মহান অক্টোবর বিপ্লব : মানবমুক্তির ধ্রুবতারা

Posted: 12 নভেম্বর, 2017

মৃণাল চৌধুরী: ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর রুশ দেশে মহামতি কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। ২০১৭ সালের ৭ নভেম্বর বিপ্লবের শততম বার্ষিকী পূর্ণ হতে চলেছে। শোষিত মানুষের ভাগ্য বদল এবং পরাধীন জাতির মুক্তির বারতা বিশ্বব্যাপী ঘোষিত হল মহান অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে। রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব এ গৌরবের বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছে যে, শোষণমুক্তি এবং সকল ধরনের বৈষম্য অবসানে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ মতবাদ। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হল সর্বকালের সর্বদেশের মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল মানব ইতিহাসের নতুন যুগ বা নতুন সভ্যতার সূচনা। হাজার হাজার বছরের চলে আসা শোষণমূলক সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে সকল ধরনের শোষণ বৈষম্যের অবসান ঘটানোর এই রুশ বিপ্লব ছিল বিশ্বব্যাপী শোষিত শ্রেণির কাছে অবিশ্বাস্য ও অবস্মরণীয় ঘটনা। যুগ যুগ ধরে মানবমুক্তির কল্পনা বাস্তব সত্যে রূপ নিল। রাজার রাজ সম্রাট, রাশিয়ার ভাষায় জার। তেমনই এক ক্ষমতাধর সম্রাট–যাকে সাধারণ প্রজারা দেবতা জ্ঞান করতো– কি আশ্চর্য! তাকেই উল্টে দিল অশিক্ষিত চাষা-মজুরের দল! শ্রমিক কৃষক ও সৈনিকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গরিবের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার তথাকথিত যন্ত্রটা সমূলে উৎপাটন করে ফেলল? প্রমাণিত হলো পুঁজিবাদ ইতিহাসের শেষ কথা নয়। শোষণ, নির্যাতন, দারিদ্র্যতা ভাগ্য বা নিয়তির লিখন নয়। প্রমাণিত হলো কোনও রাজা, কোনও বীর, কোনও সেনানায়ক বা কোনও অলৌকিক শক্তি মানুষের জন্য বিধাতা নয়। মানুষ নিজেই তার ভাগ্য নিয়ন্তা। মানুষের সমবেত শক্তির কাছে অন্য কিছুই তুলনীয় নয়। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, জীবন-জীবিকার সকল মৌলিক সমস্যার সমাধান একমাত্র সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই সম্ভব। ইংল্যান্ডের বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকান বিপ্লব– প্রত্যেক বিপ্লবে রাজা গেছে–রাজা এসেছে। কিন্তু রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে খোল নলচে পাল্টে দিয়ে রাজার রাজত্ব চিরতরে খতম করে প্রজারা ঘোষণা করল- ‘আমরা সবাই রাজা’। তার মহান নেতা হলেন মহামতি লেনিন। অক্টোবর বিপ্লব হলো মানবমুক্তির ধ্রুততারা। যা পরাধীন জাতির সামনে এনে দিলো মুক্তির আগমনী বার্তা। রুশ বিপ্লবের প্রভাব পড়ল দেশে দেশে, সারা দুনিয়া। বিশ্বের দেশে দেশে গড়ে উঠতে শুরু করল কমিউনিস্ট পার্টি, কোথাও বা ওয়ার্কার্স পার্টি। ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে গঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)। মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তাৎপর্য, বিশ্বব্যাপী প্রভা, এসকল বিষয় আলোচনা করার সাথে সাথে আমাদেরকে অবশ্যই বিপ্লবের পার্টি বলশেভিক পার্টি এবং রুশ বিপ্লবের মহানায়ক কমরেড লেনিনের বিচক্ষণ নেতৃত্বের বিষয়টি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে রাখতে হবে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা মার্কস বলেছিলেন– ‘জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মতো শিল্পায়িত দেশেই প্রথমে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লব সংগঠিত হবে।’ লেনিন মার্কসবাদকে বিকশিত করলেন– তিনি পরিস্থিত, সময়, জনগণের বিপ্লবী মেজাজ, পার্টির পারঙ্গমতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী যুগে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গন্ডিতে আঘাত করে রাশিয়ায় বিপ্লব সংগঠিত করলেন। ট্রটস্কি বলেছিলেন- ‘সাম্রাজ্যবাদী যুগে একটিমাত্র দেশে বিপ্লব সংগঠিত করা সম্ভব নয়।’ লেনিন প্রমাণ করলেন– বিপ্লবী শর্ত যদি পূর্ণ থাকে বিপ্লব পরিচালনার মত যদি যোগ্য পার্টি থাকে তাহলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতির দেশেও বিপ্লব সফল করা সম্ভব। আমরা যদি অতি সংক্ষিপ্তভাবে মহান বিপ্লবের প্রস্তুতি পর্ব পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই যে, ১৮৯৮ সালে রাশিয়ার সকল জাতির সর্বহারাদের স্বার্থ রক্ষার্থে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস অনুষ্ঠানের পরপরই বলতে গেলে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সকলেই গ্রেপ্তার হয়ে যান। কমরেড লেনিনকেও আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। পাটি ছত্রভঙ্গ। এই দুঃসময়ে কেবল মাত্র ইস্ক্রা পত্রিকার মাধ্যমে পার্টি কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। ১৯০৫ সালে বিপ্লবী অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরে, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ১৯১২ সালে মেনশেভিক সুবিধাবাদীদের বাদ দিয়ে লেনিন কেবল মাত্র তাঁর অনুসারীদের নিয়ে গঠন করলেন বলশেভিক পার্টি। কমরেড লেনিন বলশেভিক পার্টির সংগঠন রীতি-নীতি-পদ্ধতি সব ঠিক করে গভীর প্রত্যয় ঘোষণা করে বললেন– “ধনিক শ্রেণির সকল অস্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির একটি মাত্র অস্ত্র– আর তা হলো শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী পার্টি”। রাশিয়ার জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানালেন– “আমাকে একটি বিপ্লবী পার্টি দাও– আমি রাশিয়াকে পাল্টে দেব।” ১৯১৪ সালের ১ অগাস্ট শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ডেমোক্রেটিক পার্টি পিতৃভূমি রক্ষার নামে জার সরকারের পক্ষে অবস্থান নিল। লেনিন ঘোষণা করলেন– ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণি ও গরিবদের কোনো স্বার্থ নেই।’ তিনি ঘোষণা করলেন- বলশেভিক পার্টি ক্ষমতায় আসলে যুদ্ধ বন্ধ করে দেয়া হবে। বলশেভিক পার্টির ডাকে প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক ধর্মঘটে অংশ নিচ্ছে। ফ্রন্টে সৈনিকরা ক্লান্ত, অবসন্ন ও ক্ষুধার্ত। রাশিয়ার জনগণকে বাধ্যতামূলকভাবে ফ্রন্টে পাঠানো হচ্ছে। লেনিনের যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তির শ্লোগানে সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সাড়া পড়ল। শ্রমিকেরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও দু’বেলা খেতে পায় না। রাশিয়ার দূর-দূরান্তের কৃষকেরা যুগ যুগ ধরে জমি হারা এবং চরমভাবে নির্যাতিত। সৈনিকদের জন্য রশদ যোগানো সম্ভব হচ্ছে না। তারা শান্তি চায়। এককথায় রাশিয়ার মানুষ নতুন করে বাঁচতে চায়। লেনিন তাদেরকে নতুন পথে নতুনভাবে বাঁচতে শেখালেন। রুটি, জমি, শান্তি এবং মুক্তি– তাৎপর্যপূর্ণ শ্লোগান। জনগণ সেই শ্লোগান লুফে নিল। ১৯১৭ সালের ১৭ মার্চ পুরানা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৭ ফেব্রুয়ারি সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয় এবং অস্থায়ী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। লেনিনের আহ্বানে স্ব স্ব পেশার জনগণ নিজস্ব দাবিতে শত শত সমিতি গড়ে তোলে। কমরেড লেনিন শ্লোগান তুললেন– ‘সকল ক্ষমতা সোভিয়েত এর হাতে’)। রাশিয়ার শ্রমিক, কৃষক, সেনিকেরা উজ্জীবিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ সৈনিকেরাও বিদ্রোহে যোগ দিলেন। তারা অস্থায়ী সরকারের সকল ছল, চাতুরি, ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার জবাব দিল মহান অক্টোর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার মাধ্যমে। মহান অক্টোবর বিপ্লব সফল করার প্রেক্ষাপটে আমরা দেখি যে রাশিয়ার বুর্জোয়া পার্টি, পেটি বুর্জোয়া দৌদুল্যমান কমিউনিস্ট সুবিধাবাদী, এমনকি নিজ দলের অভ্যন্তরেও কমরেড লেনিনকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। ক্ষুরধার যুক্তি ও লেখনির