মন্ত্রীদের অসংযত বক্তব্যের লাগাম টেনে ধরুন

Posted: 12 মে, 2019

আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন : মধ্যরাতের ভুয়া নির্বাচনের ভুয়া সরকারের মন্ত্রীদের আবোলতাবল কথাবার্তায় দেশের মানুষ যারপরনাই বিনোদিত এবং সমভাবে শঙ্কিত। ৩০ ডিসেম্বরের অদৃষ্টপূর্ব নির্বাচন যাতে আগের দিন ২৯ তারিখ মধ্যরাতেই সিংহভাগ ভোটপর্ব সমাধা হয়ে গিয়েছিল তেমন একটা নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষিত সাংসদরা মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর থেকে জাতিকে একের পর এক দায়হীন মন্তব্য উপহার দিচ্ছেন। সরকারের মন্ত্রীদের পাশাপাশি প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তি ও দলীয় বুদ্ধিজীবীরাও এ বিষয়ে পিছিয়ে নেই। গত কয়েকদিন যাবত তাদের মুখনিসৃত কয়েকটি মন্তব্য উদ্বৃত করছি। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘খেলাপি ঋণ মাফ করে দেওয়া হবে।’ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে তথ্য পাওয়ায় ফণী’র ক্ষতি কমানো গেছে।’ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেছেন, ‘পুণ্যবতী প্রধানমন্ত্রীর দোয়া কবুল হয়েছে বলেই ঘুর্ণিঝড় ফণী ক্ষতি করতে পারেনি।’ রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বলেছেন, ‘সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়া হবে ঢাকা থেকে।’ ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেছেন, ‘ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়।’ টেকনোক্র্যাট কোটায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেছেন, ‘অন্য দেশের মন্ত্রীরা আমাদের পেছনে ঘোরে।’ তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘ঢাকা আকাশ থেকে দেখতে সিঙ্গাপুর বা শিকাগোর মত।’ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যবসায়ী আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘ঢাকার পাবলিক টয়লেটগুলো ফাইভ স্টার হোটেলের মত।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বলেছেন, ‘সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য মেয়েরাই দায়ী।’ গত ২৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘সারা বিশ্বেই ঋণখেলাপিদের মাফ করে দেয়ার ব্যবস্থা আছে। দেশে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন কার্যকর না থাকায় ব্যাংকে প্রবেশ করলে সেখান থেকে বের হওয়ার পথ ছিল না। তাই আমরা আইনগুলো কার্যকর করে সেই আইনি প্রক্রিয়ায় সহনীয় পরিস্থিতি তৈরি করে সবাইকে এখান থেকে মাফ করে দেয়ার ব্যবস্থা করব।’ তিনি বলেন, ‘সব ব্যবসায়ীকে জেলে পাঠিয়ে দিয়ে দেশের অর্থনীতি চালানো যাবে না। তবে আবার সবাইকে মাফও করা যাবে না। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অবশ্যই অ্যাকশন নিতে হবে।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘যদি আমাদের ব্যাংকিং খাত স্বাভাবিকভাবে চলতে না পারে আর ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে যায় আর নন-পারফর্মিং লোনের পরিমাণ যদি বেড়ে যায় তাহলে আমরা আমাদের অর্থনীতিতে যে গতিশীলতা সেখান থেকেও বিচ্যুত হব। রেট অব ইন্টারেস্ট আমরা কমাব। আর যদি রেট অব ইন্টারেস্ট কমানো না যায় তাহলে নন-পারফর্মিং লোন কখনও কমবে না। নন-পারফর্মিং লোন তখনই হয় যখন ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করতে পারে না। নন-পারফর্মিং লোন হওয়ার কারণটিই হচ্ছে রেট অব ইন্টারেস্ট ইজ টু মাচ হাই।’ সংসদে প্রদত্ত অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে সুদের হার বেশি হওয়ার কারণে ব্যাংকের ঋণগ্রহীতারা ঋণ শোধ করতে না পেরে খেলাপী হয়ে যাচ্ছে। এ অনিচ্ছাকৃত খেলাপীদের মাফ করে দেয়া উচিত। তাদের খেলাপী ঋণ ব্যাংকের হিসাব থেকে অবলোপন অর্থাৎ বাদ দেয়া উচিত না হলে ব্যাংক খাতকে সবল না দেখিয়ে সবসময় তাকে রুগ্ন দেখাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে পাওয়া যায় ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিলো ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। গত দশ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য এক প্রতিবেদন মতে, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল মাত্র ৫ জন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে। জিয়াউর রহমান সরকারের আমলের প্রায় শেষে ডিসেম্বর ১৯৮০-তে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৮ জনে। এরশাদ সরকারের পতনের সময় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সংখ্যা ছিল ৯৪৩ জন। ১৯৯৬ সালের জুনে ছিল ২,৫৯৪ জন। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৫,১৬২ জনে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮,৮৮৭ জনে। ২০০৮ সালে হয় ১৯,১৬৩ জন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫,৫৬৩ জনে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গত দশ বছরে দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৫৬,৪০০ জন। রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালনা পর্ষদের অযাচিত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণ, সরকার অনুগতদের নিয়ম বরখেলাপ করে ঋণ প্রদান এ বিশাল পরিমাণ খেলাপী ঋণ সৃষ্টির কারণ। এ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা নেয়ার আগে লাভজনক বেসিক ব্যাংক সরকার নিযুক্ত পর্ষদ এর অদক্ষতা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ প্রদানের কারণে বর্তমানে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার খেলাপী ঋণ বহন করতে বাধ্য হচ্ছে। ২০০৯ সালের পরে সরকারি দলের সমর্থক ব্যবসায়ীদের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কুঋণসমূহ অধিগ্রহণ করায় পরবর্তীতে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার ব্যবসায়ীদের স্বস্তি দেয়ার জন্য খেলাপী ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন এবং খেলাপী ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের শর্ত পরিবর্তন করে দিয়েছিল। বর্তমানে সরকার তথাকথিত ঘটনাক্রমে বা অনিচ্ছাকৃত খেলাপীদের সুদের হার কমিয়ে দিয়ে, ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের আরো সহজ করে তদপরি মওকুফ করে দেয়ার মাধ্যমে সমর্থক ব্যবসায়ীদের চূড়ান্ত স্বস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই এর নিরংকুশ সমর্থনপুষ্ট ৩০ ডিসেম্বরের এ সরকারের এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাই অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকেই নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে। বেসরকারি খাত উপদেষ্টা হয়েছে একজন ব্যবসায়ী যার বিরুদ্ধে ঋণ খেলাপীসহ পুঁজিবাজার কেলেংকারীর অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের উক্তি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে আগাম তথ্য পাওয়ায় ঘূর্ণিঝড় ফণী’র ক্ষতি কমানো গেছে এটি তার অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। কারণ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট হলো জিওস্টেশনারি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট, এটা ব্যবহার করা হয় যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায়। আর আবহাওয়ার তথ্য জানতে ব্যবহার করা হয় মেটেওরলজিক্যাল বা ওয়েদার স্যাটেলাইট নামের ভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট; ওইটার কাজ শুধু আবহাওয়া, ঘূর্ণিঝড়, টাইফুন এগুলো নিয়ে। কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার দিয়ে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ার খবর পাওয়া সম্ভব না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের উক্তি– পুণ্যবতী প্রধানমন্ত্রীর দোয়া কবুল হয়েছে বলেই ঘুর্ণিঝড় ফণী ক্ষতি করতে পারেনি। একজন চিকিৎসক যাকে বিজ্ঞানমনস্ক বলা যেতে পারে এটি তার অতিশয়োক্তি। যাকে তেলবাজিও বলা যেতে পারে। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেছেন, ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়। তার এ বক্তব্য মানতে নারাজ ঢাকাবাসী। দীর্ঘদিন যাবৎ ওয়াসার সরবরাহকৃত দূষিত পানির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত জুরাইনবাসীর ওয়াসার এমডিকে ‘শরবত খাওয়ানো’র কর্মসূচি ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে ঢাকাবাসীর মধ্যে। টিআইবি’র গবেষণায় জানা গেছে ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির প্রতি অনাস্থার কারণে ৯১% ঢাকাবাসী পানি ফুটিয়ে পান করেন এতে বছরে আনুমানিক ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হয়। ওয়াসার পানি প্রাপ্তি এবং মান নিয়ে ঢাকাবাসীর অসন্তুষ্টি দীর্ঘদিনের। রাত জেগে পানি ধরার কাহিনী ঢাকার অধিকাংশ এলাকার মানুষের। ওয়াসার এমডির অসত্যকথন ঢাকাবাসী বিদ্রুপের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে। গণমাধ্যমে যে ঘটনাগুলো আসে তা থেকে দেখা যায় প্রতিমাসে গড়ে একশ সত্তর জন নারী যৌননিপীড়নসহ সহিংসতার শিকার হন। চলমান মে মাসের প্রথম আট দিনে একচল্লিশ জন শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এমতাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান মেয়েদের কুয়েত মৈত্রী হলের এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বলেছেন, সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য মেয়েরাই দায়ী। ইসলামের ইতিহাসের এ অধ্যাপক বলেন, মেয়েদের ঢ, ণ দুটো ক্রোমজম থাকে আর ছেলেদের থাকে ঢ, ঢ দুটো ক্রমোজম। যা বিজ্ঞানসম্মত নয় এবং পুরো সত্যের বিপরীত। নারীর প্রতি সহিংসতাপূর্ণ সমাজে নারীর পাশে না দাঁড়িয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মত ব্যক্তির এ ধরণের ভ্রান্তিপূর্ণ বক্তব্য নারীর প্রতি সহিংসতা আরো বৃদ্ধি করবে। সমাজের উচ্চ আসনে অবস্থানকারী ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে দেশের আম জনতা বাস্তবসম্মত দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য আশা করে। কিন্তু আমাদের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গের বাগাড়ম্বরপূর্ণ অবাস্তব অতিশয়োক্তি তাদের মনন ও মেধার স্বল্পতারই প্রকাশ ঘটায়। এ ধরণের অজ্ঞানতাপ্রসূত আবোলতাবল বক্তব্য ব্যক্তির সাথে সাথে দেশ ও জাতির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য যদি সরকার বাস্তবায়ন করে তবে তা দেশের লুটেরা ব্যবসায়ী যারা গত দশ বছরে সাত লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে তাদেরই স্বার্থ সংরক্ষণ করবে এবং দেশের ষোল কোটি মানুষের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়া হবে। এটাই শঙ্কার বিষয়।