একটা সমীক্ষা-গবেষণা এসেছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম যখন কম ছিল, তখনও সরকার ফিক্সড প্রাইসের নামে মানুষের পকেট থেকে জ্বালানির দাম বেশি নিয়ে ব্যবসা করেছে; তখন মন্ত্রীরা এখানে-সেখানে বলেছিলেন, আমরা ফিক্সড প্রাইস রাখলাম, পরে বিশ্ব বাজারে দাম বাড়লেও আমরা বাড়াবো না। যাই হোক, আওয়ামী লীগের এই শাসনামলে মন্ত্রী-এমপিদের কথায় তারাই ভরসা রাখতে পারে, যারা ‘ঘুমে থাকে, যাদের হিসাব থাকে না’। একটা বৈশ্বিক বাজে পরিস্থিতি চলছে, লম্বা সময় অনেক কিছু বন্ধ ছিল; অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, বেতন কমেছে, সেসময় সরকার একটা নামমাত্র প্রণোদনা দিয়েছিল, যার সিংহভাগই আবার তার দলের নেতাকর্মীদের পকেটে ঢুকে গেছে। এরপর মাত্র দুনিয়ার চাকা সচল হওয়া শুরু হল, বাজারের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সবকিছুর দাম ইচ্ছেমতো বাড়ছে, তার মধ্যে ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়িয়ে নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তকে খাদের কিনারায় ঠেলে দেওয়া হল। মড়ার ওপর খাড়ার ঘাঁ, বাস-ট্রাক-লঞ্চ মালিকরা কথা নাই বার্তা নাই ধর্মঘট করে, মানুষকে জিম্মি করে ভাড়া বাড়িয়ে নিলেন। তাও যা বেড়েছে, সেটা অলমোস্ট কোথাও নেওয়া হচ্ছে না, নেওয়া হচ্ছে তার চেয়েও বেশি। এই সময়ে শিক্ষার্থীরা যদি হাফ পাসের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে, তা কি খুব বেশি অন্যায়? শিক্ষার্থীরা কি আয় করে? তাদের আয় তো সেই পরিবার থেকেই আসছে যে পরিবারগুলো মহামারী, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের দামের রেকর্ড বৃদ্ধিতে খাবি খাচ্ছে। সরকার কী এখন চায়, বর্ধিত বাস ভাড়া দিতে না পেরে শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিক? আন্দোলনের চাপে এখন মন্ত্রী-এমপিদের কথায় নরম সুর দেখা যাচ্ছে। এমনটা সড়ক আন্দোলনের সময়ও দেখা গেছে। হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা। হয়েছে কচু। এখন আবার পানি ঘোলা করতে তারা নেমে পড়েছেন। সাধু সাজছেন। শিক্ষার্থীদের মাথায় হাত বুলাচ্ছেন, কেউ কেউ হাফ বাড়ার পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করছেন। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী আবার প্যাচ দিয়ে রেখেছেন- তিনি বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের জন্য যৌক্তিক ভাড়া’ নির্ধারণ করা উচিত। এ ধরনের বক্তব্যের ফল কী হয়, তা আমরা দেখেছি। প্রতিবার ভাড়া বাড়ানোর সময় তারা জনগণের জন্য ‘যৌক্তিক ভাড়া’র কথা বলে শেষে বাস মালিকদের চাওয়ার কাছাকাছি ভাড়াতেই রাজি হয়ে যায়। না হয়ে কী করবে, মালিকপক্ষে তো এমপিরাই। যে এগারো দফার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র পাকিস্তানি ভাবধারাকে লাথি মেরে মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, সেখানেও দাবি করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের ‘কনসেশন’ দেওয়ার জন্য। এমনকি দূরের যাত্রাও যেন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ‘হাফ ভাড়া’ নেওয়া হয়, স্পষ্ট ভাষায় তাও বলা আছে। