‘স্বায়ত্তশাসিত’ থেকে ‘সরকারি’: বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় আইনগুলোর পশ্চাৎমুখী বিবর্তন

Posted: 19 মে, 2019

অভিনু কিবরিয়া ইসলাম : বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার পরিবেশ নিশ্চিত করতে স্বায়ত্তশাসনের যে বিকল্প নেই– সে বিষয়ে নতুন করে তর্কের প্রয়োজন বোধহয় নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কেবলমাত্র পাঠদান করা নয়, বরং নতুন জ্ঞান সৃজন ও গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসন কতটুকু আছে, সেই প্রশ্ন তুলতে গেলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলোর দিকে, আইনগুলোর বৈষম্যের দিকে আমাদের তাকাতে হয়। নিজেদের বোঝার সুবিধার্থে আমরা প্রায়ই যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩-এর আইন বা অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলছে তাদের স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় বলি, আর বাকিগুলোকে বলি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়– যদিও এ ধরনের কোনো বিভাজন অন্তত অফিসিয়ালি নেই। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে ৭৩ সালের আইন ও অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, কিন্তু সেখানেও নানাভাবে দলীয়করণসহ, সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকা স্বায়ত্তশাসনকে খর্ব করছে, এ আলোচনা আমরা শুনতে পাই। কিন্তু এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বাদবাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা যে আরো শোচনীয়, প্রান্তিক অবস্থানের কারণেই বোধহয় সে বিষয় আলোচনায় সেভাবে আসে না। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরো স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করা দরকার ছিলো, সেখানে সময়ের সাথে সাথে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আইনগতভাবেই আরো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে এবং শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তাদের মতামত প্রদানের জায়গাগুলোকে সংকুচিত করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলো পর্যালোচনা করে আমাদের সামনে এই চিত্রটিই ফুটে ওঠে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের ইসলামীকরণের যে ধারা শুরু হয়েছিলো, তার ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইনটি পাস হয়। ৭৩-এর আইনগুলোর থেকে এর কিছু মৌলিক পার্থক্য আমরা লক্ষ্য করি। ৭৩-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইনগুলো আমরা দেখি সেখানে চ্যান্সেলর ভাইস-চ্যান্সেলরকে নিয়োগ দেন সিনেটে নির্বাচিত তিন সদস্যের একটি প্যানেল থেকে। সিনেটে শিক্ষক-ছাত্র-রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েটের প্রতিনিধি থাকায়, ভাইস চ্যান্সেলর নির্বাচনে শিক্ষক-ছাত্রদের মতামত দেয়ার সুযোগ থাকে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে সেখান থেকে সরে আসা শুরু হয়। এই আইনের ১০ এর ১ ধারায় বলা আছে ‘চ্যান্সেলর যে শর্তাবলী নির্ধারণ করিয়া দিবেন, সেইমতো তিনি চার বৎসরের জন্য ভাইস-চ্যান্সেলর নিয়োগ করিবেন’। সুতরাং রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহীকে নিয়োগ দেয়া হবে। এই বিধান, এর পরে যে সকল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে, তার আইনে দু-একটি শব্দের হেরফের করে রেখে দেয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক বলে পরিচিত সরকারগুলো এর কোনো পরিবর্তন আনে নি, সামরিক শাসকের আমলের আইনের এই ধারাকে তারা রেখে দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ১০ এর ১ ধারাতে বলা আছে, ‘চ্যান্সেলর, তদ্কর্তৃক নির্ধারিত শর্তে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ এমন একজন ব্যক্তিকে চার বৎসর মেয়াদের জন্য ভাইস-চ্যান্সেলর পদে নিয়োগদান করিবেন’। অন্যান্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনেও তাই। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে সিনেটের কোন অস্তিত্ব নেই। সিন্ডিকেটেও শিক্ষক বা ছাত্রদের নির্বাচিত প্রতিনিধির কোনো সুযোগ নেই। দুজন ডিন থাকবেন বটে, তাও আবার পালাক্রমে চ্যান্সেলর ও সিন্ডিকেট কর্তৃক মনোনীত। (ইবি আইন, ১৯/১/ঙ) দুইজন শিক্ষকও থাকবেন, তারাও মনোনীত হবেন চ্যান্সেলরের দ্বারাই। অর্থাৎ চ্যান্সেলরের অনুগ্রহ ব্যতীত বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী ফোরামে কারো প্রবেশাধিকার নেই। এই ধারাবাহিকতাও পরবর্তীতে অন্যান্য আইনগুলোতে কমবেশি বহাল আছে (শাবিপ্রবি ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট থাকলেও তাতে শিক্ষক প্রতিনিধির সংখ্যা কম, সিনেটের ক্ষমতাও খর্বিত)। যদিও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রিজেন্ট বোর্ড’ (সিন্ডিকেটের বদলে এখানে রিজেন্ট বোর্ড থাকে)-এ নির্বাচিত তিনজন শিক্ষক প্রতিনিধি থাকার কথা আছে, যারা সকল শিক্ষকের ভোটে নির্বাচিত হবেন না, নির্বাচিত হবেন একাডেমিক কাউন্সিল দ্বারা। সেই একাডেমিক কাউন্সিলেরও গঠন এমন, যাতে শিক্ষকদের প্রকৃত মতামতের প্রতিফলন ঘটানো বেশ দুরূহ। স্বায়ত্তশাসিত বলে পরিচিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিন নির্বাচন হয় না, জেষ্ঠ্যতার ভিত্তিতে ডিন নিয়োগ দেয়া হয়, ফলে তার জবাবদিহিতার জায়গাও থাকে না। সবমিলিয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবিধি বা প্রবিধান তৈরি করার যে সকল কাঠামো আছে, তাতে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের সুযোগ নেই বা একেবারেই সীমিত। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্থ কমিটিতেও সাধারণ শিক্ষকদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে আরেকটি যে ধারা যুক্ত হয় যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনকে আরো সীমিত করে দেয়, তা হলো ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের কোন সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবের সাথে ভাইস-চ্যান্সেলর একমত না হইলে, তিনি সেই সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবের বাস্তবায়ন বন্ধ রাখিতে পারেন এবং রায়ের জন্য চ্যান্সেলরের নিকট তাহা পাঠাইতে পারেন এবং সেই ব্যাপারে চ্যান্সেলরের রায় চূড়ান্ত হইবে’। (১১ এর ৮ উপধারা, ইবি আইন)। এই ধারাটিই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইনে বলবৎ আছে একটু এদিক ওদিক করে। অথচ ‘স্বায়ত্তশাসিত’ বলে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধারায় চ্যান্সেলর নয়, সিন্ডিকেটই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আবার সিন্ডিকেট যেহেতু সিনেটের কাছে দায়বদ্ধ থাকে, সেখানে কিছুটা সুযোগ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেকহোল্ডাদের মতামত প্রতিফলিত করার। ‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়’ এ সে সুযোগ কোথায়? স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, ‘সরকারি’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এর মতের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও বডির কোনও সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব নেয়া কার্যত অসম্ভব। ভাইস-চ্যান্সেলরকে যেহেতু চ্যান্সেলর নিজেই নিয়োগ দেন, তাও আবার রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর পরামর্শ অনুযায়ী, সুতরাং ভাইস চ্যান্সেলরের শুধুমাত্র চ্যান্সেলর বা সরকারের প্রতি অনুগত থাকলেই চলে। রাষ্ট্রও এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণও স্থাপন করতে সক্ষম হয়। শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতির ব্যাপারেও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে বলা হয়েছে, ‘উশৃঙ্খলতা, অযোগ্যতা, অসদাচারণ অথবা নৈতিক অধঃপতনের’ কথা। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইনে আছে, ‘কর্তব্যে অবহেলা, অসদাচরণ, নৈতিক স্খলন বা অদক্ষতার’ কথা। অন্যদিকে, ‘স্বায়ত্তশাসিত’ চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে এ বিষয়ে লেখা আছে কেবলমাত্র ‘moral turpitude or inefficiency’-এর কথা। শিক্ষকদের ‘উশৃঙ্খলতা’, ‘অসদাচরণ’ কিংবা ‘কর্তব্যে অবহেলা’ কীসে হবে, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। কর্তৃপক্ষের সাথে ভিন্নমত পোষণ করাকে প্রশাসন যদি ‘উশৃঙ্খলতা’, ‘অসদাচরণ’ হিসেবে গণ্য করে, কিংবা আন্দোলনের কোন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করলে তা যদি ‘কর্তব্যে অবহেলা’ হয়, তাতে শিক্ষকরা শাস্তি পেতে পারেন– এমনকী তার চাকুরীও চলে যেতে পারে। এত কিছুর পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে রাষ্ট্র। ১৯৮৭ সালে পাশ হয় দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাবিপ্রবির আইন। এই আইনে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অগণতান্ত্রিক ধারাগুলো মোটাদাগে বহাল তো ছিলোই উপরন্তু চ্যান্সেলরকে আরো ক্ষমতাবান করতে আরো একটি ধারা যুক্ত করা হয়, যা পরবর্তীতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনেও যুক্ত হয়। ধারাটি হলো- ‘চ্যান্সেলরের নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কাজকর্ম গুরুতরভাবে বিঘিœত হওয়ার মত অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করিতেছে, তাহা হইলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালু রাখার স্বার্থে প্রয়োজনীয় আদেশ ও নির্দেশ দিতে পারিবেন এবং অনুরূপ আদেশ ও নির্দেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য বাধ্যতামূলক হইবে এবং ভাইস-চ্যান্সেলর উক্ত আদেশ বা নির্দেশ কার্যকর করিবেন।’ (১০ এর ৪ উপধারা, শাবিপ্রবি আইন/ ৯ এর ৫ উপধারা, যবিপ্রবি আইন) সুতরাং চ্যান্সেলর চাইলে কিংবা তার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে বলে ‘প্রতীয়মান’ হলে তিনি যেকোনো আদেশ বা নির্দেশ দিতে পারবেন, যা মানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সকলেই বাধ্য। সুতরাং রাষ্ট্রের কোনও নীতির বিরুদ্ধে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থান নেয়া কিংবা সে লক্ষ্যে কোনও কর্মসূচি পালন কার্যত অসম্ভব। এই আদেশ নির্দেশের ধরন কেমন হবে, তাও নির্দিষ্ট করা নেই। স্বায়ত্তশাসিত ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির শর্তাবলী অংশে স্পষ্ট করা ছিলো, ‘The service conditions shall be determined without aû prejudice to the freedom of the teacher or officer to hold any political views and to keep association with any lawful organisation outside the University and shall be clearly stated in the contract.’ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে এই ধারাটি ফেলে দেয়া হয় এবং পরবর্তীতে শাবিপ্রবি আইনে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়, ‘কোনও শিক্ষক বা কর্মকর্তার রাজনৈতিক মতামত পোষণের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন না করিয়া তাঁহার চাকুরির শর্তাবলী নির্ধারণ করিতে হইবে, তবে তিনি তাঁহার উক্ত মতামত প্রচার করিতে পারিবেন না বা তিনি নিজেকে কোনও রাজনৈতিক সংগঠনের সহিত জড়িত করিতে পারিবেন না’ (শাবিপ্রবি আইন, ৫১ এর ২ উপধারা)। এর পরে এই ধারাটি পরে স্থাপিত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলোতেও দেখা যায়। ৯০ এর আন্দোলনের পর ভোটে নির্বাচিত সরকারগুলো ক্ষমতায় আসলেও তারা নতুন করে যেসকল বিশ্ববিদ্যালয় আইন করেছেন, তাতে এই ধারাগুলোকে তো বাতিল করেনই নাই, বরং আরো আইনগুলোতে আরো অগণতান্ত্রিক ধারা যুক্ত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৯৮ সালের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে যুক্ত করা হয় যে- ‘উপ-ধারা (১) এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, চ্যান্সেলরের সন্তোষানুযায়ী ভাইস-চ্যান্সেলর স্বপদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।’ (১০-এর ২ উপধারা, বশেমুকৃবি আইন)। বলাবাহুল্য এর পরের সরকারগুলো নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ক্ষেত্রে এই ধারাটি রেখে দেন। এই আইনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আরো পাকাপোক্ত হয়, এবং ‘চ্যান্সেলরের সন্তোষানুযায়ী’ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে ভাইস চ্যান্সেলর বাধ্য থাকেন। একদিকে নিয়োগ যেহেতু হচ্ছে চ্যান্সেলরের মাধ্যমে এবং টিকেও থাকতে হচ্ছে ‘চ্যান্সেলরের সন্তোষানুযায়ী’, সুতরাং ভাইস চ্যান্সেলর হবার দৌড়ে এবং ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে টিকে থাকতে মুখ্য যোগ্যতা হয়ে পড়ছে সরকারের তোষণ। আবার চ্যান্সেলরের সন্তুষ্টি থাকলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু ভাইস-চ্যান্সেলরই সর্বেসর্বা– তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সেখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার কোনো দায় নেই উপাচার্যের। সুতরাং একধরনের সামন্তবাদী চর্চার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হচ্ছে, বেতনভূক সরকারি কর্মচারীর মত কেবল পাঠদান করা এবং মাসশেষে বেতন নেয়াই শিক্ষকদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে ১১টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পাশ করা হয়। এই সকল আইনে সিন্ডিকেট প্রতিস্থাপিত হয় রিজেন্ট বোর্ড দ্বারা। এই রিজেন্ট বোর্ডই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পরিষদ, যা এমনভাবে গঠিত যে, সেখানে সাধারণ শিক্ষক বা ছাত্রের মতামত প্রতিফলনের সুযোগ নেই। চ্যান্সেলর তথা সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত ভিসি এই রিজেন্ট বোর্ডে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন, এই রিজেন্ট বোর্ডেই নির্ধারিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধি বা প্রবিধানগুলো। রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকে এই রিজেন্ট বোর্ডের ওপর। এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলোতে ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন ব্যয় ও ছাত্র বেতনাদি’ বিষয়ক নতুন ধারা যুক্ত করা হয়, যাতে লেখা আছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক পরিচালন ব্যয়ের (মূলধন ব্যয় ব্যতিরেকে) নিরীখে প্রতি বৎসর ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট হইতে আদায়যোগ্য বেতন ও ফিস নির্ধারিত হইবে’ (২৮ এর ১ উপধারা, যবিপ্রবি আইন)। অর্থাৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চাইলে প্রতি বছর ছাত্রদের বেতন ফি বৃদ্ধি করতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ বাড়লে, ছাত্রদের বেতনও বাড়বে- অর্থাৎ ‘গিভ এন্ড টেক’ পদ্ধতি। আমরা দেখতে পাই, নতুন স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেতন ফিও ‘স্বায়ত্তশাসিত’ বলে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে কয়েক গুণ বেশি। আইনগুলোর এই সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা থেকে আমরা দেখলাম, ক্ষমতায় যেসকল রাজনৈতিক দল পালাক্রমে এসেছে, তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। এ কারণেই সামরিক শাসকের সময়কালীন আইন পরবর্তী সময়ে টিকে গেছে, সরকারগুলো পূর্বতন সরকারের অগণতান্ত্রিক আইনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে আরো পূর্বতনের চেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। আরো অবাক করা বিষয়গুলো হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ নাগরিক সমাজ এই বিষয়ে কখনোই তেমন একটা সোচ্চার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের জন্য, বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলোর বৈষম্য দূর করে আরো গণতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার সংগ্রাম করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। লেখক: শিক্ষক, যবিপ্রবি। (বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এর উদ্যোগে গত ১১-১২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কনভেনশনে পঠিত বক্তব্য)