মাধ্যমে তিনি ছদ্মবেশী বিপ্লবীদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। দ্রুততার সাথে পক্ষের শক্তিকে সংগঠিত করেছেন। মিত্র শক্তিকে কাছে টেনেছেন। এমনকি শত্রু পক্ষের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলিকেও বিচক্ষণতার সাথে কাজে লাগিয়েছেন। জনগণের মন, মেজাজ বুঝে সঠিক সময়ে সঠিক শ্লোগান ও দ্রুত কৌশল বদলের ক্ষেত্রে কমরেড লেনিন ছিলেন অদ্বিতীয়। তাঁর গঠিত বিপ্লবী পার্টি ছিল বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনার শাণিত অস্ত্র। বিপ্লবী কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার পরে লেনিন প্রথমেই পুরাতন রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে নতুনভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা গঠন করার কাজে মনোনিবেশ করেন। সকল যুদ্ধমান জাতি ও সরকারকে যুদ্ধ বন্ধ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানালেন। প্রতিবিপ্লবীরাও কিন্তু বসে নেই। জার্মানদের বিপদ তো আছেই। সোভিয়েত সৈন্যদলের বিরুদ্ধে জড়ো করা হয় সংকার কসাক ও জমিদারদের ভাড়াটে গুন্ডাদের। বাম নামধারী মেনশেভিকরা, বিশ্বাসঘাতকেরা লেনিনকে জার্মানির চর হিসাবে আখ্যায়িত করল। তারা শ্রমিকে-শ্রমিকে, শ্রমিকে-কৃষকে বিভেদ ও বিরোধ উস্কে দিল। শুরু হল অরাজকতা, খুন, গুম, সন্ত্রাস ও লুটপাট। অন্ততঃ তিনবার লেনিনকে প্রাণনাশের চেষ্টা করা হলো। শেষ পর্যন্ত গুপ্তঘাতকের হাতেই কমরেড লেনিনকে প্রাণ দিতে হয়। ১৯১৯ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনীও গড়ে উঠেনি, ১৪টি দেশের সেনাবাহিনী শিশুরাষ্ট্র সোভিয়েতকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। কিন্তু কোন ষড়যন্ত্রই জনগণের বিজয়কে ছিনিয়ে নিতে পারেনি। জনগণের বিজয়ের পাহারাদার জনগণই। মিথ্যা কুৎসা, ষড়যন্ত্র কোনো কিছুই বিপ্লবকে ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। বলশেভিক পার্টির নিষ্ঠা, দৃঢ়তা ও ত্যাগ-এর কাছে সবকিছু পরাস্ত হলো। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন একের পর এক গৌরব অর্জনের দিক থেকে ধনবাদী বিশ্বকে ছাড়িয়ে গেছে। পুঁজিবাদী বিশ্বের একশত বছরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সোভিয়েত ইউনিয়ন সাধন করেছে মাত্র দশ বছরে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা ও বাসস্থান সমস্যা সমাধানে সোভিয়েতের কল্পনাতীত সাফল্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুই কোটি তাজা প্রাণের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদী হিটলার বাহিনীকে পরাস্ত করে সারা বিশ্বকে ফ্যাসিবাদের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। মহাকাশ অভিযান দখল করেছে শীর্ষস্থান। স্বল্প সময়ের মধ্যে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়ে সমস্ত বিশ্বকে শান্তি-প্রতিষ্ঠার গ্যারান্টি দিয়েছে। পরাধীন দেশগুলির জাতীয়মুক্তি সংগ্রাম আস্থাভাজন বন্ধু হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সোভিয়েতের ভূমিকা ছিল নির্ধারক বিষয়। মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের গৌরবের শতবর্ষে দাঁড়িয়ে জেলায়-জেলায়, স্থানে-স্থানে বহু সভা-সমাবেশ-সেমিনারের আয়োজন হচ্ছে ও হয়েছে। মার্কসের ভাষায়- ‘জনগণকে বদলানোটাই মূল কাজ’। মানবমুক্তির একমাত্র পথ হল সমাজতন্ত্র। জনগণের জন্যই সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন বিপ্লব। আবার বিপ্লবের জন্যও প্রয়োজন জনগণ। পানি ছাড়া যেমন মাছ বাঁচতে পারে না– তেমনি জনগণ ছাড়া কমিউনিস্টরাও বাঁচতে পারে না। তাই আসুন– সঠিক সময়ে সঠিক রণনীতি অর্থাৎ বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের মতো কঠিন দায়িত্ব পালন করে এবং বিপ্লব পরিচালনার মতো যোগ্য পার্টি গড়ে তুলে মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও তাঁর মহানায়ক কমরেড লেনিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, সিপিবি