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, শ্রমিক-কৃষক সাধারণ মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে; সেই আকাঙ্ক্ষাকে শাসকশ্রেণি যেভাবে পদদলিত করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে উল্টো পথে হাঁটিয়ে পাকিস্তানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, একই ঘটনা ঘটেছে হাফ ভাড়ার দাবি নিয়েও। এত বছর পরে এসেও শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামতে হচ্ছে হাফ ভাড়া চেয়ে, সড়কে সহপাঠীর মৃত্যুর বিচার চেয়ে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশ নাকি হয়ে যাচ্ছি আমরা। রাজধানীর গণপরিবহন আর সড়ক ব্যবস্থাপনার দিকে তাকালে সেটা মনে হয় না। পৃথিবীর দেশে দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য বাস ভাড়ায় কনসেশন; কোথাও কোথাও ফ্রি। আর আমাদের এখানে পুরো টাকা তো নেবেই, হাফ ভাড়ার দাবি জানালে শুনতে হবে ‘মামার বাড়ির আবদার?’। কেন? গণপরিবহন সংশ্লিষ্টরা যে সরকারি সহযোগিতা পান, তা কি সরকার বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। এগুলো জনগণের পকেটের টাকা না, ট্যাক্সের টাকা না? জনগণ ট্যাক্স দেয় কেন? সে অনুপাতে নাগরিক সুবিধা কই? এক আলোচনায় দেখলাম, বাস মালিকরা গোঁ ধরে বলছেন, শিক্ষার্থী ভাড়া হাফ হয়ে গেলে, আরও অনেক সেক্টরের লোকেরাই হাফ ভাড়া চাইবে। তাহলে তাদের বিরাট লোকসান হয়ে যাবে। এইসব তেলেসমাতির জন্য দায়ী আসলে জবাবদিহিহীন সরকার। এতদিন হয়ে গেল খোদ রাজধানীর গণপরিবহনকেই ঠিক করতে পারলো না তারা। বছর বছর সিটি করপোরেশনের মেয়র কিংবা নির্বাচনের মাইক বাজিয়েই চলেছে। মানুষের হাঁটার জায়গা নেই; ফুটপাত দখলে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রাইভেটকার। যেসব বাস চলে সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ, এটা-সেটা বিকট সমস্যা। জনগণ সরকারের কাছে জিম্মি, বাস মালিকদের কাছেও জিম্মি। ডিজেলের দাম বাড়ল। রাতারাতি সব বাস ডিজেলচালিত হয়ে গেল। জনগণ কর দেয়, সরকারের কাজ হচ্ছে সেই করের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা; বিভিন্ন খাতে জনগণের খরচ যেন কমে আসে তা নিশ্চিত করা। তা না করে, আমাদের সরকারগুলোর কাজ থাকে জনগণের টাকা লুটপাট করা, কিংবা লুটপাটের ব্যবস্থা করে দেওয়া। নিজেদের হাতে না রেখে সব বেসরকারিকরণ করে দেওয়া। গণপরিবহন কেন বেসরকারি খাতে থাকবে; কেন সরকারের অংশীদারিত্ব আরও জোরদার হবে না। সবই যদি বেসরকারি খাতে দিতে হয়, তাহলে সরকারের কাজ কী হবে? জনগণের মাথায় ছড়ি ঘোরানো, আর মাসে মাসে বেতন তোলা। শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান, বাসে হাফ ভাড়া বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত কোনো আশ্বাসে ভোলা যাবে না। এর আগের আশ্বাসগুলোর পরিণতি কী হয়েছে, তা তো আমরা সবাই জানি। কনসেশনের নামে হাফ ভাড়ার বেশি নির্ধারিত হওয়ার চান্সও থাকছে। আর যদি হাফ ভাড়ার ঘোষণা আসেও তাহলেই সব শেষ হবে না, বাসগুলো সত্যি সত্যি হাফ ভাড়া নিচ্ছে কিনা, সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টিও রাখতে হবে। অনেক সময় ইস্যুর পর ইস্যুর চাপে যৌক্তিক দাবির ইস্যু নিচে চলে যায়; শত চাপেও যেন নিজেদের অধিকার আদায়ের ইস্যু আড়ালে না চলে যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

Print প্রিন্ট উপোযোগী ভার্সন



Login to comment..
New user? Register..