বাজেটে যুব কর্মসংস্থানের সুযোগ কম

Posted: 16 জুন, 2019

মামুন কবীর : ১৩ জুন আগামী অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এটি জিডিপির ১৮ দশমিক ১ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট এটি। এ বাজেটে নতুন অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২০ ধরা হয়েছে। বরাবরের মতো ঘোষণাকৃত ঘাটতি বাজেটে এবারের ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। প্রত্যক্ষ করছিলাম যুব উন্নয়নে, যুব কর্মসংস্থানে সরকার কি ভূমিকা নেয় তা দেখার জন্য। অনেক গালভরা বুলি নিয়ে কথা আর প্রতিশ্রুতি দিলেও এবারের বাজেটে তার কিছুই পরিলক্ষিত হলো না। এই ৫ লক্ষ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেটে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ মাত্র ১০০ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের .০২ শতাংশ। আর ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি কর্মসংস্থান তৈরি করে বেকারত্বের অবসান ঘটাতে চান অর্থমন্ত্রী। বিশেষ জনগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন তিনি। যা মোট বাজেটের .০২ শতাংশ। তাও আবার ১০ বছর মেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসাবে এই ১০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। ১০০ কোটি টাকা যদি ১০ বছরের জন্য রাখা হয় তবে প্রতি বছর ১০ কোটি টাকা হলে তা এবছরের জন্য মোট বাজেটের .০০২ শতাংশ হিসাবে ধরে নেওয়া যায়। বাংলাদেশের মোট বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই বরাদ্দ দেওয়া হয়নি এটা পরিষ্কার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। আইএলও, বিশ্বব্যাংক, কমনওয়েলথ হিসাব দিয়েছে, গত এক দশকে বেকারত্বের হার বেড়েছে ১.৬ শতাংশ। যদিও সরকার বলছে বেকারের সংখ্যা ২৬ লক্ষ যা বিবিএস এর গবেষণায় এসেছে। আইএলও মনে করে, বেকারত্বের হার বেশি হলে তা সরকারের জন্য ডিসক্রেডিট এবং ব্যর্থতা হিসেবে ধরা হয়। তাই যেকোন সরকারই বেকারের সংখ্যা কম দেখাতে চায়। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রতিবেদনে দেখা যায় ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সের ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ-তরুণীর অবস্থা হলো তারা পড়াশুনাও করছে না আবার কোন কাজেও নেই। গত বছর এই শ্রেণীর তরুণের হার ছিল ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এবছর তা ২ শতাংশেরও বেশি বেড়ে গিয়ে হয়েছে ২৯.৮ শতাংশ। আরেক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকার প্রায় পৌনে এক কোটি। প্রতি বছর এর সাথে নতুন নতুন বেকার যুক্ত হচ্ছে। এসকল বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কিভাবে তৈরি হবে তার কোন সঠিক দিক নির্দেশনা পাওয়া গেলো না বাজেট পরিকল্পনায় এবং বরাদ্দে। সামন্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং দেশীয় বাস্তবতার নিরিখে আমাদের দেশে রাষ্ট্রের কর্মচারী হওয়াটাকে সবাই নিশ্চিন্ত জীবন মনে করে। কারণ এখানে মোটা অঙ্কের বেতন, ঘুষসহ অন্যান্য সকল প্রকার সুবিধা অবারিত। আর বাকি সকল কর্মক্ষেত্রগুলোই আমাদের দেশে চ্যালেঞ্জিং। কর্মজীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই সকলেই চায় রাষ্ট্রের কর্মচারী হয়ে নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করতে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এর তরুণদের নিয়ে একটি জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৮২ শতাংশ তরুণ দেশে থাকতে চায় না। কারণ তারা মনে করে নিজেদের দেশে সবার জন্য সমান সুযোগ নেই। জরিপে প্রশ্ন ছিল, সমাজে কোন কোন ঘাটতি তাদের জীবনযাপন ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় প্রভাব ফেলছে। তারা এ জন্য পাঁচটি বাধার কথা বলেছেন। অর্ধেক তরুণই বলেছেন, তাদের সমাজে অসমতাই বড় প্রতিবন্ধকতা। এ ছাড়া তরুণেরা মনে করেন, দেশে তারা নির্ভয়ে জীবনযাপন করতে পারছেন না, নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন না, নিজের পছন্দের জায়গায় কাজ করা যায় না এবং ন্যায্য বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সম্ভব হয় না। অথচ নিশ্চিন্ত কাজের পরিবেশ পেলে তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে আরও অনেকখানি। তারা বিদেশে গিয়ে কাজ করে সেসব দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখছে বিভিন্ন সেক্টরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে জানা যায়, ব্যাংকিং খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এক কোটি টাকার ওপরে আমানত রেখেছেন, এমন গ্রাহক রয়েছেন ৪৫ হাজার এরও বেশি। পাঁচ বছরের মাথায় কোটিপতির সংখ্যা দ্বিগুণ হলেও চাকরিতে নিয়োগদানের হার মাত্র ২০ শতাংশ। ধনীদের এসব সম্পদ উৎপাদনশীল কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থানের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশে থাকলেও বাংলাদেশে তা হচ্ছে না। ফলে ক্রমেই বাড়ছে বেকারত্ব। একই সঙ্গে দেশে বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি না হওয়ায় উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে না। এদিকে ২০১৪ সালে জঙ্গিবাদী ইসলামী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর আবির্ভাবের পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তরুণ-যুবকরা সেই মৌলবাদী দলের সাথে যুক্ত হচ্ছে। আর সেই তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। বেকার, হতাশ তরুণ ও যুব সমাজের মধ্যে মৌলবাদের ঝুঁকিকে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এরকম পরিস্থিতিতে সরকারকে প্রথম নজর দেওয়া দরকার ছিল যুব সমাজের দিকে, শিক্ষিত এবং শিক্ষাহীন বেকার শ্রেণির দিকে। কিন্তু বাজেটে তেমন কোন পরিকল্পনার দেখা পাওয়া গেল না সরকারের তরফ থেকে। বেকার যুবকের উন্নয়ন, কর্মসংস্থানের সুযোগের বিপরীতে দেখা যাচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে সরকারের নজর বেশি রয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন বেকার যুব সমাজের উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানের। ঢেলে সাজাতে হবে যুব সমাজের জন্য পরিকল্পনা। কোটি যুবক বেকার রেখে ৮.২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির পরিকল্পনা অমূলক। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এবং সাসটেইনএবল ডেভেলপমেন্ট গোল বাস্তবায়নে ?বাজেটে যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ রেখে গণমুখী যুববান্ধব বাজেট প্রণয়ন যুব সমাজের দাবি হলেও বাজেটে তা প্রতিফলিত হয়নি। উন্নয়ন পরিকল্পনায় যুব-তরুণদের সম্পৃক্ত করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এবং স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে হলে অবশ্যই যুবকদের চাহিদা মাফিক উন্নয়ন কৌশল, পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন। লেখক : তথ্য গবেষণা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর কমিটি